3025
Published on মে 5, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
৫ মে, ২০১৩ সাল থেকে ২৬ মার্চ, ২০২১ সাল। আট বছরের ব্যবধানে হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিংস্র অপশক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালিয়েছিল। দুই বারেই তাদের ভয়ংকর চেহারা বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে, যেমন দেখেছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী দলগুলোর চেহারা।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করেন- ভয়ংকর সন্ত্রাসের পথে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাওয়া ধর্মান্ধ দলগুলোর প্রকাশ্য প্লাটফরম কি বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল? না-কি বিএনপিই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে দূরে, অনেক দূরে সরিয়ে নিতে এ সব গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছে?
২০০১ সালের ১০ অক্টোবর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর রাজশাহীসহ কয়েকটি এলাকায় শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের জেএমবি ভাবতে শুরু করে- তালেবানি-বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে গেছে। সংবাদপত্রে এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে একাধিক সংবাদপত্রে নিয়মিত খবর প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী বলেন- “বাংলা ভাই, শায়খ রহমান কিংবা জেএমবি- কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। সবই মিডিয়ার সৃষ্টি।” তিনি খালেদা জিয়ার অনুমোদন নিয়েই এ মন্তব্য করেছিলেন, সন্দেহ নেই।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এভাবে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের সহযোগী শুধু নয়, সরাসরি অংশীদার রাজাকার-আলবদরদের উত্তরসূরী গোষ্ঠীকে আড়াল করতে চেয়েছিল। দুই দশক পরও সেই অপচেষ্টা চলছে। বিএনপি তাদের দিয়ে যাচ্ছে ছত্রছায়া। এ দলগুলো গণতন্ত্র চায় না, সংবিধান মানে না। আদালত-বিচার ব্যবস্থা মানে না। নারী শিক্ষা চায় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে না। চাকরি-ব্যবসায় নারীরা বিপুল সংখ্যায় আসুক, সেটা রুখতে নানাভাবে হুমকি দেয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের আগ্রহ নেই। অথচ বিস্ময়ের যে বিএনপির ২০ দলীয় জোটে এ ধরনের দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি হঠাৎ করেই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেন- মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজাকার-আলবদরদের খপ্পর থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হলে দেখা গেল ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের ১৯ জনকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ‘ইসলামী দলগুলো’র ৪০ জন পেয়েছে ধানের শীষ।
বিএনপির অন্দর মহলের খোঁজ রাখেন এমন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সংবাদকর্মীরা বলেন, বিএনপির ভেতরেও ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত অনেকে রয়েছে এবং তারা মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে পেরেছে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এ দলের যাত্রার সময় থেকেই জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী প্রভৃতি দলের অনেক কর্মী-সমর্থক বিএনপিতে যুক্ত হয়। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভাতেও তাদের পদ মিলেছে। তাদের কাছে বিএনপি ছিল প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার একটি প্লাটফরম। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে গণবিরোধী ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। সমাবেশ বিশাল ছিল, সন্দেহ নেই। মাত্র ৩ বছর আগে গঠিত হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন এ সমাবেশের ডাক দেয়। বিএনপি নেতৃত্ব সমাবেশ সফল করে তোলায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে। এ সমাবেশের দুই দিন আগে (৩ মে) খালেদা জিয়া একই স্থানে সমাবেশ ডেকে শেখ হাসিনাকে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের দাবি মানার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। বিএনপি-র নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ‘ইসলামী দলগুলোর’ জোট হেফাজতে ইসলামী সমঝোতা করেই অগ্রসর হচ্ছিল, সন্দেহ নেই।
খালেদা জিয়ার ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হতে না হতেই হেফাজতে ইসলামের শত শত জঙ্গি কর্মী দিনভর জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুর চালানোর পর সন্ধ্যায় হেফাজতে ইসলাম নেতারা ঘোষণা দেয়Ñ অনির্দিষ্টকাল তারা শাপলা চত্বরে অবস্থান ধর্মঘট পালন করবে। সে সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক হেফাজতে ইসলামীর সমর্থকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাপলা চত্বর ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানালে আল্লামা মামুনুল হক উত্তরে বলেন- “একটু পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই পালানোর পথ পাবে না।” তার কথা সত্য হয়নি। আইন শৃংখলা বাহিনী ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজত সমর্থকদের প্রায় বিনারক্তপাতে বিতাড়ণ করে দেয়। তবে জমায়েতে অংশগ্রহণকারীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ-র্যাব ইত্তেফাক-জুড়াইন-পোস্তগোলা-নারায়ণগঞ্জ পথটি খোলা রেখেছিল। ৬ মে এই এলাকা, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি মাদ্রাসা থেকে কিছুসংখ্যক ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসী যানবাহন ভাংচুর করে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়।
শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে উদ্দেশ্য হাসিল করতে না পেরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট (২০ দলীয় জোটের সূচনা জোট) ৮ ও ৯ মে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। হেফাজতে ইসলামীর ব্যানারে হরতাল ডাকা হয় ১২ মে। শাপলা চত্বর থেকে সন্ত্রাসীদের উৎখাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগ করে। পুলিশের আইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন দু’জন এ অভিযানের পর আমাকে বলেছেন- কেবল বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন দেশ আমাদের পুলিশ-র্যাবের ‘উন্মত্ত মব-ক্লিয়ারের’ এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে।
সম্প্রতি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এক কোর্সে অংশ নেওয়ার সময় বিভিন্ন দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অফিসাররা ২০১৩ সালের ৫ মে রাতের পুলিশ-র্যাবের অভিযান সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন।
অথচ এ রাতেই হেফাজতে ইসলামীর নেতারা খোয়াব দেখেছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় ‘রিসোর্টে কেলেঙ্কারীর’ অভিযোগে আটক মামুনুল হক পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় জানিয়েছেন- শাপলা চত্বরের সমাবেশের প্রধান নেতারা নিশ্চিত ছিলেন যে শেখ হাসিনার সরকার পড়ে যাবে। এমনকি নতুন সরকারে কে কে থাকবে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- সেটাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ তালিকায় বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান অথবা মির্জা ফকরুল ইসলামের নাম নেই। অথচ বিএনপি নেতারা স্বপ্নে বিভোর ছিলেন- ধর্মান্ধ চরমপন্থিরা তাদেরই ঘর থেকে ডেকে নিয়ে গদিতে বসিয়ে দেবে। এ ধারণা থেকেই ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের দুই মাস আগে ৩ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের প্রতি বিএনপি সুকৌশলে সমর্থন জানায়। ওই দিন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ঢাকা সফরে আসেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পূর্ব থেকেই আগ্রহ দেখায় এবং ভারতীয় পক্ষ তাতে সাড়া দেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠতম মিত্র জামায়াতে ইসলামীর হরতালের দিন তিনি বাসার বাইরে বের না হতে মনস্থ করেন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচি বাতিল করে দেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রণব মুখোপাধ্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা অভিযানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলায় সক্রিয় ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলদেশ সরকারকেও নানাভাবে সহায়তা করেন। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী সে সময়ে কুখ্যাত আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিল, যারা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা অভিযানের দোসর। এমন একটি দলের ডাকা হরতাল ‘অমান্য’ করতে চাননি খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি।
কথায় বলে, কুকুরে লেজ নাড়ায় নাকি লেজ কুকুরকে নাড়ায়! জামায়াতে ইসলামী এবং একাত্তরে পাকিবাহিনীর সহযোগী অন্যদলগুলোই বিএনপিকে পরিচালিত করছিল, সেটা স্পষ্ট। জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতা কখনও স্বীকার করতে চাননি যে একাত্তরে তাদের কর্মকাণ্ডে কোনো ভুল ছিল। মামুনুল হকের পিতা খেলাফত মজলিসের নেতা আজিজুল হক এক সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘একাত্তরে তারা ছিলেন নিরপেক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষে।’
তবে ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন জল্লাদ ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিল, তেমনি ছিল জামায়াতে ইসলামী ও খেলাফত মজলিসের মতো অপশক্তি। কিন্তু সম্প্রতি আমরা দেখি খেলাফত মজলিস ও হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠা মামুনুল হক ঘোরতরভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বিরোধী। তিনি বিভিন্ন ওয়াজে মাদ্রাসা ছাত্রদের আহ্বান জানাতেন ‘পারমাণবিক বিজ্ঞানী হতে, যারা এমন ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র বানাবে যার সাহায্যে বাংলাদেশ থেকেই বোতাম টিপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অফিস ও বাসভবন হোয়াইট হাউস নিশ্চিহ্ন করে ফেলা যায়।’
আমরা এটা জানি যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জন্য পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর পাকিস্তান সরকার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখে।
সব দলের গোড়া যে এক স্থানে!
