2204
Published on জানুয়ারি 28, 2021আবদুল মান্নান:
যে মানুষ জনগণের জন্য রাজনীতি করেন তিনি শুধু মানুষকে স্বপ্ন দেখান না, প্রথম সুযোগেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন এবং লক্ষ্য সঠিক থাকলে সেই স্বপ্ন এক সময় বাস্তবায়িত হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক নেতার অভাব ছিল না, এখনও নেই। তারাও মানুষকে বিভিন্ন সময় স্বপ্ন দেখিয়েছেন বা দেখান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি বা হয় না নানা কারণে। কখনও সুযোগ পেয়েও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়নি অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন সব কারণ সামনে উপস্থিত হয়েছে, যা মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না, স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে একটি স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তা অর্জনের জন্য তিনি আজীবন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন, তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল দেশ স্বাধীন করতে; শেষতক সেই স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল। বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। নেতা হতে গেলে ভিশন বা দূরদৃষ্টি থাকতে হয়, যা আজকের বিশ্বে বড়ই অভাব। যারা একজন ব্যক্তিকে নেতা মানেন তার স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হয়, তিনি তার অনুসারীদের আগামী দিনে কোথায় নিয়ে যেতে চান। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট হত্যা করার পর বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে তার কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সেই শূন্যস্থান অনেকটা পূরণ করেছেন, তার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন।
আজকের প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না কেমন ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ। রিলিফের চাল বা গম না এলে বেশিরভাগ বাড়িতে চুলায় হাঁড়ি চড়ত না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এই দেশের এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দেশের ভেতর প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ ঘরছাড়া। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। যারা নিজ ভিটেমাটিতে ফিরছে তারা দেখেন ভিটে আর মাটিটা আছে, তাদের আশ্রয়টা নেই, তা আগুনে পুড়ে মাটির সঙ্গে মিছে গেছে। কোথাও যে তারা মাথা গুঁজবেন তারও কোনো উপায় নেই। এই সময় বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকার এগিয়ে এলো। বিদেশ থেকে তার অনুরোধে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকে এলো রিলিফের ঢেউটিন। সাহায্য হিসেবে আসা সেই ঢেউটিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করলেন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন চার জাতীয় নেতার অন্যতম রাজশাহীর এএইচএম কামারুজ্জামান। সেই টিন দিয়ে ছিন্নমূল মানুষ সাময়িকভাবে তাদের মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করল।
বঙ্গবন্ধু আজীবন সাধারণ মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, পাকিস্তানের শাসনকালে তিনি বিভিন্ন সময় বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলে গেছেন কীভাবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। দেশ স্বাধীন হলে তিনি প্রায় বলতেন দেশের মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। বলতেন একটি স্বাধীন দেশের সরকারের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে দেশের মানুষের জন্য তাদের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। বলতেন স্বাধীন দেশের মানুষ বিদেশি সাহায্যনির্ভর থাকতে পারে না। তিনি তার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে তার এসব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ যখন সকল বিপর্যয় মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখেছে, ঠিক তখনই তাকে হত্যা করা হয়। তারপর দীর্ঘ একুশ বছর হারিয়ে গিয়েছিল ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশকে আবার তার কক্ষপথে নিয়ে আসার ব্রত নিয়ে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি যারা গত পঞ্চাশ বছর ধরে অনুসরণ করেছেন, তারা বুঝতে পারবেন কোথায় ছিল বাংলাদেশ আর সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ তার একটা বড় নমুনা পাওয়া গেল গত শনিবার যখন দেশের প্রায় সত্তর হাজার গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমি ও পাকা বাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যার মুজিববর্ষের একটি অঙ্গীকারের অংশ। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের কোনো মানুষ যেন গৃহহীন না থাকে তার চেষ্টা তিনি করবেন, যেমনটি পিতা করেছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গৃহহীনদের গৃহ দেওয়া। এই প্রকল্পের অধীনে প্রথম পর্যায়ে সত্তর হাজার বাড়ি গৃহহীনদের মাঝে গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি হস্তান্তর করেছেন। বাংলাদেশসহ যখন সারাবিশ্ব করোনা মহামারির কারণে বিপর্যস্ত- এমন একটি নজিরবিহীন কর্মযজ্ঞ অনেকের কাছে অভাবনীয় মনে হতে পারে। এমনটি অতীতে ঘটতে হয়তো দেখা গেছে কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, তাও সীমিত আকারে। আর নানা প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে তো নিয়মিত মানুষ গৃহহীন হচ্ছে। এসব কারণের মধ্যে নদীভাঙন অন্যতম।
আশ্রয়ণ প্রকল্পটি প্রথম গ্রহণ করা হয় সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদকালে ১৯৯৭ সালে, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মোপযোগী করে তোলা। তার সেই মেয়াদে প্রায় তিন লাখ কুড়ি হাজার বায়ান্নটি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর সরকার পরিবর্তন হলে এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মাস দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ছিন্নমূল হওয়া পরিবারগুলোর জন্য কক্সবাজারের খুরুশকুলে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে কুড়িটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন, যা ছয়শ উদ্বাস্তু পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পশ্চিমা দুনিয়ার মিডিয়া বাংলাদেশে ভালো কিছু হলে তা সংবাদ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কিন্তু দেশে কোনো নেতিবাচক সংবাদ না থাকলেও প্রয়োজনে একটি উদ্ভাবন বা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। করোনার কারণে বিশ্বে এই মুহূর্তে ভালো সংবাদের আকাল। এরই মধ্যে শনিবারের গৃহহীনদের মাঝে এই সত্তর হাজার জমিসহ পাকা বাড়ি হতে পারত একটি বড় খবর, তা হয়নি। তাই বলে সরকার তো আর বসে থাকতে পারে না। এই প্রকল্পের অধীনে মুজিববর্ষে মোট নয় লাখ গৃহহীনকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। সামনের মাসে আরও এক লাখ পরিবার বাড়ি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এই করোনাকালে শেখ হাসিনা করোনা নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রশংসা করেছে। বিশ্বের যে বাইশটি দেশ এই সময় দেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ইতিবাচক রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। এই সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়ে নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। কোনো মানুষকে সরকার না খেয়ে মরতে দেয়নি। তারপরও দেশের একটি মহল মনে করে শেখ হাসিনার আমলে দেশ শেষ হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র করে তার নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাতের। না পেরে ইদানীং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চীনা রেস্তোরাঁয় খেয়ে দোয়া মাহফিলের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।
যে কোনো সরকারের ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে তবে তাদের ভালো কাজের প্রশংসা না করা হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করার জন্য যেভাবে ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে মনে রেখেছে, তার কন্যাকে মনে রাখবে একজন জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে। গৃহহীনদের গৃহ দেওয়ার চেয়ে মুজিববর্ষে আর ভালো কোনো কাজ হতে পারে বলে মনে হয় না। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন তাদের সকলকে অভিনন্দন।
লেখকঃ বিশ্নেষক ও গবেষক
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল