লকডাউন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত যে কারণে যুক্তিযুক্ত

1902

Published on মে 19, 2021
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পাণ্ডেঃ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার গত ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউন বাস্তবায়ন করছে। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে করোনার মতো মরণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের অন্যতম একটি হাতিয়ার হচ্ছে লকডাউন বাস্তবায়ন করা। লকডাউন বাস্তবায়ন করার অর্থ যে যেখানে অবস্থান করছে তাকে সেখানে অবস্থান করতে বাধ্য করা। লকডাউন বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। কিন্তু একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো এই লকডাউন বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে কতদিন কার্যকর করা সম্ভব? লকডাউন কেন্দ্রিক যে বিষয়টি সবার মধ্যে আলোচিত হয় সেটি হলো বিশাল অংশের জনগণের জীবিকার কি হবে? কারণ, লকডাউনের সময় তাদের কোনও কাজ থাকে না? করোনায় জীবন ও জীবিকার প্রসঙ্গটি সব সময়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা হয়ে আসছে। একদিকে জীবনের জন্য যেমন জীবিকার প্রয়োজন, আবার জীবন না থাকলে জীবিকা দিয়ে কী হবে? প্রকৃতপক্ষে, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন।

গত প্রায় এক মাস যাবৎ লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের হার অনেক কমে গেছে। একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে সরকার বিশাল সংখ্যার মানুষের জীবিকার কথা চিন্তা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন করছে। মূলত লকডাউনের সময় সুরক্ষা বিধিমালা মানার শর্তে যেমন কল-কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে লকডাউনের দুই সপ্তাহ পরে একই শর্তে দোকানপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন মহল থেকে বিশেষ করে জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করলেও সরকারের হাতে এর চেয়ে ভালো কোনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে মাসের পর মাস লকডাউন বাস্তবায়ন করে জনগণকে ঘরের ভেতরে আটকে রেখে সাহায্য প্রদান করা সম্ভব নয়। যারা দিন আনে দিন খায় সেসব মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এই লকডাউনের সময়। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে সরকার প্রথম ঢেউয়ের মতো দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে লকডাউনের সময় বিভিন্ন শ্রেণির দরিদ্র মানুষকে সহায়তা প্রদানের জন্য। এমনকি দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে সাহায্য বাসায় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা করেছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঈদকে সামনে রেখে প্রায় ৩৬ লক্ষ পরিবারকে ২৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যেটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে দরিদ্র জনগণকে সহায়তা করা জন্য।

ইতোমধ্যে লকডাউনের সংক্রমণের হার অনেক কমে গেছে। লকডাউনের শুরুর দিকে সংক্রমণের হার ছিল ২২ থেকে ২৫ শতাংশ। সেই হার এখন ৬/৭ শতাংশে নেমেছে। এমনকি মৃত্যুর হারও অনেক কমেছে। ফলে এর অর্থ হচ্ছে যে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ হার কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে লকডাউন। সবার সহায়তায় এবং সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা কারণে লকডাউনের ফলে আমরা সংক্রমণের চেইনটিকে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছি। এই পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছিল এই ভেবে যে ঈদের পরে সরকার কি লকডাউন তুলে নেবে?

বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে ঈদ। ফলে, ঈদকে সামনে রেখে প্রায় সব স্তরের জনগণ নিজের ও পরিবারের জন্য নতুন পোশাক ক্রয় করেছেন। এমনকি বিশাল সংখ্যার মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। তবে ঈদের আগে মানুষ যে প্রক্রিয়ায় শহর থেকে গ্রামে গিয়েছে এবং এখন আবার গ্রাম থেকে শহরে আসা শুরু করেছে সেটা দেখে সত্যি সত্যি চিন্তা হচ্ছে। কারণ, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, এই অবস্থায় সরকারের পক্ষে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি সরকার আগামী ২৩ মে পর্যন্ত লকডাউন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটি অত্যন্ত সুচিন্তিত একটি সিদ্ধান্ত। কারণ, দুই সপ্তাহ যদি আমরা মানুষের চলাচল কিছুটা হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে সংক্রমণ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে। পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে শহরের মধ্যে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৬ মে থেকে। এই সিদ্ধান্ত দরিদ্র গণপরিবহন শ্রমিকদের সহায়তা করবে। তবে, সকল ক্ষেত্রেই সুরক্ষাবিধি মানাতে মানুষকে বাধ্য করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকারের জন্য।

অনেকেই সমালোচনা করছেন এই যুক্তিতে যে যেহেতু কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার কমে গেছে, লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের এটিও মনে রাখতে হবে যে আমার যদি আবার আগের মতো ঘোরাফেরা শুরু করি এবং করোনা সুরক্ষাবিধি মানার ক্ষেত্রে অনীহা প্রদর্শন করি, তাহলে আমরা পুনরায় সংক্রমণের শীর্ষে অবস্থান করবো। এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যখন হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ সংকট হবে এবং অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেবে। আমরা ইতোমধ্যে ভারতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে সব দিক থেকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ হাসপাতালের শয্যা নেই, অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে। রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভারতের অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সরকারের লকডাউন বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত সুচিন্তিত। কারণ, আমরা যদি সংক্রমণের হার শূন্যের কোঠায় নামাতে না পারি কিংবা সেখানে বেঁধে রাখতে পারি তাহলে যেকোনও সময় আবার এটা সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। তবে, পাশাপাশি এটিও ঠিক লকডাউনের সঠিক বাস্তবায়ন না হলে এর প্রভাব সংক্রমণের ওপর পড়বে না।

আবার অনেকে এই যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন যে এত লম্বা সময় ধরে লকডাউন বাস্তবায়নের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এটি যেমন ঠিক তেমনি অধিক সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সেটিও কোনোভাবেই মানা যায় না। ফলে, জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সরকার লকডাউনের সময় বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেটিকে আমি সাধুবাদ জানাই।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভারতে আবিষ্কৃত করোনার ডাবল বা ট্রিপল মিউটেন্ট ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা। এই ভাইরাস যেন বাংলাদেশের না ঢুকতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে সরকার ভারতের সঙ্গে ২৮ দিনের জন্য সব বর্ডার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই লকডাউন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেটিও বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ডাবল এবং ট্রিপল মিউটেন্ট ভাইরাসের সংক্রমণের হার প্রথম ঢেউয়ের ভাইরাসের সংক্রমণের হারের চেয়ে প্রায় ৩০০ গুণ বেশি।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও এই ভাইরাসের স্বীকৃতি প্রদান করেনি। তবে তারা এটা স্বীকার করেছে যে ইন্ডিয়ার এই ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাস প্রায় ১৭টি জায়গায় পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ যেহেতু ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, এই ভ্যারিয়েন্ট যদি আমাদের দেশে বিস্তার পায় তাহলে আমাদের অবস্থাও ভারতের মতোই হবে। এবং সে অবস্থা যদি সৃষ্টি হয়, সেটি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। যার জন্য আমি সবার কাছে আবেদন জানাই, আসুন নিজেরা কিছুটা কষ্ট স্বীকার করে হলেও সবার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি। করোনা মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই যুদ্ধ সরকারের একার নয়। আমরা সবাই একসঙ্গে যদি এই মহামারি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করি, তবে সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন আবারও আমরা মুক্ত জীবনে ফিরতে পারবো।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত