1658
Published on এপ্রিল 17, 2021অজয় দাশগুপ্ত
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণের অবিস্মরণীয় দিনটি ৫০ বছর পূর্ণ করল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জেনোসাইডের পটভূমিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ২৬ মার্চ, প্রথম সরকার গঠিত হয় ১০ এপ্রিল। সে সরকার শপথগ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের আমবাগানে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করা হয়।
শপথ অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি অতিথি ও সংবাদকর্মীর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ হলে যে সব আয়োজন থাকত, পাকিস্তান বর্বর আর্মি বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে বধ্যভূমিতে পরিণত করলেও আমবাগানে কোনও কিছু বাদ পড়েনি।
শপথগ্রহণের খবর ছিল সংবাদকর্মীদের জন্য ‘স্কুপ’, এমন সুযোগ অনেকের জন্য ‘ওয়ানস ইন আ লাইফটাইম’। অল্প সময়ের মধ্যে গোটা বিশ্ব জেনে যায়- বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত চারশ-রও বেশি সদস্যর বেশিরভাগের সম্মতিতে গঠিত এ সরকারের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ছিল নিরঙ্কুশ। একটি মহল মুক্তিযুদ্ধকালে ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠনের প্রসঙ্গ তুলেছিল। সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবিও ছিল। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুততার সঙ্গে সমর্থন জানাতে পারে।
সে সময়ের মেহেরপুর মহকুমার আমবাগানে শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) আর পি সিং। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারতের সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন, অবসর নেন ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তার সঙ্গে ঢাকায় আমার কয়েকবার কথা হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, শিখ সম্প্রদায়ের সদস্য আমি। আমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী লম্বা চুল ও দাড়ি রাখতে হয়, পাগড়ি পরতে হয় এবং কৃপাণ থাকে সর্বক্ষণ। কিন্তু এ সব থাকলে তো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না। পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা শিখ যুবকের ছবিও হয়ত পেয়ে যাবে এবং এটা দেখিয়ে প্রচার করবে- মুক্তিবাহিনীর নামে লড়াই করছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি শিখ ধর্মের সব চিহ্ন বিসর্জন দেন। ক্লিন শেভড আর পি সিং-কে কখনও দেখা যায় বাঙালি কৃষকের লুঙ্গি-গেঞ্জি পোশাকে, কখনও বা ছাত্রদের মতো প্যান্ট-শার্টে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন আর পি সিংয়ের ওপর বিশেষ দায়িত্ব অর্পিত হয়- বাংলাদেশের ১৩২ জন তরুণকে সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে গড়ে তোলার ইন্সট্রাক্টর। এ দলে ছিলেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি প্রথমে পালিয়ে যান ধানমণ্ডির গৃহবন্দি দশা থেকে। বয়স কেবলই ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। পাকিস্তান আর্মি বাড়িটিতে ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিত। কিন্তু কখন যে কিশোর ছেলেটি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে উধাও হয়ে গেছে, বুঝতেই পারেনি।
আর পি সিং বলেছেন, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তার হাতে ক্ষমতা দেবে না, এটা স্পষ্ট হতে থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও এর প্রভাব পড়তে পারে, এমন শঙ্কা থেকে ২০ মার্চ বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ভারত কয়েকটি ইউনিট মোতায়েন করে। এর মধ্যে আর পি সিংয়ের ইউনিটও ছিল। এ সময় মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে শত্র“পক্ষের বেতার তরঙ্গ মনিটর করার যন্ত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক তথ্য ধরা পড়ে। এভাবেই ২৬ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, তার গ্রেপ্তার ও পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা পরিচালনার খবর ভারতের হাতে আসে। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে, এমন ধারণা থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েন বিএসএফ-এর সকল ইউনিটকে জানিয়ে দেওয়া হয়- বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্মী এবং সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করলে তাদের যেন স্বাগত জানানো হয়।
আর পি সিং বলেন, ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত থেকে খবর আসে, বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও তরুণ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বানপুর সীমান্ত চৌকিতে খবর পাঠিয়েছেন যে তারা ভারতে প্রবেশ করতে চান। এ খবর পেয়ে বিএসএফ-এর আইজি গোলক মজুমদার নিজে গিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়ে কলকাতা নিয়ে আসেন। নতুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দফতরেও এ খবর পৌঁছায় এবং তাদের দুইজনকে পয়লা এপ্রিল রাতে বিশেষ বিমানে গোপনে দিল্লি পাঠানো হয়। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের আলোচনা হয়। এ সময় বাংলাদেশের নেতা বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা নারী-পুরুষের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করা এবং বাংলাদেশকে সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথম বৈঠকেই বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। পরদিন দুই নেতা আবার বৈঠক করেন এবং এ সময় যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রশ্নটি আলোচনা হয়। দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের একত্রিত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেন। এ জন্য শত শত কিলোমিটার পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়। তদুপরি, খোন্দকার মোশতাক আহমদ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। তরুণ নেতাদের কেউ কেউ মন্ত্রিসভা গঠনেরও বিরোধিতা করেন। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কঠিন সময়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। বিএসএফ-এর রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার এ কাজে তাদের সহায়তা করেন। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পূর্বে ধারণকৃত জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ প্রচার করা হয়। ভাষণটি ছিল উদ্দীপনা-অনুপ্রেরণায় পূর্ণ।
আর পি সিং বলেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম কুষ্টিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে শপথগ্রহণের স্থান হিসেবে বৈদ্যনাথতলার নাম প্রস্তাব করেন। ২০১৭ সালে, বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছর পর একাত্তর টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে দু’জন সেই ঐতিহাসিক দিনের স্মৃৃতিচারণ করেন। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, যিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের কন্যা।
শপথগ্রহণের স্থান চূড়ান্ত করার বিষয়ে দুটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় ছিল- স্থানটি হতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় সমস্যা হবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোটা ঘটনা নিজে তদারক করেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বেসামরিক পোশাকে বিএসএফ-এর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তারা সফল হয়। তদুপরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকেও এ কাজে বেসামরিক পোশাকে যুক্ত করা হয়। পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের চররা এ সময়ে পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গায় সক্রিয় ছিল। তিনদিন আগে তারা চুয়াডাঙ্গায় বোমাবর্ষণ করে। তাদের কাছে খবর ছিল- ওই মহকুমা শহরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হতে পারে। আর পি সিং জানান, ১৫ এপ্রিল ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশনায় ভারতের সেনাবাহিনীর একটি দল আসে সীমান্ত এলাকায়। পরদিন প্রয়োজনে স্থলবাহিনীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী ও আর্টিলারির সহায়তার বিষয়টি আলোচনা হয়। ১৬ এপ্রিল মধ্য রাতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট মোতায়েন করা হয়। মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফ সদস্যরা বৈদ্যনাথতলা ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করেন অতি গোপনে, কেউ তাদের উপস্থিতি বুঝতে পারেনি। আর পি সিং ভারতীয় এক গোয়েন্দা অফিসারের মোটর সাইকেলে নিরাপত্তার সার্বিক আয়োজন তদারক করেন। ভারতীয় বিমান বাহিনী ও আর্টিলারি অফিসাররা আশপাশের উঁচু ভবন ও বড় গাছে অবস্থান নিয়ে চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। ওয়ারলেস সেটগুলো ছিল সর্বোচ্চ মাত্রায় সক্রিয়। তবে এতে কেবল শত্র“র তথ্য আদান-প্রদানের খবরই ধরা পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যে কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল তিনটি কুইক রিঅ্যাকশন টিম। তাদের হাতে পর্যাপ্ত যানবাহন ও অস্ত্র মজুদ ছিল। ভারতীয় বিমান বাহিনীর কমব্যাট এয়ার প্যাট্রোলও নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের মঞ্চ এবং চেয়ার ও শামিয়ানার ব্যবস্থা করা হয় দ্রুততম সময়ে।
