1341
Published on ফেব্রুয়ারি 6, 2021'সকলেই প্রধানমন্ত্রীর লোক' শিরোনামে ঘণ্টাব্যাপী একটি ডকুমেন্টারি প্রচারের মাধ্যমে আলজাজিরা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিশানা করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তারা আরও একটি বিষয় সামনে আনার চেষ্টা করেছে আর সেটি হলো দুর্নীতি প্রকাশের নামে তারা বাংলাদেশের শাসন পরিবর্তনের খেলা খেলতে চায়।
শেখ হাসিনা যিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও মানব উন্নয়নের সুবর্ণ দশকের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যে সব বহিরাগত ও অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়রা তৎপর, তাদের শক্তি জোগানোয় এই প্রতিবেদনের মূল নিশানা।
আলজাজিরার প্রতিবেদনটি মূল দুটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছে- প্রথম পর্বে ভাইদের বিদেশে পুনর্বাসনের জন্য অনৈতিক কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয় পর্বে অন্যায় উপায়ে অর্থ উপার্জনের ইচ্ছুক কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তার ভাবমূর্তি নষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে আলজাজিরার ইতিহাস উন্মোচন করা যাক। এই চ্যানেল বাংলাদেশ সরকারকে অস্থিতিশীল করতে বিভিন্ন সময় বহু মনগড়া তথ্য প্রচার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেড় শতাধিক চাকরি হারানো সাংবাদিকদের নিয়ে ১৯৯৬ সালে এই চ্যানেলটি যাত্রা শুরু করার পর থেকে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশ ও সরকার সম্পর্কে কল্পিত সংবাদ প্রচার করে আসছে। আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সরকার পতনের জন্য কাতার সরকার এই চ্যানেলকে ব্যবহার করেছে। ২০১৩ সালে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় চ্যানেলটি হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের হত্যা-সংক্রান্ত মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছিল। তারা একটি কবরস্থান দেখিয়ে দাবি করে, মৃতদেহগুলো সেখানে সমাহিত করা হয়েছে। তারা কবর খোঁড়ে এমন একজন ব্যক্তির একটি সাক্ষাৎকারও প্রচার করে। তবে, বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল-৭১-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কবর খোঁড়া ব্যক্তি বোবা ছিলেন।
এমনকি, বাংলাদেশ সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন এই চ্যানেলটি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, তখন তারা এই সংবাদটির শিরোনাম দেয় 'বাংলাদেশে বিরোধী নেতাদের ফাঁসি'। এই চানেলটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যুদ্ধাপরাধীদের এবং উগ্রপন্থিদের ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে। তারা আদালতের স্বচ্ছতা সম্পর্কে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আলজাজিরার রিপোর্টটিকে হলুদ সাংবাদিকতার সর্বোত্তম উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
ডকুমেন্টারিটি প্রচারের মাধ্যমে তারা সাংবাদিকতার মূলনীতিগুলো স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে। ডকুমেন্টারিটির প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সেনাপ্রধান যখন দেশ ত্যাগ করেন, তখন থেকে তারা তাকে অনুসরণ করে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পরিচালনার অধিকার একজন সাংবাদিকের অবশ্যই রয়েছে। তবে, কোনো অনৈতিক কার্যকলাপে তার জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রচার করার আগে তাদের অবশ্যই সেনাপ্রধানের মতামত গ্রহণ করা উচিত ছিল। এমনকি, স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতিতে বলা হয়েছে যে, 'কোনো ব্যক্তিকে শুনানির অধিকারবঞ্চিত করে শাস্তি দেওয়া যায় না।' কেউ অপরাধী হলেও নিজেকে আত্মরক্ষার জন্য শুনানির অধিকার প্রদান করতে হবে। তাছাড়া, কোনো আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেন্টার থেকে কোনো দেশের সেনাপ্রধানের পেশাদার দায়িত্বের বাইরে অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রমের ওপর প্রতিবেদন প্রচার করা অনৈতিক কাজ। দুর্ভাগ্যক্রমে কিছু কাল্পনিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে চ্যানেলটি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সম্মানহানির চেষ্টা করেছে, যার প্রতিবাদ সেনাবাহিনী যথাযথভাবে করেছে।
এই প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এটি ডেভিড বার্গম্যানের ভাষ্য অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। তিনি এক সময় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। নিজেকে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্নেষক হিসেবে দাবি করলেও বাংলাদেশের বিরোধী জোটের প্রধানের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, যে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে রিপোর্টকে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হয়। তাছাড়া, অন্য ভাষ্যকারদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, তাদের রয়েছে বিতর্কিত অতীত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সামির সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে তিনি আজিজ আহমেদের ভাইকে হাঙ্গেরিতে অবস্থান করতে সহায়তা করেছিলেন। সুতরাং একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো উনি কেন তা করলেন। এর অন্তর্নিহিত কারণ হতে পারে, তার কিছু স্বার্থ সেখানে যুক্ত ছিল। ফলে ডকুমেন্টারিতে তিনি যা বলেছিলেন তা বিশ্বাস করা সহজ নয়।
তৃতীয় ব্যক্তি হলেন 'নিউ নিউজ' নামে একটি অখ্যাত নিউজ পোর্টালের সম্পাদক যিনি ইতোমধ্যে সরকার সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের জন্য বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মন্তব্যকারীরা যে দাবি করেছেন, তা ভিত্তিহীন। ভাষ্যকারদের মধ্যে কেউই কোনো কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রীর কথিত জড়িত থাকার পক্ষে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। মনগড়া সংবাদ প্রচার করে চ্যানেলটি প্রধানমন্ত্রীর সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করেছে, যিনি দেশকে উন্নয়নের পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। আর প্রবাসে বসবাসরত সরকারবিরোধী একদল মানুষ, যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারে না, সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মোবাইল ইন্টারসেপ্টর ডিভাইসের ক্রয়ের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিবেদনটির বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এই সরঞ্জামগুলো হাঙ্গেরি থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েনের জন্য কেনা হয়েছিল। যেহেতু সরঞ্জামগুলো ইসরায়েলে তৈরি, তাই আলজাজিরা দাবি করেছে, সরঞ্জামগুলো ইসরায়েল থেকে কেনা হয়েছিল, যা একটি ভিত্তিহীন গল্প। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে প্রকাশিত প্রতিবাদ লিপিতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রচারকারী সংস্থা হওয়ায় আলজাজিরার যে কোনো দেশের সংবাদ প্রচার করার সময় সাংবাদিকতার নীতি অনুসরণ করা উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে, তারা সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে চলেনি। পরিবর্তে, তারা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করার জন্য একটি মিথ্যা ডকুমেন্টারি সম্প্রচার করেছে।
আমরা ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির কথা শুনেছি, যা বিশ্বব্যাপী বেশ সমালোচিত হয়েছিল। এমনকি উইকিলিকস বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য উন্মোচন করেছে। তবে, কোনো ধরনের দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত কোনো কর্তৃপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি। অতএব, আমরা সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর সুনাম নষ্ট করার জন্য আলজাজিরার উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা জানাই। আন্তর্জাতিক মিডিয়া হাউসগুলোর উচিত আলজাজিরার এই জাতীয় অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে আলজাজিরার এই বানোয়াট প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেছে।
এই জাতীয় সংবাদকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে, এর উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করতে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে বন্ধন ভাঙার একটি গ্রুপের প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, যারা এই জাতীয় সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে চায়, তারা জনমতকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে না।
আমি প্রত্যাশা করব, আলজাজিরা একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করার জন্য হলুদ সাংবাদিকতা করা থেকে বিরত থাকবে। মানহানিকর প্রতিবেদন প্রচারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আলজাজিরার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা উচিত।