3425
Published on ডিসেম্বর 20, 2020একাত্তরে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল বাঙালি জাতি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর দুই যুগ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে শোষিত হতে হয়েছিল এই জাতিকে। তাদের শাসনামলে প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়েছে বাংলাদেশকে, যা তখন পরিচিত ছিল পূর্ব-পাকিস্তান হিসেবে। এই ভূখণ্ডের কৃষক-শ্রমিক-মজদুরসহ সবার শ্রমের যে ফসল, তার আর্থিক সুবিধা তখন শোষণ করে ভোগ করত পশ্চিম পাকিস্তানিরা। আর সে কারণেই ওই সময়েও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও একাত্তরে স্বাধীনতার সময় দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর এসে সেই দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পরের প্রায় পাঁচ দশক সময়ে দেশে দারিদ্র্য কমেছে ৬০ শতাংশেরও বেশি।
দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের এই সাফল্যকে অনুকরণীয় ও প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করে আসছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল— এমন আখ্যাও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তবে এই পরিস্থিতির আরও উত্তরণ ঘটাতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনের গতি আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে যাদের অবস্থান, তাদের আয়ের বিষয়টি স্থিতিশীল ও টেকসই হওয়া জরুরি। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনের দিনে দারিদ্র্য বিমোচনের এই ক্ষেত্রটিই বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১৯৭১ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরো কিংবা অর্থনীতিবিদদের কেউেই ১৯৭১ সালের দারিদ্র্যের হারের প্রকৃত তথ্য জানাতে পারেননি। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদই বলছেন, স্বাধীনতা কিংবা এর পরবর্তী সময়ে দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। কারও কারও মতে এই সংখ্যাটি ৭০ শতাংশের কিছু বেশি। তবে বর্তমানে জাতীয়ভাবে যেমন দারিদ্র্যের হারের তথ্য প্রকাশ করা হয়, ওই সময় সেটি করা হতো না। তখন গ্রামাঞ্চল ও শহর এলাকার দারিদ্র্য নিয়ে আলাদাভাবে তথ্য প্রকাশ করা হতো।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ১৯৭৪ সালের ৮২ শতাংশ থেকে ১৯৮২ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। ১৯৯২ সালে তা ছিল ৫৮ শতাংশ। আর ১৯৯৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫১ শতাংশ। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। তথ্য বলছে, স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৬০ শতাংশেরও বেশি।
তথ্য আরও বলছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ ছিল বাংলাদেশ। অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে ২০১৬ সালের দিকে বাংলাদেশ ৬৪ নম্বরে অবস্থান করছিল। পরের বছরগুলোতেও অবস্থার আরও উন্নতি ঘটেছে। বাংলাদেশের এই অগ্রগতি অন্য দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি গেল কয়েক বছর আগে জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে সংশয়বাদীদের ভুল প্রমাণ করে এসেছে। ১৯৭৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দুই কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে।
এদিকে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর, তথা সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি থাকলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েও আশার কথা শুনিয়ে আসছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকরা।
এছাড়া, দেশে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ডলারের বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। এর আগের অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিবদরা বলছেন, ভঙ্গুর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। বেড়েছে দেশজ উৎপাদন। পোশাক ও শিল্পখাতে বেড়েছে কর্মসংস্থান। কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে কৃষি, মৎস্য ও গ্রামীণ অর্থনীতিতেও। আর অর্থনীতির নানা সূচকই দীর্ঘ সময় ধরে ছিল ইতিবাচক। একইসঙ্গে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও ছিল অব্যাহত। সমন্বিত এসব প্রভাবে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ঈর্ষণীয়ভাবে।
মন্তব্য জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার সময়ে দেশে দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশের ওপরে ছিল। তখন অর্থনীতি ভঙ্গুর ছিল, রাস্তাঘাট ছিল না, শিল্প কারখানা বন্ধ ছিল। সেই দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক অনেক উন্নতি করেছে। শুধু আমরা নই, বাইরের লোকজনও বলছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘দেশে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটেছে, গড় আয়ু বেড়েছে। অর্জন অনেক হয়েছে, আবার অনেক পথ বাকি আছে। দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। সরকারিভাবেও সেটা স্বীকৃত। সরকারে পক্ষ থেকে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান তেমন উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। আবার করোনাভাইরাসের প্রভাবে দারিদ্র্যও কিছুটা বেড়েছে। সেটা কতটা বেড়েছে, এখনো তা নিয়ে মাপজোখ চলছে। আবার যারা দারিদ্র্য রেখার কিছুটা ওপরে রয়েছে, তাদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। স্বল্প আয়ের বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে রয়েছে। যেকোনো সময় তাদের দরিদ্র হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সেটি একটি চ্যালেঞ্জ।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ প্রসংশনীয় ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার সময়ে দেশে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। সেটা এখন ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনার কারণে এখন আবার কিছু লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে। দারিদ্র্যের বিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষাপট কিছুটা উদ্বেগজনক। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে।’
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গত পাঁচ দশকে দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। তবে প্রথম ৩০ বছরে এই হার তেমন কমেনি। গত ২০ বছরে দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে দারিদ্র্য কমেছে। বিশেষ করে দারিদ্র্য দ্রুত কমেছে গত ১৫ বছরে। এটি চমৎকার একটি অর্জন।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য কমেছে। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এর প্রধান উপাদান। প্রবৃদ্ধি যত বাড়ছে, দারিদ্র্য ততই কমছে। এটি সব দেশের ক্ষেত্রেই হয়। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি রয়েছে। এটি কিন্তু এককভাবে দারিদ্র্য কমায় না। এটি কেবল দরিদ্র মানুষদের সহায় হওয়ার একটি উপাদান। আগামী দিনগুলোতে দারিদ্র্যের হারের বিষয়টি নির্ভর করবে দেশে বিনিয়োগ কতটা বাড়াতে পারব এবং প্রবৃদ্ধি কতটা বাড়বে, তার ওপর।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই সাফল্য এসেছে। এটি নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের প্রয়োজন মেটানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে পেরেছি, এটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কৃষির উৎপাদন বেড়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেছে। শিল্প খাত ও পোশাক খাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কৃষি নির্ভরতা কমাতে পেরেছি। কৃষিতে আয় বাড়ানোর সুযোগ খুব একটা নেই। কিন্তু কৃষি যেভাবে উন্নয়ন করেছে, সেটাও বিস্ময়কর। এমন নানা কারণে দেশে দারিদ্র্য কমেছে।’
তিনি বলেন, গত এক দশক ধরে আবার দারিদ্র্য বিমোচনের গতিটা কমে গেছে। দারিদ্র্য কমার সঙ্গে সঙ্গে তা কমানোর গতিটা বাড়লে দ্রুত উন্নয়ন ঘটত। সেটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ দারিদ্র্য কমার সঙ্গে সঙ্গে এই কমানোর গতিটা বাড়াতে হবে।
মন্তব্য জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীনতার সময় থেকে প্রথম ৩০ বছরে শতকরা ৩০ পয়েন্ট দারিদ্র্য কমেছে। পরবর্তী ২০ বছরে আরও ২০ পয়েন্ট কমেছে। ২০০০ সালের পর থেকে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি গুণগত মানের দিক থেকে উন্নত হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্য রেখার ওপরে উঠেছে।
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে দারিদ্র্য বিমোচন আশাব্যঞ্জক। তবে এ সময়ে দেশে ধনী হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আয় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। আর দারিদ্র্যসীমা পার করেছে— এমন মানুষের আয় খুব একটা বাড়েনি। তারা দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছেন, কিন্তু শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। সামনের দিনে তাদের শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোটাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’
সূত্রঃ সারাবাংলা