2710
Published on নভেম্বর 21, 2020সৈয়দ বদরুল আহসান
আমরা যে জাতিরাষ্ট্রের অংশ, সেসব বিষয়ে এবং আমাদের অতীত ইতিহাস নিয়ে আরও একবার কথা হতে পারে, ব্যাপারগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এই দেশটি একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদান ও লাখো নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই জাতিরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক এদেশের গ্রামজুড়ে নির্মম লুটতরাজ, শহরে শহরে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, এমনকি তাদের বর্বরোচিত হামলায় আপামর বাঙালির রক্তের স্রোতের পটভূমির ওপর গড়ে উঠেছে আমাদের ইতিহাস।
আমরা মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, চাকমা, মারমা, ম্রো, সাঁওতাল এবং আরও বাকি সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষ মিলেমিশে এই গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে বসবাস করি, এটাই আমাদের সবার বাড়ি। এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভূমি এবং এভাবে মিলেমিশে শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্যই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যুদ্ধ করে এই ভূমি অর্জন করেছি। এই ভূমি থেকেই ১৯৭১ সালে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্রতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিল। পরবর্তীতে একটি সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য আমরা সেই মহান যুদ্ধে অংশ নেইনি। যুদ্ধের পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে, এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতা এলেও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণেই আমরা আজকের এই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটি পেয়েছি, তাই অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে আমরা দেশে এবং বিদেশে এখন তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। তিনি ছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, অন্ধকারে আশার বাতিঘর এবং একটি শোষিত জাতির মুক্তিদাতা। ১৯৭১ সালে, এই ভূমি থেকে হাজার মাইল দূরের এক কারাগারে হন্তারকরা যখন তার প্রাণনাশের হুমকি দিতো, তখনও শুধু তার নামেই এদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামকে সামনে রেখেই তার চার বিশ্বস্ত সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আমাদের ইতিহাসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। দেশে এবং দেশের বাইরের মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে- বাংলাদেশে গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িকতার উস্কানিতে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান নেই। ১৯৭১ সালে অনেক সংগ্রামের পর অন্ধকার তাড়িয়ে আলো এসেছে এবং ১৯৯৬ সালের পর নীতিগত স্থান থেকে পুনরায় ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে নিজিদের প্রতিষ্ঠিত করেছি আমরা। কিন্তু অনেকে এই রাষ্ট্রকে আবারও ১৯৭১ ও ১৯৯৬ সালের পূর্বের অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে মানুষকে প্ররোচিত করছে, এটি স্পষ্টতই একটি ভুল পদক্ষেপ। সম্প্রতি গত কয়েক বছরে আমরা অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে পর্যবেক্ষণ করছি যে, সাম্প্রদায়িক শক্তিরা আমাদের উদার রাজনীতির বিষয়ে প্রকাশ্যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। এটি আমাদের জন্য একটি অশনি-সংকেত এবং আজ জাতীয় স্বার্থে এসবের পাল্টা জবাব দেওয়া প্রয়োজন।
দেশজুড়ে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে ধর্মান্ধদের সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকগুলোতে ইতিহাস বিকৃতির মতো ঘৃণ্য কার্যক্রমও আমরা দেখেছি। সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীদের দ্বারা স্রষ্টার নামে সাধারণ মানুষ হত্যার মতো ঘটনার ঘটছে। মানুষ হত্যা হচ্ছে, মন্দির ভাঙা হচ্ছে, কিন্তু সবাই দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এই ধর্মান্ধদের উগ্রবাদ এবং তাদের মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা আজ আমাদের বিষম বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি আমরা খিলাফত মজলিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত মওলানা মামুনুল হক নামের এক ব্যক্তির ঔদ্ধত্য দেখেছি। রাজধানীর ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করেছে সে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের এই ধৃষ্টতা চরম হঠকারিতা। অবশ্য এই লোকদের সঙ্গে ঝগড়া করা অপ্রাসঙ্গিক। তাকে শুধু এই ভূমির ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানানোর কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। তার অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন- বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কেউ কোনো নেতিবাচক পদক্ষেপ নিলে তা কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। তারা যতোই ঔদ্ধত্য ও বালখিল্যতা দেখাক, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাদের প্রতি কঠিন হতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আমরা জানি, ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি, ঢাকাকে মন্দির ও চার্চের শহরও বটে। শুধু তাই নয়, এই ঢাকা শহর আমাদের বাঙালি শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনন্য পাদপীঠ। এই নগরে বসবাসকারী এবং নাগরিকের উদারতা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ঢাকা কখনোই ধর্মান্ধদের জায়গা ছিল না, আজও নয়। এমনকি বাংলাদেশও ভৌগলিকভাবে কখনোই গোঁড়ামির কেন্দ্রভূমি নয়, কখনো উগ্রবাদের স্থান হবেও না এখানে।
ওই মওলানা এবং তার মতো অন্যদেরও প্রকৃত জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা প্রয়োজন, মূর্তিপূজা এবং নান্দনিকতার পার্থক্য বোঝানো প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী ভাস্কর্যকে ইতিহাস-ঐতিহ্য বা কোনোকিছুকে উপস্থাপনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এটি একটি উচ্চমার্গীয় শিল্প। আর প্রতীমা বা মূর্তি হলো কিছু নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের জন্য, সেই ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাসের ভিত্তি সেটা। মনে হয়, ভাস্কর্য আর মূর্তির ব্যাপারটি এখন সবার কাছে স্পষ্ট?
আসুন, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত ভাস্কর্যগুলো এই সুন্দর দেশজুড়ে স্থাপন করি। বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার, আমাদের সুন্দর জীবন নিশ্চিতের জন্য আত্মত্যাগী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অতীতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের ভাস্কর্যও দেশজুড়ে বৃহত্তর পরিসরে স্থাপন করা প্রয়োজন। ইতিহাসের কাজই অমূল্য সত্যকে ধরে রাখা। আমাদের এটা বলা প্রয়োজন এবং এটাই অদম্য সত্য যে, গর্বিত বাঙালি হিসেবে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক হিসেবে সবসময়ই আমাদের গোঁড়ামিকে প্রতিহত হবে।