1597
Published on জানুয়ারি 9, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
একটানা এক যুগ বা ১২ বছর ক্ষমতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ- রেকর্ড কেবল কি সময়ের হিসাবে? এ সময়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেঅনেক অর্জন, যা থেকে বিশ্বের অনেক দেশ ও মর্যাদার সংস্থা শিক্ষা নিতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের সকলে কি শিক্ষা নিতে আগ্রহী? ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আগে দেশবাসীকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উন্নত বিশ্বের সারিতে দেশকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে তাঁরা আশু লক্ষ্য ছিল ‘স্বল্পোন্নত দেশ’- এই তালিকা থেকে মুক্তি। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানের অর্জিতপ্রিয় বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হবে। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রাক্কালে (২০০৮) তিনি আরও কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন করা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার, শিক্ষার প্রসার ও মান বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রভৃতি। তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের স্লোগান সামনে আনেন।
শেখ হাসিনার সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক বড়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন এবং আদালতের রায় কার্যকর হবে, এমন ভাবনা অনেকের মধ্যেই ছিল না। জিয়াউর রহমান-মোশতাক চক্র ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ চিরতরে বন্ধ রাখতে চেয়েছিল। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করলে গৃহযুদ্ধের হুমকি এসেছিল। এ ধরনের অনেক বাধা দূর করে ‘সাহস থাকলে বিচার কর’- খুনিদের এ দম্ভোক্তি চূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দণ্ড কার্যকর করা হয়। যখন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হচ্ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির টেলিফোন এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে- ‘দণ্ড কার্যকর করা হলে এমন পরিস্থিতির উদ্ধব হতে পারে, যা বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করবে।’
বদলে যাওয়া বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুঝতে পারেন নাই। বিশ্বব্যাংকও বুঝতে পারে নাই। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিক বলে দাবী করেন যারা, তারাও বুঝতে পারেন নাই।
আমাদের জানা আছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এ নির্বাচন এবং একইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ জুড়ে ভয়ঙ্করসন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল। পেট্রল বোমা হামলায় কার্যত জ্বলছিল রাজধানীঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকা। একের পর এক হরতাল-অবরোধ ডেকে দেশকে চরম অরাজকতার মধ্যে ঠেলে দিতে চেষ্টা চায়। একটানা ৯৩ দিন-অবরোধ হরতাল-পেট্রল বোমা কে কবে দেখেছে?
২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর সংগঠক জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ না করলে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়। এর তিন মাস পর ৫ মে হেফাজতে ইসলাম সেই একই অঙ্গনে সমাবেশ ডেকে সরকার পতনের ডাক দেয়, যার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বলিষ্ঠ অবস্থানের কারণে এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। যুদ্ধারাপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হতে থাকে। সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ বন্ধের দেশী-বিদেশী চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে যায়। ‘দুর্নীতির গালগল্প’ তৈরি করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এই অশুভ শক্তির জন্যই বিলম্বিত হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ৪১ স্প্যানের সবগুলো বসানোর কাজ সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘মহাকালের ব্যবধান’ ঘুচানোর পথে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। অথচ ‘পদ্মা সেতু’ প্রকল্প দুর্নীতির আভাস মিলছে- এই মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণ বাতিল করানো হয়েছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের জাইকাও এ চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে প্রকল্প থেকে সরে যায়। সে সময় বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন- দুর্নীতির জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণ বাতিল করল। সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন- পদ্মা সেতুতে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। ড. আকবর আলী খান বলেছিলেন- ঋণদানকারী সংস্থা বাংলাদেশকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন- বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনার পরপরই যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। বিশ্বব্যাংকের অবস্থানই তাঁর কাছে সঠিক মনে হয়েছিল।
দুর্ভাগ্য, এ ধরনের মন্তব্য যারা করেছেন তারা বিশ্বব্যাংকের সে সময়ের নেতৃত্ব যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম অন্যায় করেছে, তার নিন্দা তো দূরের কথা- সামান্য সমালেচনা করতেও ব্যর্থ হন। কেউ কেউ তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকের অভিযুক্ত করতে থাকেন। কানাডার আদালতকে ধন্যবাদ যে তারা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক রায়ে জানিয়ে দেয়- ‘বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা জল্পনা-গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়।’
গত ১৯ ডিসেম্বর ‘৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক’ নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি, অসদাচরণ ও অন্যান্য অনিয়ম অনুসন্ধানে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছেন। সাংবিধানিক পদে থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করলে তার প্রতিকারে এ ধরনের কাউন্সিল গঠনের বিধান সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে রয়েছে। কেউ হয়ত ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ কারা হতে পারেন, সে প্রশ্ন করবেন। এদের কেউ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভণ্ডুল করার জন্য বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ২৯ ডিসেম্বর (২০১৩) ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচি সমর্থন করেছিল। তাদের দাবি ছিল- ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত রাখা হোক। এটা করা হলে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক মহলের সুবিধা হতো- সন্দেহ নেই। এটাও নিশ্চিত করে বলা যায় যে ওই অশুভ শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে পদ্মা সেতু হতো না, ডিজিটাল বাংলাদেশ হতো না। যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিতের দাবি করেছিল তারা হেফাজতে ইসলামীর ৫ মে’র (২০১৩) ব্লাসেফেরি আইন প্রণযন ও নারীদেও পোশাক শিল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস থেকে বিদায় করে দিয়ে সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত করে গৃহকোণে ঠেলে দেওয়ার দাবির নিন্দা কওে নাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের জন্য যারা হুঙ্কার তোলে- তাদের বিরুদ্ধে বলে না। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান জারি করে বলেছিলেন (৪ আগস্ট, ১৯৭৬)- বাংলাদেশে কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে পারবে না, তাঁর আদর্শ অনুসরণের কথা বলতে পারবে না। তারই ধারাবাহিকতায় একটি মহল বলছে- শেখ মুজিবের ভাস্কর্য রাখা যাবে না, তার অনুসরণের কথা বলা যাবে না। বিশিষ্ট নাগরিকরা এ অশুভ শক্তির আস্ফালনকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ সম্পর্কে চরম তাচ্ছিল্যপূর্র্ণ ও অপমানসূচক মন্তব্য করে বলেছিলেন- ‘Bangladesh is an International Basket Case.’
কিসিঞ্জারের আগেও বিশ্বব্যাংকের দুই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। তাদের বিবেচনায় ‘বাংলাদেশ যদি উন্নতি করতে পারে, তাহলে বিশ্বের যে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।’
বঙ্গবন্ধু হেনরি কিসিঞ্জার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যের মোক্ষম জবাব প্রদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনকেই বেছে নেন। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন- ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ Basket Case নয়। দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।.... আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।’
এখন এই অফুরন্ত সম্ভাবনার বাংলাদেশকে দেশছে বিশ্ব।
বিশ্বব্যাংকের অন্যায় সিদ্ধান্ত ও ভুল পদক্ষেপের নিন্দায় ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের’ ক’জন মুখ খুলেছেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নেও কি তারা সঠিক অবস্থান নিতে পেরেছেন?
যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের একটি অংশ যে বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস হিসেবে উপহাস করেছিল সেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ১৫ অক্টোবর ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় নিবন্ধে রেখা হয়- ‘ভারত, পূর্ব দিকে তাকাও : বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের (ভারতের) জন্যও শিক্ষণীয়’। আগের দিন (১৪ অক্টোবর) আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল- পড়ছে ভারত! মাথা পিছু উৎপাদনে ‘অচ্ছে দিন’ যাচ্ছে বাংলাদেশে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু বলেছেন- ‘বাংলাদেশ ২০২১ সালে মাথা পিছু জিডিপিতে এগিয়ে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ৫ বছর আগে জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল।’
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট বার্তায় বলেছেন- ‘গত ৬ বছরে বিজেপির বিদ্বেষমূলক জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির দুর্দান্ত সাফল্য হলো- বাংলাদেশ ভারতকে ছাপিয়ে যেতে চলেছে।’
বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন- নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। ভিক্ষুকের জাতের কোনো ইজ্জত নেই।
আইএমএফ বলেছে- ভারতের মাথা পিছু জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে বাংলাদেশের পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এটাও লক্ষণীয় যে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের অর্জনকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারকে দেওয়া হয়েছে সাধুবাদ। একইসঙ্গে বাংলাদেশের প্রদর্শিত পথ থেকে শিক্ষা গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কি তেমন আলোচনা আমরা দেখি?বিশিষ্ট নাগরিকরা কি এ সব দেখেন না?বাংলাদেশের অর্জন থেকে অন্যরা শিখছে, বিশিষ্ট নাগরিকরা শিখবেন না?
করোনা হানা দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত সংস্থা ও ব্যক্তি নেতিবাচক দিকগুলোকেই বেশি করে সামনে এনেছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিবিসির আকবর হোসেন এক প্রতিবেদনের কথা। তিনি প্রশ্ন তোলেন- ‘বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প টিকে থাকতে পারবে?’ রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। বছরে রফতানির পরিমাণ ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু সামনে কেবলই দুঃসময়।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক ওই সময়েই বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন- ‘কোনো ক্রেতাই এখন প্যান্ট-শার্ট কিনবে না, কিনবে খাবার ও ওষুধ।’ প্রতিদিন টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে খবর থাকত- শত শত কোটি ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে গেছে।
সিপিডি বলেছে- ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২.৫ শতাংশে নেমে যাবে, যা ৩০ বছরে সবচেয়ে কম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য এক লাখ কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ত্রাণ তৎপরতা চলতে থাকে সমানে। ৫০ লাখ অতিদরিদ্র পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে মোবাইল ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রদানের ঘোষণা দেন। ‘রিলিফ চোররা’ এ থেকে ফায়দা লোটার জন্য তৎপর হয়। অনিয়ম-দুর্নীতি জানার সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে অর্থনীতির চাকা যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সে বিষয়টি অনেকটা আড়ালেই থেকে যায়।
বাংলাদেশ যে ঝঞ্ঝা-ঝড়-দুর্বিপাকেও মাথা নোয়াবার নয়- একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সেটা উপলব্ধি আনতে চায় না।
খ্যাতিমান ভারতীয় সাংবাদিক শেখর গুপ্ত আইএমএফ-এর ঝাঁকুনি দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার সময় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০২০) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত স্বাতী নারায়নের এক প্রতিবেদনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ওই সময়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের এক মন্ত্রী বিদ্বেষপ্রসূতভাবে বলেছিলেন- ‘নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে বাংলাদেশের অর্ধেক লোক ভারতে চলে আসবে।’ স্বাতী নারায়ন প্রশ্ন তুলেছিলেন- কেন আসবে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়িতে টয়লেট, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্কুল-কলেজে ছাত্রী ভর্তি, নারী কর্মী, সাক্ষরতার হার- এ সব অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তারা বিনামূল্যে প্রতি বছর চার কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীকে পাঠ্যবই দিচ্ছে। এখন জিডিপিতেও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। শুধু এ বছর নয়, সামনের জন্য যে ভবিষ্যদ্বাণী আইএমএফ-এর সেটাও নরেন্দ্র মোদী সরকারের জন্য সুখকর কিছু নয়। এ সংস্থা বলছে- ২০২৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের জিডিপি সমান হয়ে যাবে, বাংলাদেশ এগিয়ে থাকবে পয়েন্টের ব্যবধানে। আর পরের বছর, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ২৭৫৬ ডলার, ভারতের ২৭২৯ ডলার।
আইএমএফ-এর পূর্বাভাস প্রকাশের পর ভারতের অনেকেই নতুন প্রেক্ষাপটে ‘বাংলাদেশ পলিসি’ নির্ধারণের অনুরোধ করেছেন। আইএমএফ-এর ঝাঁকুনির পর ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চের ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২০’ প্রতিবেদনও ভারতের ক্ষমতাসীনদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। তারা বলেছে, গত বছর ১০৭ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮, এবারে ৭৫-এ উঠে এসেছে। আগের তিন বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০।
রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাজও সকলের পছন্দ হবে না। এ সবের সমালোচনা গণমাধ্যমে হতে পারে, জাতীয় সংসদে হতে পারে। সামাজিক গণমাধ্যমও বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরতে পারে। এতে সরকারের কাজের সুবিধা হয়। ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ হিসেবে নিজেদের যারা মনে করেন, তারাও এ কাজ করতে পারেন। তবে ‘বিশিষ্ট’ হলে বাড়তি দায়ও আসে। কেউ কি এক দশক আগেও ভেবেছিল যে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এতটা ভাল করবে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে জিডিপির হিসাবে বিশ্বের ২৫ তম অর্থনীতির শক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে? মাত্র এক যুগ আগে তোলা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের’ স্লোগান বাস্তবে রূপলাভ করে করোনাকালের বিপর্যয়ের মধ্যে গর্বিতভঙ্গিতে মাথা তুলে রাখতে সহায়তা করবে- সেটাই কে ভেবেছিল?