মহামারির বিপর্যয় মোকাবিলায় স্থানীয় সরকারের সম্পৃক্ততা জরুরি

1071

Published on জুলাই 24, 2021
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ

একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং সেগুলো স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে- এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর এই কারণেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্প্রসারিত একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না করতে পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়।

বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা প্রদান করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয় না। তবে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। যদিও সরকারের হাতে এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার বেশ কিছু ক্ষমতা রয়েছে।

যেকোনও ধরনের মহামারি, অতিমারি কিংবা দুর্যোগের সময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুর্যোগ চলাকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ কী ভূমিকা পালন করবে সেটি আইনে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই কারণেই ২০১৯ সালের প্রথম দিক থেকে চলমান করোনা অতিমারির সময় বিভিন্ন দেশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে স্থানীয় সরকারের প্রত্যেকটি একককে আপৎকালীন কিংবা দুর্যোগকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য আইনের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আমরা যদি ইউনিয়ন পরিষদের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে যে ২০০৯ সালের ইউনিয়ন পরিষদ আইনের ৬, ৩৫, ৩৬, ৩৮ এবং ৩৮ ধারায় দুর্যোগকালে ইউনিয়ন পরিষদসমূহ কি ভূমিকা পালন করবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে গত প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান করোনা অতিমারির সময় আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে কতটুকু ব্যবহার করতে পেরেছি? গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ অতিমারি মোকাবিলায় যে পরিমাণ সহায়তা সরকারকে প্রদান করতে পারে তা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। এ প্রতিষ্ঠানসমূহকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা জালের অন্তর্ভুক্ত সেবাসমূহ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা দেশ যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সেই সময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করতে পারি? সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি তা হলো বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি বড় অংশের করোনা সম্পর্কিত সচেতনতার অভাব রয়েছে। করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে বাসা বাঁধলে কতটা ক্ষতি করতে পারে সেই সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। কিংবা সরকার অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক করোনা সুরক্ষাবিধি সম্পর্কে জনগণের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আরও স্পষ্টভাবে বললে বলা যায় যে কীভাবে মাস্ক পরতে হবে, কেন মাস্ক পরতে হবে, কেন বারবার হাত ধুতে হবে এবং কেন জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে- এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণের পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ যেহেতু জনগণের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে, তাদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জনগণকে সচেতন করার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি।

করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি গ্রামাঞ্চলে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা সম্পর্কে মানুষের কুসংস্কার। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, এই কুসংস্কারের কারণে স্বজনরা করোনা আক্রান্ত হলে অনেকেই তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমরা দেশব্যাপী বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি, যেখানে দেখা গেছে পরিবারের সদস্যরা করোনা আক্রান্ত রোগীর লাশ পর্যন্ত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কিংবা বাবা-মা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় সন্তানরা তাদের খোঁজ নেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

এমতাবস্থায়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে যে বিষয়টি বোঝানো দরকার সেটি হলো করোনা আক্রান্ত মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুস্থ হয়ে যায় এবং করোনা সুরক্ষাবিধি মেনে চললে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই কাজটি সম্পাদন করা কেন্দ্রীয় সরকার অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষে কঠিন হলেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সম্পাদন করা অনেক সহজ। কারণ, জনপ্রতিনিধি তার এলাকার সবাইকে চেনেন এবং তাদের কথা জনগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেনে চলেন।

করোনার স্বাস্থ্যগত দিকের পাশাপাশি খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দিন আনে দিন খায়। লকডাউন চলাকালীন জীবিকার বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য। এই দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গ্রামের যুবকদের নিয়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠন করে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে এবং সেই অর্থ দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষদের সাহায্য প্রদান করতে পারে। এমনকি যেসব পরিবার করোনা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ খাবার সরবরাহ করতে পারে। আমাদের একটি কথা মনে রাখা দরকার যে এই অতিমারির সময়ে আমরা সবাই যদি সরকারের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে থাকি তাহলে সরকারের পক্ষে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিংবা মাসের পর মাস সহায়তা প্রদান করা সম্ভব নয়। ফলে অতিমারি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

এমনকি যেসব কৃষক লকডাউন চলাকালীন কিংবা করোনাকালীন তাদের জমির ফসল তুলতে কষ্ট পাচ্ছেন, তাদেরও সহায়তা প্রদান করতে পারে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে তারা এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে কৃষকদের সাহায্য করতে পারে। আমাদের মনে রাখা উচিত, কৃষি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হলে বিপর্যয় আরও বেড়ে যাবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সফলভাবে এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হওয়ার অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত না হওয়া। ফলে এই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরও বেশি কাজে লাগানো প্রয়োজন।

এছাড়াও সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টিকা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে টিকা প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাম্প করে আরও অধিক সংখ্যক জনগণকে টিকা প্রদান করার। সেই ক্ষেত্রে ক্যাম্প তৈরিসহ জনগণের মধ্যে টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ মানুষকে টিকার আওতায় না নিয়ে আসা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অতিমারি সময়ের ব্যবধানে ব্যাপক আকার ধারণ করবে। আর সরকার যেহেতু প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করে মাধ্যমে দেশের ৮০ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার, এই কার্যক্রমকে স্থানীয় পর্যায়ে সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।

দেশের দুর্যোগকালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ যে দায়িত্ব পালন করতে পারে, কিংবা আইনের মাধ্যমে তাদের যে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর বিপর্যয় মোকাবিলায় তার পরিপূর্ণ ব্যবহার এখন করা হয়নি। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে সরকার স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলায় তাদের সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি অন্তর্ভুক্ত করা গেলে সরকারের দায়িত্ব অনেকাংশে লাঘব হতো। বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপকতা গভীরভাবে উপলব্ধি করে সরকারের উচিত করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে স্থানীয় জনগণের করোনা অতিমারি সম্পর্কে সচেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত