1890
Published on ডিসেম্বর 14, 2020মুহাম্মদ ফারুক খান এমপিঃ
১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এদিনে সমগ্র বাঙালি জাতি গভীর কৃতজ্ঞতায় ও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন বাংলার সেই সব সূর্য সন্তানদের যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। একটি নতুন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মূল চালিকাশক্তিকে ধ্বংস করার গভীর এই নীলনকশায় অংশ নিয়েছিল আমাদেরই দেশের গুটিকয়েক নরপিশাচ যারা কখনই চায়নি বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে পরিচিত হোক। বাঙালি জাতির জাগরণে এসব বুদ্ধিজীবীর অগ্রণী ভূমিকা সব সময়ই তাদের চক্ষুশূলের কারণ ছিল। আর তাই ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে তাদের নিধনে ব্যস্ত ছিল পাকিস্তানি শাসকরা।
একটু পিছন থেকে যদি দেখি, তবে এই ক্ষোভের আসল কারণ আরও বিস্তারিত বোঝা যাবে। ১৯৪৭ পাকিস্তান নামক একটি অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই লক্ষণীয় যে, বাঙালি বা পূর্ব-পাকিস্তানিদের সঙ্গে পশ্চিম-পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ। ’৪৮-শে তারা প্রথম আঘাত হানে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় উর্দুকে আমাদের মুখে। বাঙালি প্রতিবাদ করে। ’৫২-তে রক্তের বিনিময় বাংলা ভাষা পেলেও, বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালিরা ধীরে ধীরে এই শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের সম্মুখ নেতৃত্বে থাকতেন রাজনীতিবিদরা পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তারাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তা-বোধে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন নানাভাবে।
বুদ্ধিজীবীরা তাদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে তাদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। ’৬৬-তে যখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ডাক দিলেন, ততদিনে এদেশের মানুষ এসব সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে গিয়েছিল যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এ জন্যও পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ওই রাতেই অতর্কিতভাবে বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালীন খুঁজে খুঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বসবাসরত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ওই রাতেই হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী, আলবদর, আলশামস ও রাজাকারের দল তালিকা তৈরি করে, যেখানেই এসব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে পেয়েছে, তাদের হত্যা করেছে।
তবে দুঃখের বিষয়, এখানেই শেষ না। তাদের আসল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক দিন আগে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের শাসকরা নিশ্চিত পরাজয় অনিবার্য জেনে ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চালায় পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। এদেশের কিছু মানুষরূপী পশু নিজেরা, বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল বাংলার সূর্য সন্তানদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবী দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র)। ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)। ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)। ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য)। ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস)। ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য)। ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা)। ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা)। হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য)। রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য)। সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা)। ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান)। এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান)। এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা)। শরাফত আলী (গণিত)। এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা)। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা)। এম এ সাদেক (শিক্ষা)। এম সাদত আলী (শিক্ষা)। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস)। গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস)। রাশীদুল হাসান (ইংরেজি)। এম মর্তুজা (চিকিৎসক)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : ড. হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ)। ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত)। মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)। চিকিৎসক : অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ)। অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)। অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ। অধ্যাপক ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী। ডা. হুমায়ুন কবীর। ডা. আজহারুল হক। ডা. সোলায়মান খান। ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী। ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার। ডা. মনসুর আলী। ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা। ডা. মফিজউদ্দীন খান। ডা. জাহাঙ্গীর। ডা. নুরুল ইমাম। ডা. এস কে লালা। ডা. হেমচন্দ্র বসাক। ডা. ওবায়দুল হক। ডা. আসাদুল হক। ডা. মোসাব্বের আহমেদ। ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)। অন্যান্য : শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক)। নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক)। সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক)। আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক)। আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার)। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ)। রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর)। যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)। জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার)। মেহেরুন্নেসা (কবি)। ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ)। নজমুল হক সরকার (আইনজীবী)। নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)সহ নাম জানা-অজানা অনেকে।
লেখক: সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন