হেফাজতের হেফাজতকারী কে বা কারা

1673

Published on এপ্রিল 28, 2021
  • Details Image

এম. নজরুল ইসলাম:

গণমাধ্যমের টপ নিউজ এখন হেফাজতে ইসলাম ও মামুনুল হক। ২০১৩ সালে হঠাৎ করে লাইম লাইটে চলে আসা সংগঠনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। নিজেদের অরাজনৈতিক বললেও সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। আবার সরকারবিরোধী পক্ষ নিজেদের প্রয়োজনে এই ধর্মীয় সংগঠনটিকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরই তার প্রমাণ। গত ১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে পালিত হয়েছে মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা। এই সময়ে সারা দেশে তারা তাণ্ডব চালায়। তাদের হামলার শিকার হয়েছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এর আগে তারা জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার উসকানি দিয়েছে। ধর্মদ্রোহী এই সংগঠনটি ধর্মের নামে ছড়িয়েছে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা। সরকারের কঠোর অবস্থানের পর সংগঠনের নেতারা এখন কিছুটা হলেও নমনীয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ছোট করে হলেও হুঙ্কার দিচ্ছেন। যেমন গত ১২ এপ্রিল সোমবার হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী। সোমবার এক বিবৃতিতে সংগঠনের গ্রেপ্তার নেতা-কর্মীদের মুক্তি না দিলে কঠোর হওয়ার হুমকি দেন। বিবৃতিতে বাবুনগরী বলেন, ‘হেফাজত নেতাকর্মীদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সরকার প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হেফাজতে ইসলামের সরলতাকে দুর্বলতা মনে করলে এর চরম মাশুল দিতে হবে। নিরাপরাধ মানুষকে এভাবে গ্রেপ্তার ও হামলা-মামলা বরদাশত করা হবে না। হেফাজতে ইসলাম দেশে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস চায় না। হেফাজতে ইসলাম একটি সুশৃঙ্খল ও শান্তিপ্রিয় সংগঠন। তবে নেতাকর্মীদের উপর এভাবে জুলুম চলতে থাকলে আমরা নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকব না। দেশবাসীকে সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।'

কিন্তু মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে তাঁর স্বর ও সুর বদল হয়ে যায়। ১৯ এপ্রিল সোমবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় বাবুনগরী বলেন, ‘মোদি আসার বিষয়ে আমরা হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচি দেইনি। বিভিন্ন বক্তারা তাঁদের বক্তৃতায় মোদির আগমনের বিরোধিতা করেছেন। তা ছাড়া গত ২৬ মার্চ আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। গত ২৬ মার্চের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু অঘটন ঘটে গেছে। যেগুলোর কোনোটিতেই হেফাজতের কমান্ড ছিল না। হেফাজতে ইসলাম ভাঙচুরে বিশ্বাস করে না। হেফাজতের নেতাকর্মীরা ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও করেনি।’ তাঁর মতে, ‘সরকারকে অনেকেই হেফাজতের বিষয়ে ভুল বুঝাচ্ছে। কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা নামানো হেফাজতের উদ্দেশ্য নয়। হেফাজত সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাবে না।’ সংগঠনটির প্রভাবশালী নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার ও সাত দিনের রিমান্ডের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখন সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথ খুঁজছেন সংগঠনটির নেতারা। এরই অংশ হিসেবে গত সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন সংগঠনটির নেতারা।

একটু খবরের দিকে চোখ ফেরানো যাক। প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বারবার উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। আর এসব উসকানিতে ব্যবহার করেছেন ধর্ম। তাঁর বক্তব্যের জেরেই ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি এলাকায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতের অনুসারীরা।’ প্রশ্ন হচ্ছে এই সময়ে বাবুনগরীরা কোথায় ছিলেন? তিনি নিশ্চয় মামুনুল হকের পক্ষে ছিলেন। এই মামুনুল হকই তো ভাস্কর্য-বিরোধী অবস্থান উত্তাপ ছড়িয়েছিলেন সারা দেশে। গত নভেম্বরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি স্কুল মাঠে তিন দিনের একটি ওয়াজ মাহফিলের সমাপনী অনুষ্ঠানে গিয়ে জুনাইদ বাবুনগরী বললেন, ‘আমি কোনো পার্টির নাম বলছি না, কোনো নেতার নাম বলছি না.... কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিঁড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব’। জুনাইদ বাবুনগরীর ইঙ্গিত স্পষ্ট।

সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের ধারণা হেফাজতকে আজকের এই বিধ্বংসী অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে জামায়াত ও বিএনপি। নিজেদের এজেন্ডা তারা হেফাজতের মাধ্যমে কার্যকর করতে চেয়েছে। অনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থে তারা হেফাজতের সুবিধা নিতে চেয়েছে। নিজেদের যখন কোনো কার্যক্রম নেই, তখন হেফাজতকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ নিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। তাই দেখা যায় মামুনুল হকসহ হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রকাশ্য বিরোধীতা করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে এই লকডাউনের সুযোগ নিয়ে একটা ক্র্যাকডাউন করা হয়েছে। সেই ক্র্যাকডাউনের মধ্য দিয়ে একদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের ধর্মীয় নেতা-আলেম-উলামাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের কাছে যাঁরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র তাঁদের গ্রেপ্তার করে, তাঁদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলাও দেওয়া হচ্ছে।'

হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ এবং হরতালে সহিংসতার পর সংগঠনটির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। মির্জা ফখরুলের ভাষায় তাঁরা ধর্মীয় নেতা, আলেম-উলামা। সব মামলা তুলে নিয়ে অবিলম্বে তাঁদের মুক্তি দাবি করেছেন মির্জা ফখরুল। তাঁর ভাষায় তাঁরা ‘শ্রদ্ধার পাত্র’। বিএনপি মহাসচিব কথিত একজন ‘শ্রদ্ধার পাত্র’ সম্পর্কে জানা যাক। তিনি যাঁদের দেশের ‘ধর্মীয় নেতা-আলেম-উলামা’ বলছেন, তাঁদের একন মামুনুল হক। রিসোর্ট কাণ্ডের পর তাঁর নৈতিক স্খলনের বিষয়টি সবার কাছে এখন স্পষ্ট। পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্কিত বিষয়ে মামুনুল বলেছেন, জিডি হওয়ার ঘটনায় থাকা দুই নারীকেই তিনি ‘চুক্তিভিত্তিক’ বিয়ে করেছেন। তাঁদের সঙ্গে শর্ত ছিল বিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। আত্মীয়স্বজন ও সমাজের কাছে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করা হবে না। তবে ভরণপোষণ দেওয়া হবে। এই মামুনুল কি মির্জা ফখরুল কথিত ‘শ্রদ্ধার পাত্র’ ও ‘ধর্মীয় নেতা-আলেম-উলামা’?

দেশের সাধারণ মানুষ জানে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত কয়েকদিনে কাদের গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এখন বিএনপি মহাসচিব তাঁদের ‘শ্রদ্ধার পাত্র’ বলছেন। তাঁকে সাক্ষী করা হলে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাবেন তো? না গেলেও তাঁর গত কয়েকদিনের বক্তব্য থেকে এটা প্রমানিত হয় যে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিও হেফাজতের হেফাজতকারী। বিএনপির কর্মকাণ্ড ও দলীয় মহাসচিবের বক্তব্যই তার প্রমান। জামায়ত হেফাজত প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও হেফাজতের জামায়াত সংশ্লিষ্টতা প্রমান হয়ে যায় সংগঠনটির উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত