3327
Published on মার্চ 28, 2021খন্দকার হাবীব আহসানঃ
বাংলাদেশে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের সাথে চলছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের মহোৎসব।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের আগমনে উৎসবটি জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নতুন মাত্রায় আনন্দের ঢেউ তুলেছে। যার ইতিবাচক প্রভাব আগামীর সময়ে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণকে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ করে তোলারই ইঙ্গিত দেয়। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পূর্ণ হবার এ সময়কালে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী আমাদের জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। যার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বগুণেই অনেক উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ পরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির দিকপাল হয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে-শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশই দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রগতির সুপারসনিক কান্ট্রি।
অন্যদিকে যেই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে ৩০ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগে স্বাধীনতার মুক্ত আকাশ আমরা পেয়েছি সেই পরাজিত দেশটি উন্নয়ন অগ্রগতির বিচারে সবদিক দিয়েই পিছিয়ে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি যে দক্ষিন এশিয়ার হট টপিক সেটি সমগ্র বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কই স্পষ্ট প্রমান। সল্পনোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে প্রমানিত হয়ে দুর্বার এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। যদিও আমাদের এগিয়ে যাবার এই সূচকের প্রতি ঈর্ষা অনেক দেশেরই রয়েছে তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার ইতিহাস যে কারো হৃদয়েই বেদনার জন্ম দেয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নির্মম গণহত্যা বিরল। তবে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর এই দেশটিতে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী দীর্ঘ নয় মাস ধরে গণহত্যা চালালেও তারা ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলে আমরা শত্রুমুক্ত হই, অর্জিত হয় চুড়ান্ত বিজয়। আমাদের এই স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীনতা। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেও বিবিধ কূটনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার হয়নি নির্মম গণহত্যা চালানো পাকিস্তানি সৈন্যদের কারো।যদিও শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রাজাকার আলবদরের বিচার কার্যকর শুরু করে চলমান রেখেছেন। এমনকি এই গণহত্যার কারণে পাকিস্তান বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমা চাইনি বাংলাদেশের কাছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর সংঘটিত গণহত্যার জন্য তাদের হৃদয়ে অপরাধবোধ কি এখনও জন্মায়নি নাকি অপরাধবোধ জন্মানোর মত মনুষত্ব্যবোধ তাদের নেই সেই প্রশ্নটির বয়স আজ ৫০ বছর।
১৯৭৪ সালে জুনের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় সরকারি সফরে আসেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। সে সময় তার সম্মানে প্রদত্ত এক নাগরিক সংবর্ধনায় ভুট্টো বলেছিলেন, ‘একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য আমি শোক প্রকাশ করছি।’ একই সভায় তিনি ‘মহানবীর নামে আপনাদের কাছে তওবা করছি’ বলে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় সরকারি সফরে এসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের মন্তব্য খাতায় লিখেছিলেন, ‘আপনাদের পাকিস্তানি ভাই ও বোনেরা একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য আপনাদের বেদনার সাথে একাত্মতা বোধ করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যে মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ঘটে, তা দুঃখজনক। পরে রাষ্ট্রীয় ভোজে ভাষণ দিতে গিয়ে মোশাররফ তার দুঃখের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন, এই ট্র্যাজেডি, যা আমাদের দুই দেশের ওপর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত।
ঢাকায় ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলার সময় পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার, বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে সামরিক অভিযানের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারছেন না কারন সেনা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাপূর্ণ দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে এমন ইতিবাচক ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে যতটা মেরুদন্ডওয়ালা রাজনৈতিক নেতা হতে হয় তিনি সম্ভবত তেমন নেতা হয়ে উঠতে পারেননি পাকিস্তানের।কারন আনুষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমা চাইতে হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
জুলফিকার আলী ভুট্টো বা পারভেজ মোশাররফের এই দুঃখ প্রকাশ অবশ্যই ক্ষমা প্রার্থনা ছিলো না, এবং তারা বা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণায়, ১৯৭১ এর নির্মম গণহত্যাকে- গণহত্যা হিসাবে উল্লেখ বা ৭১ এর হত্যা,ধর্ষণ,লুটপাট, নির্যাতন যে মানবতাবিরোধী অমানবিক কর্মকান্ড ছিলো সেটি স্পষ্ট করে কোথাও ক্ষমা চাননি। বরং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করলে পাকিস্তান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান এবং কাদের মোল্লা সহ অনান্যদের ফাঁসি কার্যকরে পাকিস্তানের সংসদে গৃহীত একটি রেজল্যুশনে শোক প্রকাশ করে । ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে এমন আচরণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের এটি ভুল নয় বরং অপরাধ, যেই অপরাধের জবাব বাংলাদেশ কিভাবে দিবে সেটি অবশ্যই নির্ভর করছে পাকিস্তান তাদের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত ক্ষমা চাইবে নাকি ক্ষমা চাইতে বাধ্য করলে ক্ষমা চাইবে সেটির উপর নির্ভর করবে।
লেখকঃ উপ বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