সকাল থেকেই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতারা অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হতে শুরু করেন। তাদের অনেকেই ‘বধ্যভুমি বাংলাদেশ’ থেকে চরম ঝুঁকি নিয়ে ভারত ভূখণ্ডে পৌঁছাতে পারেন। বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক আসেন কলকাতা থেকে। এ দলে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশন কর্মীরা ছিল। তারা কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে রওনা দেওয়ার সময় কিংবা পথেও জানতেন না- কোথায় যাচ্ছেন এবং কেন যাচ্ছেন। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে বুঝতে পারেন- পেশাগত জীবনে রোমাঞ্চকর এক ঘটনার মুখোমুখি তারা। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা অনুযায়ী স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর উলেখ ছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তেজোদীপ্ত ও উদ্দীপনাপূর্ণ ভাষণ দেন। যখন তিনি জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা…’ পরিবেশনের সময় লাল-সবুজ-সোনালী রংয়ের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত। সমস্বরে স্লোগান ওঠে ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, তা এভাবে বাস্তবে রূপ নেয়। শপথের স্থানটি পরিচিত হয় মুজিবনগর হিসেবে, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে- মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের ঠিকানা হয় ‘মুজিবনগর’।
অনুষ্ঠান শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। আর পি সিং জানান, নানা দেশের ঝানু সাংবাদিকরা বুঝতেও পারেনি- এমন শ্বাসরুদ্ধকর শপথ অনুষ্ঠানের সঙ্গে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও বিএসএফ কীভাবে সংশিষ্ট ছিল। সবকিছুই সামনে থেকে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, সীমান্তের এত কাছে কেন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। উত্তরে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্মিতহাস্যে বলেন, “আমাদের ও আপনাদের নিরাপত্তাবিধানের জন্য।” এরপর তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরের একটি সড়ক পথ দেখিয়ে বলেন, এখন যত দূর খুশি যেতে পারেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশন সংবাদ সূত্রে গোটা বিশ্ব জেনে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ-এর ভাষণে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম উচ্চারণের সময় আরও বলেছিলেন- “আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” বাস্তবে তিনি হুকুম দিয়েছিলেন এবং জনগণ সেটা অনুসরণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এ বছর। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সুবর্ণ জয়ন্তীও এ বছরেই পূর্ণ হয়েছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ভয়ঙ্কর রোষে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গণহত্যা শুরু করে। তারা বলেছিল- ‘এক রাতেই সব ঠাণ্ডা। বাঙালি কেবল অস্ত্রের ভাষা বোঝে।’ বাঙালি যে অস্ত্র ধরতে জানে, শত্রুকে ঘায়েল করার কৌশল দ্রুততম সময়ে রপ্ত করতে জানে- সে ধারণা তাদের ছিল না। তারা বলত- ‘বাঙালি যোদ্ধার জাতি নয়।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের যোদ্ধার জাতিতে পরিণত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন। ১৭ এপ্রিল শপথ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম সরকার তাদের প্রশিক্ষণের আয়োজন ও অস্ত্রসজ্জিত করার কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারে। এ কাজে ভারত সরকারেরও ছিল অনন্য অবদান। বাংলাদেশের বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা কেবল প্রতিবাদী হয়নি, স্বাধীনতার প্রচেষ্টায় সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এ সময় বিশেষভাবে দেখা যায় ভারতবাসীর মানবিক রূপ। বাংলাদেশের জনগণ অবশ্যই এ সহায়তার কথা কখনও ভুলবে না।
প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সুবর্ণ জয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খোন্দকার মোশতাকে আহমদের হাতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তাকে আমরা দেখি যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর তার চক্রান্তেই নিহত হন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও তার সহযোগীরা বাঙলাদেশের জনগণের কাছে চিরকাল ‘ঘৃণার স্তম্ভ’ হয়েই থাকবে।
সৌজন্যেঃ bdnews24.com