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। তিনি স্বদেশে ফেরেন ১৭ মে। এ দিন তাকে লাখ লাখ নেতা-কর্মী সংবর্ধনা জানায়। তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর গড়ে তোলা দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। তিনি দেশব্যাপী বারবার সফর করতে থাকেন, মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া। কিন্তু একইসঙ্গে ‘ঘাতকের বুলেট’ তাকে তাড়া করে ফিরছিল। বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
কখনও ঘাতকের ভূমিকায় মুফতি হান্নানের দল, কখনো ১৫ অগাস্টের ঘাতকের দল, কখনো জেএমবি কিংবা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিএনপিকে সামনে রেখে অন্য কোনো অপশক্তি। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়, আহতের সংখ্যা শত শত। শেখ হাসিনা নিজেও আহত হন। সে সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু ভয়াবহ এ ঘটনাটি নিয়ে খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে আলোচনা পর্যন্ত করতে দেননি।
কেবল শেখ হাসিনার ওপর নয়, হামলা হয়েছে রমনা বটমূলে ঐতিহ্যবাহী পহেলা বৈশাখ ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, যশোরে প্রগতিশীল সংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে, পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায়। বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের নাম আসে। বিস্ময়করভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় বিএনপির কাছ থেকে। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার এ দলটি ছাতা ধরে থাকে বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তে জড়িতদের আড়াল করতে।
একইসঙ্গে আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী শক্তির তরফে অপপ্রচার-কুৎসা রটনা সমানে চলছে। সাম্প্রদায়িকতা তাদের হাতিয়ার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের প্রচারাভিযানকালে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, শঙ্খ বাঁজবে।” ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে শান্তি চুক্তি সম্পাদনকালে তিনি বলেছিলেন, “এ চুক্তির কারণে পার্বত্র চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম থেকে নেয়াখালি ও ফেনি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ভারতের দখলে চলে যাবে।”
বাস্তবে সেটা ঘটেনি, কিন্তু ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী শক্তি এবং বিএনপি তাতে দমেনি। তারা বছরের পর বছর এক সুরে কথা বলে গেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন যে তাদের জন্য গাত্রদাহ সৃষ্টি করবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তবে সরাসরি এ সব ইস্যু সামনে না এনে তারা অগ্রসর হয় সুকৌশলে। তারা দাবি তোলেÑ ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না।’ অথচ ২০১৫ সালের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং সে সময় খালেদা জিয়া দলীয় নেতাদের নিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলোচনা করেন।
হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব বানচাল করার জন্য করোনার মধ্যেও বিভিন্নস্থানে মিছিল-সমাবেশ করতে থাকে। তাদের বক্তব্যে থাকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির উস্কানি। ১৯৭১ সালে আমরা শুনেছি- “পাকিস্তানি আর্মি মুক্তিবাহিনী মারে, আওয়ামী লীগ মারে, হিন্দু মারে।” স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেও প্রায় একই সুর তাদের। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হরকাতুল জিহাদ ও হেফাজতে ইসলামী- সবার সুর এক।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ অবস্থান, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধীরস্থিরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার স্বভাবজাত গুণ এবং একাত্তরের ধারায় দেশ পরিচালনার জন্য জনগণের ঐকান্তিক আগ্রহের কারণে সন্ত্রাসী অপশক্তির চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। গত এক যুগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচক এবং জীবনমান উন্নয়নে অনেক অগ্রসর হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো বার্তায় বাংলাদেশের এ অগ্রগতির প্রশংসা করেছে মুক্তকণ্ঠে। যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুধু বিরোধিতা করেই চুপ থাকেনিÑ এর অভ্যুদয় রুখতে চেয়েছে, তারা উন্নত-সমৃদ্ধ-গর্বিত বাংলাদেশকে মেনে নেবে না- এটাই স্বাভাবিক। তারা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর সময় মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসের পথে ক্ষমতা দখলের জন্য। এবারেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তারা চুপচাপ আমাদের অগ্রযাত্রা মেনে নেবে, এটা ভাবার কারণ নেই। আবার তারা আঘাত হানার চেষ্টা করবে বিএনপি কিংবা হেফাজতে ইসলাম কিংবা জেএমবি কিংবা অন্য কোনো নামে। এদের বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখতেই হবে।
লেখকঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও গবেষক
সৌজন্যেঃ bdnews24.com