9498
Published on জানুয়ারি 3, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুসলিম লীগের পাশাপাশি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের বড় ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জে স্কুলে পড়ার সময়েই ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে কলিকাতায় কলেজে পড়তে গিয়ে বৃহত্তর পরিসরে কাজের সুযোগ পান। বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ১৯৪৬ সালে, বয়স যখন মাত্র ২৬ বছর- অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ প্রাদেশিক কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম বিবেচিত হয়েছিল। এ সময়েই ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে তাকে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার (বর্তমানে পাঁচটি জেলা- ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ি) নির্বাচন পরিচালনার সর্বময় দায়িত্ব দিয়ে কলিকাতা থেকে তাকে পাঠানো হয়। ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলকে পাকিস্তানে অন্তুর্ভুক্ত করার জন্য যে গণভোট আয়োজন হয়েছিল- সেখানেও তিনি গিয়েছিলেন প্রায় পাঁচশ’ ছাত্রের প্রচার কর্মীর দলনেতা হিসেবে।
অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে চার মাস যেতে না যেতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। কেন এমন দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? কলিকাতায় ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগে সক্রিয় থাকার সময় তিনি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির। তাঁর কাছে সর্ববিষয়ে পরামর্শ পেতেন, সংগঠন কীভাবে করতে হয় সেটা শিখতেন অনেকটা হাতেকলমে। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা আসতে পারেননি। তাকে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ বাধা দেয়। এমনকি শির কতল করার হুমকি দেওয়া হয়। অন্যদিকে, তরুণ শেখ মুজিব বুঝে যান তাকে এখন একাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তখন পূর্ব বাংলাকে পদানত রাখার অভিলাষ পোষণ করছে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ। তারা কলিকাতা পাকিস্তানের অংশ হোক, সেটা চায়নি। করাচিকে রাজধানী ঘোষণা করে। মন্ত্রীসভা, প্রশাসন, সেনাবাহিনী- সব কিছু পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক একটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উপেক্ষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য তাদেরই একচেটিয়া।
তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার এ বঞ্চণা মেনে নিতে পারেননি। সেই তরুণ বয়সেই বুঝে যান, কেবল বিবৃতি বা সভা-মিছিলে দাবি আদায় হবে না। সফল হতে চাই উপযুক্ত সংগঠন। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ তখন পশ্চিম পকিস্তানি শাসকচক্রের অনুগামী একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। তিনি নিজেই বার বার বলেছেন- এরা হচ্ছে ‘খানবাহাদুর-নবাব’ গোষ্ঠীর লোক- সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-স্বার্থ তারা বোঝে না। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবির ঘোর বিরোধী তারা। বঙ্গবন্ধুর বুঝতে সমস্যা হয়নি যে পাকিস্তানের প্রতি ছাত্রদেরই প্রথম মোহভঙ্গ হতে শুরু করেছে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নামের নতুন সংগঠন গড়ে তোলার এটাই ছিল পটভূমি। সংগঠনটি গঠিত হয় ফজলুল হক মুসলিম হলে। ১৯৪৪ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ ছাত্রলীগের যে কমিটি গঠন করা হয়, তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান ( ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী)। তিনি কেবল সংগঠনের নাম বদল করেন - নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। পাকিস্তান হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন ছাত্ররা ঢাকায় আসতে শুরু করেছে। তাদের কাউকে এ সংগঠনের কমিটিতে রাখা হয়নি। তারা সংগঠনকে কোটারি করে রাখতে চাইছে।
বঙ্গবন্ধু উদ্যোগী হয়ে ৪ জানুয়ারি যে সভা ডাকেন তাতে অংশ নিতে জেলায় জেলায় খবর পাঠান। সম্মেলনের দিন বিপুল সংখ্যক ছাত্র উপস্থিত হয়। কেউ কেউ ছাত্র সংগঠনকে শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক ঘোষণার প্রস্তাব করেন। নামের সঙ্গে মুসলিম রাখায় আপত্তি তোলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন- এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে। পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম ছাত্র সংখ্যা বাড়ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ছাত্রদের অনেক দাবি আছে। আমাদের কর্মসূচিতে এ সব থাকতে হবে।
সবাই তার যুক্তি মেনে নেয়। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার অধিকার হবে বড় ইস্যু। ডাক টিকিট ছাপা হয়েছে উর্দুতে। চাকরির পরীক্ষা উর্দুতে। এটা মানা যায় না। ১৩ ডিসেম্বর (১৯৪৭) সরকারি কর্মচারীরা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ধর্মঘট করেছে। সম্মেলনে তাকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি বলেন, আমি থাকব আপনাদের সঙ্গে। তবে কমিটিতে প্রধান নেতা অন্য কাউকে ঠিক করবেন। আমি অনেক দিন ছাত্র আন্দোলন করেছি। এখন নতুন কিছু করব ভাবছি।
সম্মেলন ভণ্ডুল করার জন্য মুসলিম লীগ সরকার একদল সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের বিপুল সংখ্যক কর্মীর ভয়ে তারা পালিয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের সংগঠনের নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আহ্বায়ক হবেন নইমউদ্দিন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে নতুন ইতিহাস রচিত হলো। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এই ইতিহাসের কাণ্ডারি। একদিন এ সংগঠনের জয় জয়কার হবে।
১৫০ মোগালটুলীতেই আপাতত কেন্দ্রীয় অফিস চালু থাকে। এ অফিসে মুসলিম লীগ ও ন্যাশনাল গার্ডের সাইনবোর্ডের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাইন বোর্ড লাগানো হয়।
ছাত্রলীগের প্রথম সভাতেই জেলায় জেলায় ছাত্রলীগ কমিটি গঠনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আহ্বায়ক নইমউদ্দিন বলেন- মুজিব ভাই, আমি যে কয়টায় পারি, যাব। কিন্তু সব জেলা ও মহকুমায় আপনাকে যেতেই হবে। নইলে কমিটি করা যাবে না। আপনাকে সবাই কতটা মানে, সেটা ফজলুল হক হলের কনফারেন্সে প্রমাণ হয়ে গেছে। আপনি না করতে পারবেন না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল। এক মাসের মধ্যে আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।’ [পৃষ্ঠা ৮৯]
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দুই মাস যেতে না যেতেই প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ হরতাল সফল করার। বঙ্গবন্ধু অনেক জেলা সফর করেন। এই সুযোগে ছাত্রলীগের সংগঠন গুছানোর জন্য সচেষ্ট হতে অনুরোধ করে বলেন- যে সব নতুন ছাত্রছাত্রী আন্দোলনে আসবে, তাদের সংগঠনে আনতে হবে। কমিটিতেও স্থান দিতে হবে। আন্দোলনে ছাত্রীরাও এগিয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল স্কুল- এ সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নামার জন্য প্রস্তুত। তাদের সংগঠিতভাবে হরতাল সফল করার কাজে লাগাতে হবে। ১১ মার্চের কয়েকদিন আগে তিনি খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলা সফরের এক ফাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও সাড় পাঁচ বয়সী কন্যা হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যান। স্ত্রীকে বলেন- জিন্নাহ সাহেব, নাজিমুদ্দিন সাহেব আমাদের উর্দু শেখাতে চান। তোমার মেয়ে স্কুলে গেলে বাংলা পড়বে না, উর্দুতে পড়তে হবে। মানতে পারবা? উত্তরে বেগম মুজিব বলেন- আসুক না কেউ উর্দু পড়াতে, ঝাটা পেটা করব। বাংলা ভাষার মান রাখার জন্য যা কিছু কর, আপত্তি নাই।
গোয়েন্দা সূত্র ( সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম খণ্ড) থেকে আমরা জানতে পারি, ১১ মার্চের হরতাল সফল করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শিরোনামে যে লিফলেট বিলি করেছে সেটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এই লিফলেট স্কুল-কলেজে-দোকানে বিলি হয়।
১১ মার্চ ঢাকার রাজপথে হরতাল সফল করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু পিকেটিংয়ে নামেন শত শত ছাত্রের সঙ্গে। পুলিশের লাঠিচার্যে আহত এক ছাত্রকে তিনি রিকশায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আবার পিকেটিংয়ে বসে পড়েন। কিছু সময় পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। আরও অনেক ছাত্রছাত্রীকে আটক করে নেওয়া হয় কারাগারে।
পাকিস্তানে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জেল। তবে এই সফল হরতালের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ছিল পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর গভর্নর জেনারেল হিসেবে প্রথম সফর। এ কারণে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকার আপস করতে চায়। তারা ৮-দফা আপস প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে সেটা পাঠায় কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। বলা হয়, তিনি সম্মতি দিলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালাবে এবং আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেবে। এই চুক্তি তিনি অনুমোদন করেন। ১৫ মার্চ মুক্ত হয়ে তিনি পরদিন আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের পেছনের দিকে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন ছিল। তার সামনে ছিল আমতলা, ছাত্রদের সভা করার ঐতিহাসিক স্থান) অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল।’ [পৃষ্ঠা ৯৬]
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েকটি মাস বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগ সরকারের অপমকর্মের প্রতিবাদ করার জন্য একটি বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনের কাজেও মনোযোগী হন। পাশাপাশি সক্রিয় থাকেন ছাত্রলীগের কাজে। ১৯৪৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তারা বেতন-ভাতা বাড়ানোর আন্দোলন করছিল। এই দাবি ছাত্রলীগ সমর্থন করে। ১৯ এপ্রিল কর্মচারীদের আন্দোলনের সমর্থনে একদল ছাত্র নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান ধর্মঘট পালনকালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় পাকিস্তানে দ্বিতীয় জেল জীবন। এর আগে কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করার অভিযোগে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। আরও কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধেও ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ৯ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী (১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পিতা) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের পক্ষ থেকে তাকে প্রস্তাব দেন- ক্ষমা চাইলে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। সময়টি তাঁর জন্য সহজ ছিল না। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক নাইমুদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে মুচলেকা দিয়ে আপস প্রস্তাব মেনে ছাত্রত্ব ফিরে পান। আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাও এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করেন।
বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু, বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রতিনিয়ত জীবনের পাঠ গ্রহণ করেছেন। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিস্কার করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারিতে প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন গড়ে তোলে তাকে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে আনে এবং তাকে বরণ করে নেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। এর দুই বছর পর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় তাঁর আহ্বানে ডাকসু নেতৃত্ব উত্তোলন করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালী রংয়ের ‘জাতীয় পতাকা’, ১৭ এপ্রিল ‘মুজিব নগরে’ বাংলাদেশ সরকার যাকে অভিবাদন জানিয়ে আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকতেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে- ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা। তাকে নির্বাচিত করা হয় যুগ্মসম্পাদক হিসেবে। তিনি রাজনৈতিক দলেই কাজ করবেন, এ সিদ্ধান্ত জেল থেকেই দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। দুই মাসের বেশি বন্দিজীবন কাটিয়ে ২৬ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। তাকে কারাগারের গেটে অভ্যর্থনা জানাতে সভাপতি মওলানা ভাসানীসহ বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এ ঘটনাকে ‘আওয়ামী লীগের যুবরাজের আনুষ্ঠানিক অভিষেক’ হিসেবে অভিহিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধু জেলায়-মহকুমায় আওয়ামী লীগ গঠনে মনেযোগী হন। একইসঙ্গে প্রতিটি স্থানে তিনি ছাত্রলীগ গড়ে তোলার কাজেও অংশ নিতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যার সমাধান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে শুরু হয় ছাত্রলীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলন। সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র নাই। ছাত্র প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নাই। ছাত্রলীগ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বড় সংগঠন হয়ে গেছে।
সম্মেলন কক্ষেও নানা প্রান্তে শ্র্রোতাদের মধ্য থেকে তাকে সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলার লোক কোনো দিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, মানুষ ভুলবে না। আরবী হরফে বাংলা লেখার চক্রান্ত চলছে। আপনারা রুখে দাঁড়ান। আপনারাই এ দেশে বিরোধী দল সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, আপনারা সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করে চলেছেন। আপনারা আমাকে প্রতিষ্ঠাতার সম্মান দিয়েছেন। আপনারা যখনই ডাকবেন, আমাকে পাবেন। তবে এখন থেকে আমি বেশি সময় দেব আওয়ামী মুসলিম লীগে। বিদায় বেলা আপনাদের বলি- ছাত্রলীগ নেতাদের ভাল ছাত্র হতে হবে। তবে কেবল পাঠ্যবই পড়লে চলবে না। আপনারা পাঠাগার গড়ে তুলবেন। স্টাডি সার্কেল করুন।
সম্মেলনে কারাগারে বন্দি দবিরুল ইসলামকে সভাপতি এবং খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয় মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ছাত্ররা জেগে উঠেছে। ছাত্রলীগ সফল সম্মেলন করেছে। সম্মেলনে দাবি তোলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং চালুর জন্য। প্রাপ্ত বয়স্কদের এ ট্রেনিং দিতে হবে, দেশকে রক্ষার জন্য তাদের হাতে অস্ত্র দিতে হবে। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষার জন্য পাঞ্জাবি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। এখানের নদী-খাল-বিলে তারা কী করবে? আমাদের মাটি আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।
[বঙ্গবন্ধু কত দূরদর্শী ছিলেন! পাকিস্তানের পাঞ্জাবী সৈন্যরা ১৯৭১ সালে বুঝেছিল এটা। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার কাছে তারা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল]
তিনি বলেন, পাকিস্তানে মাত্র ৫ শতাংশ লোক লেখাপড়া জানে। এ অবস্থায় ছাত্রদের রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই। অন্যথায় জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যাবে না। নির্যাতন আসবে, সেটা উপেক্ষা করে ছাত্রদের এগিয়ে যেতে হবে। ছাত্র আন্দোলন করার জন্য বৃত্তি কেটে নেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো দমননীতি তোমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
মওলানা ভাসানী বলেন- ছাত্র বন্ধুরা, মজিবরকে তোমাদের কাছ থেকে আমি নিয়ে নিলাম। জানি, তোমরা কষ্ট পেয়েছ। কিন্তু জালেম মুসলিম লীগকে সরাতে হলে আওয়ামী লীগকে গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে আমার আতাউর রহমান, সালাম খান, শামসুল হক আছে। কিন্তু মজিবরের মতো উপযুক্ত যুবক ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না।
বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত এই ছাত্রলীগই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য বাকশাল-এর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে গঠন করেছিলেন জাতীয় ছাত্রলীগ। ১৫ আগস্ট তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন এনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাতের অপচেষ্টা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অনন্য সাধারণ নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছেন একাত্তরের ধারায়। ছাত্র সমাজের সামনে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ- উন্নত-সমৃদ্ধ-গর্বিত বাংলাদেশ নির্মাণ। পাঁচ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী এখন বাংলাদেশে। তাদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে ছাত্রলীগ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথাযোগ্য অবদান রাখবে, সে ভরসা নিশ্চয়ই করতে পারি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।