বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্গঠন

1296

Published on জানুয়ারি 19, 2021
  • Details Image

এস, এম, লুৎফর রহমান:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এর স্বাধীনতা উত্তর অর্থনৈতিক পুনবার্সন, পুর্ণগঠন ও সংস্কারের  উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহ পুর্নগঠন।

১৯৭০ সনে সাইক্লোন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসলীলার ফলে দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পরে। ১৯৭০ সালে সাইক্লোনে তৎকালীন মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩.৮০% বিনষ্ট হয়। পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সাইক্লোন বিধ্বস্ততা মোকাবেলা করার জন্য অর্থনৈতিক বা সামাজিক পুনবার্সনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষতি। বাংলাদেশ ব্যাংকে কোন বৈদেশিক মুদ্রা বা গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন কাঠামো, আর্থিক কাঠামো, ব্যাংক ব্যবস্থা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। দেশের ভেতরে ব্যাংকের বহু শাখা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, বহু শাখা লুট করা হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ বাঙালী ব্যাংকারদের। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ও কেন্দীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ পুর্নগঠন ছিল দূরহ কাজ। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নীতি নির্ধারণী কাজ, মুদ্রা ও বিষয়ক ব্যাংকিং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। এই অবস্থায় পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক গতি চালু করতে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি আদেশ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করা হয়। এই আদেশ কার্যকর করা হয় ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় জনাব মুশফেক-উস-সালেহীন এবং ১৮ই জানুয়ারী, ১৯৭২ প্রথম গর্ভনর নিযুক্ত করা হয় জনাব এ. এন. হামিদুল্লাহকে। কোন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও গোল্ড রিজার্ভ ছাড়া এবং পাকিস্তানীদের  রেখে যাওয়া ৩৫৮ কোটি টাকা দায় মাথায় নিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের যাত্রা। পাকিস্তানের বিরোধিতা স্বত্বেও ১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করেছিল এবং আন্তজার্তিক মুদ্রা তহবিলে জমা দেওয়ার জন্য চাঁদা বাবদ ২০ লক্ষ ডলার মূল্যের স্বর্ণ কানাড সরকারের কাছ থেকে ক্রয় করেছিল। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে একাউন্ট খোলা হয়েছিল, ফলে স্টারলিং এলাকার সদস্য হয়েছিল। আন্তজার্তিক মুদ্রা তহবিলের সদস্য পদ লাভ করেছিল; এই তহবিল থেকে নিজস্ব ভাগ বা কোটা এবং প্রত্যাহার বা ড্র্ইংয়ের অধিকার দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যে ৯৫.০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানী করতে সক্ষম হয়েছিল।

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ছিল না। পরবর্তীতে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ এর পরিমান নিম্নরূপ:

সময়

অর্থের পরিমান (কোটি টাকায়)

সময়

অর্থের পরিমান (কোটি টাকায়)

জুন, ১৯৭৩

১২৫.৩৪

মে, ১৯৭৪

৪২.৬৯

জুলাই, ১৯৭৩

১৩৫.৬৮

জুন, ১৯৭৪

৮৯.২৬

আগস্ট, ১৯৭৩

১৫০.৬২

জুলাই, ১৯৭৪

৭৩.৮১

সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩

১৫১.৫১

আগস্ট, ১৯৭৪

৩৪.৭৭

অক্টোবর, ১৯৭৩

১৫১.৬৯

সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪

৪৪.৫২

নভেম্বর, ১৯৭৩

১৩৫.১৩

অক্টোবর, ১৯৭৪

৫৪.৪৭

ডিসেম্বর, ১৯৭৩

১১৬.১৫

নভেম্বর, ১৯৭৪

১০১.২৭

জানুয়ারি, ১৯৭৪

৯৬.৪৯

ডিসেম্বর, ১৯৭৪

১১১.৪৯

ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪

৭৫.৯৭

জানুয়ারি, ১৯৭৫

১৪২.১৭

মার্চ, ১৯৭৪

৮৪.২৮

ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫

১৬৯.৭৯

এপ্রিল, ১৯৭৪

পাওয়া যায়নি

মার্চ, ১৯৭৫

১৭২.৮৭

১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে দেখা যায় ব্যাংকের হাতে নগদ টাকা নেই, ব্যাংকে দায় ও সম্পদ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশ অবাঙ্গালী যারা স্বাধীনতার আগে বা পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। যে সকল শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়া হয়েছিল তা অধিকাংশ বন্ধ এবং মালিক অনুপস্থিত। এই অবস্থায় ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমানতকারীদের টাক ফেরত দিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থায় এই নাজুক অবস্থার সামাল দিতে এবং ১৯৭০ সালে নির্বাচনী ইস্তেহার অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয়। স্বাধীনতার পূর্বে মোট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল ২২টি। এর মধ্যে ৩টি বিদেশ ব্যাংক, ৫টি ভারতীয় ব্যাংক, ১০টি অবাঙালী পাকিস্তানী মালিকানাধীন, ২টি বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংক এবং ২টি সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়:

১। গ্রাম অঞ্চলে শাখা সম্প্রসারণ করা।

২। ঋণ বন্টনের ক্ষেত্রে কৃষি ঋণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন ঋণ প্রদানে অগ্রাধিকার দেয়া।

৩। রপ্তানীমুখী শিল্পে ঋণ প্রদান।

৪। বাণিজ্যিক লাভের চেয়ে সামাজিক লাভ ও সেবা প্রদানে অগ্রাধিকার প্রদান।

এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

১। পাট কলগুলো চালু করার জন্য তাদের স্থায়ী সম্পদের বিপরীতে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা, তাদের নতুন বিনিময় হারে রপ্তানী করার সুযোগ দেয়া হয়।

২। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের তাদের বাড়ি, জমির বিপরীতে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং কোন জামানত ছাড়া ২৫,০০০/- (পঁচিশ হাজার মাত্র) টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয়।

৩। ব্যাংক গুলিকে সুস্থ প্রতিযোগীতায় ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়।

৪। পূর্বে গৃহীত ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়।

উল্লেখিত ২২টি ব্যাংকের মধ্যে অবাঙালী পাকিস্তানী মালিকানাধীন ১০টি ব্যাংক এবং বাঙালী মালিকানাধীন ২টি ব্যাংক রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ ১৯৭২ অনুযায়ী জাতীয়করণ করা হয়।

ক্রমিক নং

রাষ্টায়ত্ত্ব ব্যাংক

জাতীয়করণের পূর্বের নাম

অনুমোদিত মূলধন (কোটি টাকায়)

পরিশোধিত মূলধন (কোটি টাকায়)

১.

সোনালী ব্যাংক

ক) ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান

খ) প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড

গ) ব্যাংক অব ভাওয়ালপুর

৫.০০

২.০০

জনতা ব্যাংক ব্যাংক

ক) ইউনিয়ন ব্যাংক

খ) ইউনাইটেড ব্যাংক

৫.০০

১.৫০

অগ্রণী ব্যাংক

ক) হাবিব ব্যাংক লিমিটেড

খ) কমার্স ব্যাংক লিমিটেড

৫.০০

১.০০

৪.

রূপালী ব্যাংক

ক) মুসলিম কর্মাসিয়াল ব্যাংক লিমিটেড

খ) স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড

গ) অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক

৫.০০

১.০০

৫.

পূবালী ব্যাংক

ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক

৫.০০

১.০০

৬.

উত্তরা ব্যাংক

ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন

৫.০০

১.০০

উল্লেখিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন ছিল বাঙালী মালিকদের বাকীগুলি ছিল অবাঙালী পাকিস্তানীদের।

দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যা পূর্বেই সরকারের মালিকানাধীন ছিল এ দুটির নাম পরিবর্তন করা হয়।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নতুন নাম

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নাম

পরিশোধিত মূলধন (কোটি টাকায়)

১। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক

১। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান

৩.০০

২। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক

২। এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান

৩.০০

জাতীয়করণের থেকে বাদ দেয়া হয় ৩টি বিদেশী ব্যাংক এবং ৫টি ভারতীয় ব্যাংককে। ভারতীয় ৫টি ব্যাংক ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর অকার্যকর ছিল।

৩টি বিদেশী ব্যাংক হলো:

১। আমেরিকান এক্সপ্রেস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক কর্পোরেশন

২। ন্যাশনাল এন্ড গ্রিনলেজ ব্যাংক

৩। চার্টার্ড ব্যাংক

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২টি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকার প্রতিষ্ঠা করে:

১। বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা

২। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক

১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরো ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকার প্রতিষ্ঠা করে:

১। বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন।

উল্লেখিত ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিশেষায়িত ব্যাংক দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। দেশের জনসাধারণের নিকট সঞ্চিত অর্থ জমাকরণ এবং জমাকৃত অর্থ উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল করার জন্য ব্যাংকের শাখার পরিমান দ্রুত বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নেয়।

১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের শাখার পরিমান উল্লেখ করা হলো।

বছর

শাখার পরিমান

১৯৭২

১১৬৯

১৯৭৩

১২৭৩

১৯৭৪

১৪৯৩

১৯৭৫

১৫৯৪

১৯৭২ সালে মোট ১১৬৯ শাখার মধ্যে শহর অঞ্চলের শাখা ৭৫৭টি এবং গ্রামীণ অঞ্চলে শাখা ছিল ৪১২টি।

এই ব্যাংকের শাখা বৃদ্ধিতে কৃষকদের হাতে কৃষিঋণ সহজলভ্য করতে কৃষি ব্যাংকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশী হারে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কারণ কৃষি উৎপাদন, বৃদ্ধি করার মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা। এছাড়া তখন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল।

বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ব্যাংক ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছিল।

তফসিলী ব্যাংকের অগ্রগতির বিবরণ ১৯৭২ - ১৯৭৫ (কোটি টাকায়)

 

শাখা

আমানত

ঋণ

নীট মুনাফা

লোকবল

১৯৭১-৭২

১১৬৯

৫২৩.৬১

৩৮৮.৫১

-

-

১৯৭২-৭৩

১২৯৫

৭০২.৬৮

৫৫৪.২৫

১.২৪

১৭৫১০

১৯৭৩-৭৪

১৫১২

৯১৩.২০

৭৩৭.১০

৬.৭৫

২১৩২১

১৯৭৪-৭৫

১৬১১

১০১৪.২০

৮০৬.৮০

৮.১৭

২৭১৭৩

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) স্থাপিত ১৯৭৪ সালে।

লেখকঃ এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড; পরিচালনা পরিষদের সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি; সাধারণ সম্পাদক, সোনালী ব্যাংক বঙ্গবন্ধু পরিষদ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত