উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাঃ অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা ও কিছু প্রস্তাবনা

1604

Published on ডিসেম্বর 26, 2020
  • Details Image

সজল চৌধুরী

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি একটি উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সোনার বাংলা গড়তে তিনি বলতেন ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সে মানুষগুলো হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, আধুনিক এবং স্বাবলম্বী। তাই তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ৭২ এর সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধান প্রণীত হয়। তিনি গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের সকল স্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য ‘সোনার বাংলা’ গঠনকল্পে অবিরাম ছুটে চলেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যেখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে সব বিষয়ের আধুনিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে অচিরেই। সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা এবং সেই প্রয়োজন পূরণ করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কথা - যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কিছু ভাবনার প্রয়াস যেখানে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন।

বর্তমানে বাংলাদেশে সময়ের সাথে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের পথ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুত গতিতে বেড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই উচ্চশিক্ষা বিস্তারে অন্ততপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর কথা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলে আসছেন যা অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ও আশাব্যঞ্জক। পৃথিবীর আর অন্য কোন দেশে উচ্চশিক্ষার এমন প্রসার সহজেই চোখে পরে না। যার জন্য আমরা সবসময় গর্বিত। তবে একটি বিষয় আমাদের একটু খেয়াল করতে হবে উচ্চশিক্ষিতদের পরিমাণ দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভবিষ্যতে যদি সঠিক কর্মপন্থা না থাকে তাহলে এই বিপুল পরিমান উচ্চশিক্ষিত আদৌ সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে কিনা? কিংবা এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে উচ্চশিক্ষিত সমাজকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায় যা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। তাছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে আমরা আরো বিশদভাবে ভাবতে পারি। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য প্রতিবছর সরকারি তহবিল থেকে বড় একটি বাজেট ব্যয় করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমরা কি পারিনা আমাদের চিন্তা ভাবনা এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে আর একটু পরিবর্তন করতে ‘বঙ্গবন্ধুর’ সোনার বাংলা গঠনকল্পে? তবে একথা বলে রাখা ভাল বর্তমানে দেশের যুব সম্প্রদায়কে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে কর্মতৎপরতা তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।

যেমন ধরা যাক নতুন একটি শিক্ষা পদ্ধতির কথা যার নাম ‘কো-অপারেটিভ’ শিক্ষাপদ্ধতি যা এমন একটি ধারণা যেখানে ছাত্রছাত্রীরা সমসাময়িক বিষয়ের ওপর ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করে স্বশিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের ডিগ্রি প্রদান না করে এর বাইরে যে কাজটি করে থাকে যার মাধ্যমে দেশ এবং সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। যা হয়তো বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আমাদের বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ হতে পারে। বিষয়টিকে আরেকটু খোলাসা ভাবে বলা যাক। যেমন এই পদ্ধতি এমন একটি শিক্ষা পদ্ধতি যেখানে মেধা যাচাইয়ের মাধ্যমে কোনো ছাত্রছাত্রী একবার ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেই পুরো শিক্ষা বছর আর কোন ব্যয়ভার তাকে বহন করতে হবে না। কারণ সেই ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষা জীবনে যে সকল প্রকল্প কিংবা গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে সেই সকল প্রকল্প এবং গবেষণাগুলো হবে দেশের আর্থসামাজিক পাবলিক-প্রাইভেট অবকাঠামোর সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এবং বাণিজ্যিকভাবে প্রকল্প গুলো বাজারে স্থান পাবে। সেখান থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন তার ব্যয়ভার বহন করতে পারবে অনেকাংশে, অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করতে পারবে। যার মাধ্যমে সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যয় ভার অনেকাংশেই কমবে। এমনকি ছাত্রছাত্রীরা উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে পারবে। এ যেন একই সাথে চাকরি করা এবং পড়াশোনা করা।

যেমন প্রথমে ধরা যাক ‘হস্তশিল্প’ কিংবা ‘প্রোডাক্ট ডিজাইন’ নামে একটি বিভাগের কথা। যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে চার বছর মেয়াদি হাতে-কলমে শিক্ষা প্রদান করা হবে। বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ছাত্র-ছাত্রীদের প্রদান করা হবে নির্দিষ্ট সিলেবাস অনুযায়ী। যে সিলেবাস অবশ্যই স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী বাজারমুখী হবে। অর্থাৎ বাজারে তার প্রয়োজনীয়তা থাকবে। কিংবা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রকল্পগুলো বিবেচিত হবে। যার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও চাহিদার বিষয়টি। অন্যভাবে বলা যায়, এমন হতে পারে আমাদের দেশের বিভিন্ন কর্পোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের চাহিদা ভিত্তিক সরাসরি চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। যেখানে নতুন নতুন গবেষণা এবং বাজারমুখী চাহিদা চার বছর মেয়াদি শিক্ষার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদি না হয়ে তিন বছর মেয়াদী ও হতে পারে। যা গবেষণা - আলোচনা সাপেক্ষ।

এমনকি এই বিভাগ গুলোর মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আবার নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারি এবং বাজারের চাহিদা তৈরি করতে পারি। সে ক্ষেত্রে নতুন রুপরেখা প্রনিত হতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে এ ধরনের গবেষণার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা যেমন উক্ত বিষয়টিকে সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে যোগসুত্র করতে পারে, ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে নিজেদের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। সেই সাথে শিক্ষাজীবনে বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে সেই অর্থ দিয়ে পরিবারকেউ সাহায্য করতে পারে। এতো গেল শুধুমাত্র ‘হস্তশিল্প’ কিংবা ‘প্রোডাক্ট ডিজাইন’ বিষয়টির চিত্র। এভাবে চারু কারু শিল্প, স্থাপত্য শিল্প , নগর অঞ্চল পরিকল্পনা, দূর্যোগ মোকাবেলা, রিনিওয়েবল এনার্জি, অভিজ্ঞতা বিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা সহ অনেক বিষয়কে নিয়ে চিন্তা করা সম্ভব - যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বরাদ্দকৃত প্রকল্প গবেষনাকল্পে সরাসরি সরকার সহ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের পাশে এসে দাড়াতে সক্ষম হবে এবং শিক্ষা ব্যায় উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্মতৎপরতার ভিত্তিতে গঠন করবে। এ আশা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে মোটেও অবাস্তব নয়। কারণ আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিককে ভাবতে হবে যার যার অবস্থান থেকে আমরা কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

এবার আসা যাক কেন এমন ধারণা? বর্তমানে আমাদের দেশে যে পরিমাণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়েছে যেখানে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে হয় সেগুলো পরিচালনার জন্য। কারণ পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ছাত্রছাত্রীকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়। যেখানে বাংলাদেশে নামমাত্র মূল্যে একজন ছাত্র-ছাত্রী সহজেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। শুধুমাত্র সেই দিক থেকে বিবেচনা করলেও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অফ এডুকেশন’ বলতেই হবে তার সুচিন্তিত বিশদ শিক্ষা কর্মপরিকল্পনার জন্য। সেই অর্থে বর্তমানে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতিতে কতটুকু সাহায্য করছে কিংবা সাহায্য করার সক্ষমতা রয়েছে তা আলোচনা সাপেক্ষ। অথচ আমাদের দেশে অনেকেই কিন্তু বহির্বিশ্বে নিজেদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। গ্রাম গঞ্জে লুকিয়ে রয়েছে অনেক প্রতিভা। অনেক উদ্যোক্তা।

বর্তমানে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলার/অনার্স শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত যার সাথে আসলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবকাঠামো সম্পৃক্ত নয়। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে সরাসরি চিন্তা করতে হয় না দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে। আর সে কারণেই বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনে খুব বেশি পরিমাণ সাহায্য করতে পারছে না। যার দরুন বহু বছর মেয়াদী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে একজন ছাত্র ছাত্রী যখন চাকরি খোঁজে এবং চরম বাস্তবতার শিকার হয় চাকরি নাই বলে তখন তার দায়ভার নিতে হয় দেশকে।

এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা বাস্তব সম্পন্ন এবং গ্রহণযোগ্যতা পরিসর কতটুকু? সেগুলো অবশ্যই ভবিষ্যতে খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সামগ্রিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে সে বিষয়ে অবশ্যই ভবিষ্যৎ গবেষণার প্রয়োজন আছে। আমরা বিভিন্ন উন্নত দেশের কিছু চিত্র তুলে ধরতে পারি যারা বাস্তবসম্মত এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করে বেশকিছু সফলতা অর্জন করেছে। যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে গ্রেট ব্রিটেনে রবার্ট ওয়েন কো-অপারেটিভ শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেন বস্ত্রশিল্পে কর্মরত জনগোষ্ঠীর জন্য। বর্তমানে ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্লোরেডিয়া স্কুল অব টেকনোলজি, জর্জিয়া স্কুল অব টেকনোলজি, রোচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি সহ বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে যা সমাজের জন্য সফলতা বয়ে এনেছে।

সবশেষে বলতে চাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু বিশেষ কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এর কথা। যেখানে দেশের প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের উপরে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা গ্রহণ করবে। আর বর্তমান বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে আমরা কি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আরেকটু ভাবতে পারিনা দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে?

লেখকঃ শিক্ষক ও স্থাপত্য-পরিবেশ বিষয়ক গবেষক, বর্তমানে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত