1926
Published on ডিসেম্বর 14, 2020জাহিদ রেজা নুরঃ
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস- এ কথা বললে আসলে ঠিক কী বোঝা যায়? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ১০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন যে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করা হয়েছিল, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলার আপামর জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর মোহভঙ্গ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাদের। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি তাদের জাতীয়তাবোধে দীক্ষিত হতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরাও খুব অল্প সময়ের মধ্যে শোষকে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলো চলতে থাকে। এই পথেই আসে ৬ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ।
কথাগুলো বলছি নতুন পাঠকের জন্য। এই বিভ্রান্ত সময়ে নিজেদের ইতিহাস একটু ঝালিয়ে নেওয়া এখন আমাদের কর্তব্য। একাত্তরের গণহত্যা এবং তার পরিণতির সত্যিকার বিশ্লেষণ এখন অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।
শকুনের রাজত্ব: হায়েনা আমাদের দেশে নেই, শকুন আছে। সেই শকুনের দল একদা আমাদের আকাশের দখল নিয়েছিল। আকাশের অনেক ওপর থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিয়ে তারা ঠিকই খুঁজে নিত লাশ। গ্রামে-শহরে-বন্দরে, চাষের জমিতে, জলাভূমিতে, পরিত্যক্ত কারখানায় ছড়িয়ে থাকত লাশ। এরা ঠোকর দিত লাশের চোখে, মুখে, শরীরে। একটি লাশ মুহূর্তের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত হতো। হাড়ের ওপর হয়তো মাংসের কিছুটা আভাস থাকত অথবা থাকত না। তার পর দলবেঁধে সেই শকুন যেত নতুন লাশের সন্ধানে। তাদের সঙ্গে যোগ দিত কুকুরের দল। তারাও টানাটানি করত লাশগুলোর শরীর। সেই দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দি করেছেন অনেকে। অনেকের রুদ্ধবাক হৃদয়ে তা টেনে এনেছে মরুভূমির হাহাকার।
১৯৭১ সালের নয় মাস মানুষকে লাশে পরিণত করতে তৎপর ছিল পাকিস্তানি সেনারা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আলবদর, রাজাকাররা। এই আলবদর এবং রাজাকাররা এই দেশেরই সন্তান। তারা নিজেদের বদমায়েশি জায়েজ করতে চেয়েছে ইসলামের নামে। ধর্ম যখন ব্যবসা হয়ে ওঠে, তখন এভাবেই ধর্মের দোহাই দিয়ে অনাচার করে সুযোগসন্ধানীরা। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে মীরজাফরের মতোই এরা ঘৃণ্য।
গণহত্যার পটভূমি: ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- সম্পর্কে বলার আগে তাই যুদ্ধের নয় মাসের সময়টা একটু ঘুরে আসা দরকার। মার্চ মাস থেকে ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের নামে মূলত সময়ক্ষেপণ করছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈনিকভর্তি বিমান আসছে ঢাকায়। ২৫ মার্চ যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল ঢাকায় এবং সারা বাংলায়, তার নাম পরে জানা গিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ঢাকায় খুনের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আর দেশের অন্যান্য অঞ্চলকে লাশের সারি উপহার দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন আরেক মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা।
ঢাকা শহরের সেই প্রচণ্ড গোলাগুলি, আগুন, কামান দাগার সাক্ষী আমরা। সে রাতে পাঁচ বছরের আমার ঘুম ভেঙেছিল অকস্মাৎ। আমাকে কেউ একজন পাঁজাকোলা করে ঘর থেকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। চোখ খুলেই আমার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল আয়নার দিকে। আয়নায় প্রতিফলিত দাউ দাউ আগুনই আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতি। এই প্রতিফলিত আগুনের উৎসভূমি ছিল অদূরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন। সে রাতে পুলিশ লাইন ছাড়াও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পিলখানা, নয়াবাজার, ঠাটারিবাজার, লক্ষ্মীবাজারসহ পুরান ঢাকার বহু এলাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এ আর খান খাদিম, মনিরুজ্জামান, মুহাম্মদ মুক্তাদির, ফজলুর রহমান, শরাফত আলীকে হত্যা করল এই শ্বাপদের দল। হত্যা করল মধুর ক্যান্টিনের সবার পরিচিত মধুদাকে। এর পর ধ্বংস করা হলো তিনটি পত্রিকা অফিস। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দ্য পিপল। দৈনিক সংবাদেই পুড়ে মারা গেলেন শহীদ সাবের। অগণিত ছাত্র শহীদ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। অগণিত জনতা শহীদ হলো সারা ঢাকা শহরে, বাংলাদেশের নানা এলাকায়। শহীদ হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদাপ্রসাদ সাহা।
ওরা চেয়েছিল, অপারেশন সার্চলাইটের হত্যাযজ্ঞের কারণে ভয় পেয়ে যাবে বাঙালি, তারা মেনে নেমে পশ্চিমাদের আনুগত্য। কিন্তু ইতিহাস তখন ভিন্ন কিছু নিয়ে তৈরি হচ্ছে। পৃথিবী নতুন ইতিহাস দেখার জন্য তৈরি হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবিবুর রহমান, মীর আবদুল কাইয়ুম এবং সুখরঞ্জন সমাদ্দার।
সে সময়ের পাকিস্তানি মন: পাকিস্তানিদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে একটি তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাদের খুন করবে, তার যে ছকটা করেছিল ওরা, তাতে প্রথমেই ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, এর পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং তার পর ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ। অর্থাৎ জেনোসাইড বা গণহত্যা বলতে যা বোঝায়, তার ষোলো কলা পূর্ণ করেছিল তারা। কারণ সে সময় কিছু দালাল ছাড়া দেশজুড়ে সবাই সমর্থন দিচ্ছিল আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাই হত্যা করার জন্য বাছাবাছির প্রয়োজন হয়নি। ইচ্ছে করলেই যে কাউকেই খুন করা যেত।
পাকিস্তানি হানাদাররা মার্চ-এপ্রিলের দিকে কিছু কিছু প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু প্রবল আক্রমণের কারণে বাঙালিদের প্রতিরোধ টেকেনি। যে কটি এলাকা মুক্তাঞ্চল বলে ঘোষিত হয়েছিল, সেগুলোও একে একে হাতছাড়া হয়ে গেল জুনের মধ্যেই। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ নামে পরিকল্পনা করল। তখন মুক্তিযোদ্ধারা আসছে ফিরে, গেরিলা আক্রমণে বিপর্যস্ত করে তুলছে পাকিস্তানিদের। তাই নিজেদের ভয় তাড়ানোর জন্যই আরও বেশি মানুষ হত্যা করতে শুরু করল তারা।
এরই মধ্যে পাকিস্তানিরা বাঙালি বিশ্বাসঘাতকদের বেছে নিয়ে গড়ে তুলেছে রাজাকার, আলবদর বাহিনী। রাজাকাররা ছিল অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত দালাল। কিন্তু আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল শিক্ষিত যুবকদের দিয়ে। এরা মূলত ছিল জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত ছাত্রদের সংগঠন ছাত্র সংঘের সদস্য। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ ছিল এদের মূল পাণ্ডা। চৌধুরী মঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামানদের দিয়ে এরা নিধনযজ্ঞ চালাত। এরাই ছিল রাও ফরমান আলীদের ভরসাস্থল।
বেছে বেছে হত্যা: এলোপাতাড়ি হত্যাকাণ্ড তো চলছিলই। মনে রাখা খুব দরকার, এটা মোটেই যুদ্ধের মাঠে সৈন্যদের গুলির আঘাতে পরস্পর মৃত্যু নয়। পাকিস্তানিরা এবং তাদের দালালরা নির্বিচারে সাধারণ মানুষদের হত্যা করেছে। সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করা যুদ্ধের রীতিনীতির বাইরের ব্যাপার। একে বলে গণহত্যা।
গণহত্যার পাশাপাশি এরই মধ্যে বেছে বেছে মানুষ হত্যাও শুরু হলো। যারা শিক্ষিত, মানুষের কথা ভাবেন, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, তাদেরও হত্যা করা শুরু হলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পাশাপাশি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডা. আজহারুল হক ও ডা. এবিএম হুমায়ূন কবীরকে ওরা ধরে নিয়ে গেল ১৫ নভেম্বর। নটর ডেম কলেজের উল্টোদিকে এক ডোবায় পরদিন মিলল গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তাদের লাশ।
ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ড: মুক্তিযোদ্ধাদের ঝটিকা আক্রমণে এরই মধ্যে মনোবল হারাতে শুরু করেছিল পাকিস্তানিরা। ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক এসে দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ নাজুক অবস্থায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চলছিল ক্ষমতার খেলা। এ সময় ভারত আক্রমণ করার পর ভারতও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের মিত্রবাহিনী আঘাত হানতে শুরু করে পাকিস্তানিদের ওপর।
ডিসেম্বরে এসেই সবচেয়ে জঘন্য ষড়যন্ত্রটা শুরু হয়। ওরা ততদিনে বুঝে গেছে, খুব শিগগিরই বিদায় নিতে হবে এই ভূখ- থেকে। তাই এ দেশের কীর্তিমান মানুষদের হত্যা করার জন্য তালিকা তৈরি করা হয়। মেধাবী মানুষদের হত্যা করার অর্থ জাতির মেরুদ- ভেঙে দেওয়া- এ কথা ওরা জানত।
আলবদর বাহিনী এই তালিকা তৈরিতে অংশ নেয় এবং তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের দায়িত্ব নেয়। জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও জেনারেল জামশেদ আল বদরদের সঙ্গে মিলে ৯ ও ১০ ডিসেম্বর ইপিআর হেডকোয়ার্টারে বৈঠক করে। বৈঠকের প্রধান বিষয় ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-। যদিও এই তিন জেনারেল একে অন্যের ঘাড়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপাতে চাইছেন, কিন্তু এই নীলনকশা যে তারা তৈরি করেছেন, সে কথা চেপে রাখতে পারেননি।
সে রাত থেকেই ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে কাদালেপা মাইক্রোবাসগুলো বের হয়। এবং ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করতে শুরু করে আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা। বুদ্ধিজীবীদের চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করে আলবদর বাহিনী। আমার বাবা ইত্তেফাকের বার্তা ও নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করার মাধ্যমে তাদের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা শুরু হয়। ১৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বরেও অপহরণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদকে। এ সময় সাংবাদিক নাজমুল হক, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি প্রমুখ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করা হয়। এই বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার, কাঁটাসুর ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে।
প্রাপ্তি: পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু ফোন করলেন। ফোন ধরলেন সৈয়দ শাজাহান। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ফোন দেওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু সেয়দ শাজাহানকে প্রশ্ন করলেন, ‘সিরাজকে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে?’
তিনি ‘হ্যাঁ’ বলায় বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘আহ্!’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বন্ধু, একই পথের অনুসারী সিরাজুদ্দীন হোসেনের শূন্যতা বোধ করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে এসে। কেজি মুস্তাফা, আবদুল গাফফার চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদকে তার এই কষ্টের কথা বলেছেন অনেকবার।
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিব আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেনের জন্য শূন্যতা বোধ করেছেন, এটা আমার পরম পাওয়া। আমি গর্বিত হই, যখন ভাবি, আমাদের পতাকার লালে ৩০ লাখ মানুষের যে রক্ত রয়েছে, তাতে আমার বাবার রক্তও গিয়ে মিলেছে। মনে হয়, দেশে বা দেশের বাইরে যেখানেই যখন থাকি না কেন, আমার এই গর্ব কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না। জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার গল্পগুলো তখন এই বিশালত্বের কাছে একেবারে ম্লান হয়ে যায়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়