৩০ মে, ১৯৫৭: দলের স্বার্থে মন্ত্রীত্ব ছাড়লেন বঙ্গবন্ধু

9052

Published on নভেম্বর 16, 2020
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

৩০ মে, ১৯৫৭। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিস, সিম্পসন রোড। শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলীসহ অন্যান্য নেতা উপস্থিত।

মুজিব- সকলকে উদ্দেশ্য করে- একটু আগেই আমি পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগপত্র মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।

সকলে করতালি।

তাজউদ্দীন- মুজিব ভাই, সাংবাদিকরা হাজির হয়েছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কর্মীরাও আসতে শুরু করেছে। অনেকে ক্ষুব্ধ। অনেকে খুশি।

মুজিব- সাংবাদিকদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটে কথা বলেছি। নতুন কী বলব? এই তো মানিক ভাই আছেন, আপনি ওদের যা বলার বলবেন।

মানিক ভাই- মজিবর সাহেব, বুঝতে পারছেন- কত বড় ঘটনা আজ আপনি ঘটিয়ে ফেললেন? ভারত ও পাকিস্তানে সবাই মন্ত্রী হতে চায়, একইসঙ্গে দলের পদেও থাকতে চায়। আপনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রীপদ ছেড়ে দিলেন। আপনার কাছে ভিড় তো করবেই।

মুজিব- সোহরাওয়ার্দি সাহেব ও মওলানা ভাসানী সাহেবকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আজ অনেক সময় আলোচনা করেছি।

আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ- তিনি কী বলেছেন?

নেতাদের সভায় একদল সাংবাদিক প্রবেশ করে।

মুজিব, হেসে- আপনারা দেখি দলের সভায় ঢুকে পড়েছেন?

এক সাংবাদিক- এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন, এটাই তো আজ হট টপিক।

আরেক সাংবাদিক- মুখ্যমন্ত্রী কি আপনার পদত্যাপত্র গ্রহণ করেছেন?

মুজিব- তিনি আমাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেটাই পড়ে শোনাচ্ছি।

মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন- ‘মানুষ যেখানে সহজে মন্ত্রিত্ব পদের প্রলোভন ত্যাগ করিতে পারে না, সেখানে আপনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ সংগঠনকে জোরদার ও সরকারের হস্ত শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে পদত্যাগের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিয়া এক প্রশংসনীয় নজির স্থাপন করিয়াছেন।’

এক সাংবাদিক- পদত্যাগপত্র কি গৃহীত হয়েছে?

মুজিব- মুখ্যমন্ত্রী আরও লিখেছেন- ‘আপনার পদত্যাগপত্র দাখিলের ফলে আপনার আওতাভুক্ত দফতরগুলির পরিচালনার ব্যাপারে নয়া পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে এবং ইহার সমাধান সময়সাপেক্ষ।’

এক সাংবাদিক- আপনাকে অভিনন্দন। আপনি তো কাগমারিতে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ ছাড়ার কথা বলেছিলেন। এখন কেন মন্ত্রীপদ ছাড়লেন?

মুজিব- আমি প্রতিশ্র“তি রেখেছি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একসঙ্গে সরকার ও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা যায় না। আমি দলের পদ রেখে মন্ত্রীর পদ ছেড়েছি। বর্তমান সময়ে দলের জন্য যা ভাল মনে হয়েছে, সেটাই করেছি। আমার কাছে বাসা ও রাস্তায় প্রোটোকল, পুলিশের স্যালুট- এ সব কোনো আকর্ষণ তৈরি করে না। কর্মীরাই আমার নিরাপত্তা দেয়। আবার তাদের সুখ-দুঃখে আমি সাধ্যমত পাশে থাকার চেষ্টা করি।

সাংবাদিক- আপনি তো দলেই স্বচ্ছন্দ্য...।

মুজিব- এই দলের জন্য আমি পূর্ব পাকিস্তানের এমন কোনো জেলা-মহকুমা নাই, যেখানে বার বার যাই নাই। মন্ত্রীত্বের প্রোটোকল আমার জন্য বাড়তি সুবিধা এনে দেয় না। মন্ত্রীত্ব নেওয়ার পর গত সাড়ে আট মাসে আমার আচরণ-কথায় বদল আসে নাই। দল আমার প্রাণ, কর্মী-সমর্থকদের আমি প্রাণের চেয়েও ভালবাসি। আমার স্ত্রী ও সন্তানারাও এটা জানে।

অফিসে কর্মীদের স্লোগান- মুজিব ভাই, জিন্দাবাদ। মুজিব ভাই অভিনন্দন, অভিনন্দন।

মুজিব- মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ১২ জুন প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের নেতা সোহরাওয়ার্দি সাহেব করাচি থেকে ঢাকা আসছেন। তার সঙ্গে আলোচনা করে পদত্যাগপত্র গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

সাংবাদিক- মওলানা ভাসানীও তো সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন...।

মুজিব- তাকে অনুরোধ করা হয়েছে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য। তিনি কৃষক সমিতি নামে নতুন সংগঠনের সম্মেলন করেছেন বগুড়ায়। এতে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী যোগ দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৃষক সমিতির সম্পর্ক নাই।

এক সাংবাদিক- মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন যে আপনি মন্ত্রিপদে থাকুন- এটা কি ঠিক?

মুজিব- সোহরাওয়ার্দি ও ভাসানী সাহেবের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী আমাকে মন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। এ কারণেই এ পদ গ্রহণ করেছি। এখনও তারা এটা চাইতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আগামী বছরে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা, সেটা মাথায় রেখে দলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

এক সাংবাদিক- আওয়ামী লীগ ভাঙবে, এমন গুঞ্জন রয়েছে। দলের সভাপতি পদত্যাগ করেছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ আপনার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় দলকে রক্ষা করতে পারবেন?

মুজিব- আওয়ামী লীগের প্রাণ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। আমি সাইকেলে দিনের পর দিন ঘুরেছি দলের জন্য, কর্মীদের সঙ্গে মিটিংয়ে চোঙা ফুকেছি। কেউ এ দলকে দুর্বল করতে পারবে না। আমি কর্মীদের সঙ্গে দল ঠিক রাখার কাজে সামিল থাকতে চাই। গোটা পূর্ব বাংলার কর্মীদের ঘরে ঘরে যাব আমি।

সাংবাদিক- মন্ত্রীর প্রোটোকল থাকলে দলের কাজে সুবিধা হয়- এটাই তো সকলে বলে থাকেন?

মুজিব- শেখ মুজিবের এ সুবিধার দরকার নাই। আওয়ামী লীগ গঠনের সময় জেলে ছিলাম। আমাকে সর্বসম্মতভাবে যুগ্মসম্পাদক নির্বাচন করা হয়েছিল। মুক্ত হওয়ার পর সভাপতি ভাসানী সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠালেন, সেখানে সোহরাওয়ার্দি সাহেবসহ মুসলিম লীগ বিরোধীদের আমি আওয়ামী লীগের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পারি। তারপর দুই বছরের বেশি জেলে, কিন্তু মুক্তির পরই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আমি কি এ সব চেয়েছি?

এক সাংবাদিক- আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, বিশেষ করে খাদ্যের দাবির প্রচণ্ড আন্দোলনে আপনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা জানি, আপনি আন্দোলন গড়ে তোলায় নেতৃত্ব না দিলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারত না। সেই সরকারে কেন থাকছেন না?

মুজিব- আন্দোলন করেছে দলের নেতা-কর্মীরা, সাধারণ মানুষ। ভূখা মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাদের পাশে আমি ছিলাম। আমি সরকারে না থাকলেও সমস্যা নাই।  কিন্তু দল না থাকলে সরকার থাকবে না।   

মানিক মিয়া, সাংবাদিকদের- অনেক প্রশ্ন করেছেন। এখন আপনারা যেতে পারেন।

সাংবাদিক- আর একটা প্রশ্ন...।

মুজিব- তিন বছর আগে এই মে মাসের শেষেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। শেরে বাংলার মন্ত্রীদের মধ্যে কেবল আমারই স্থান হয় কারাগারে।

সাংবাদিক- আপনারা কাউন্সিল ডেকেছেন কেন?

 মুজিব- ১৩ ও ১৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে। সেখানে সোহরাওয়ার্দি সাহেব থাকবেন। সব বিষয় আলোচনা হবে।

এক সাংবাদিক- আপনাকে যদি মন্ত্রিসভায় থাকতে বলে?

মুজিব- পদত্যাগ নিয়ে আলোচনার সময়েই অনেকে বলছেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সাংবাদিক- আপনার চীন সফর কি স্থগিত হয়ে যাবে?

মুজিব- মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সফর বহাল রাখার অনুরোধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও এটা চান। তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষভাবে আগ্রহী। ১৯ জুন পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে চীন যাওয়ার কথা। এ কারণে হয়ত আরও কয়েকদিন আমাকে মন্ত্রীত্ব চালিয়ে যেতে হবে।

এক সাংবাদিক- স্যার শেষ প্রশ্ন, মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ায় ভাবীর প্রতিক্রিয়া কী?

মুজিব, হেসে- বাসায় জানলে তো প্রতিক্রিয়া পাব। দল ও সরকারের বিষয় এটা। তাদেরকেই আগে জানিয়েছি।

এক সাংবাদিক- আমি বাসায় ভাবির কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়েছিলাম। তিনি কিছুই জানেন না, আমার কাছেই প্রথম শোনেন।

মুজিব- কর্মী ও নেতাদের দিকে তাকিয়ে- মন্ত্রীর  দফতরের কাজ থাকবে না। এখন থেকে নিয়মিত আপনাদের কাছে আসত পারব। দোয়া করবেন।

নেতা-কর্মীরা মালা দেয় মুজিবকে। স্লোগান- মুজিব ভাই জিন্দাবাদ। আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ।

মানিক মিয়া- মন্ত্রী হলে ফুলের মালা মেলে। মন্ত্রীত্ব ছাড়লেও মালা মেলে, এই প্রথম দেখলাম। মজিবর সাহেব, আপনি সত্যিই অনন্য নেতা। স্যালুট জানাই আপনাকে।

.....

১৯ জুলাই, ১৯৫৭। কারকুন বাড়ি লেন। ঢাকা। মুজিব ভাসানী সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। ভাসানী বুকে জড়িয়ে ধরেন।

ভাসানী- মজিবর, পত্রিকায় দেখলাম- আইনসভায় তুমি টু-ইকোনমির কথা বলেছ। অটোনমি প্রস্তাব পাস করেছ। এভাবে তুমি সোহরাওয়ার্দি সাহেবের বিরুদ্ধে গেলা। তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে- ভাবতেই পারি না। আমি গরীব মানুষের রাজনীতি করি। ৪০-৫০ বছর রাজনীতির জীবনে তোমার মতো নিবেদিত কাউকে পাই নাই।

মুজিব- আপনি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি জেলে ছিলাম। আমার সিদ্ধান্ত জানতে লোক পাঠিয়েছিলেন। আমার মতো নগন্য কর্মীকে এমন সম্মান দিলেন আপনি। জেল থেকে মুক্তির সময় আপনি ব্যান্ড পার্টি নিয়ে হাজির হলেন। এখন আপনিই দল ছেড়ে নতুন দল করলেন।

ভাসানী- কী করব বল? সোহরাওয়ার্দি সাহেব পরারাষ্ট্র নীতি ও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে যেভাবে আপস করলেন, তাঁর সঙ্গে কী করে থাকি?

মুজিব- আওয়ামী মুসলিম গঠন করেছিলেন আপনি। তারপর অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ হয় নাই? অসাম্প্রদায়িক দল করার জন্য সেই ১৯৫৩ সালের মে মাসে আমিই প্রস্তাব তুলেছিলাম। আপনিই বলেছিলেন- কিছুদিন সবুর কর। সোহরাওয়ার্দি সাহেব ৯৮ পার্সেন্ট স্বায়ত্তশাসন পূর্ব বাংলা পেয়ে গেছে বলার পরও আইনসভায় আমরা প্রস্তাব পাস করি নাই? আপনার মজিবর লক্ষ্য থেকে সরে না।

ভাসানী- তোমার সঙ্গে যুক্তিতে পারা কঠিন। আচ্ছা বল, চীন সফর কেমন হলো? এই নিয়ে দুই বার চীন গেলে তুমি।

মুজিব- সোহরাওয়ার্দি সাহেব পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করছেন না। কিন্তু আমাকে চীনে পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে তিনিই ঢাকা এনেছেন। চীনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। মাও সে তুংয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। কমিউনিস্ট রাশিয়াতেও আমি যাব। স্টালিনের মৃত্যুতে আমিই আরমানিটোলা মাঠে শোকসভার আয়োজন করেছিলাম।

ভাসানী- বুঝতে পার, বামপন্থীরা এখন আলাদা দল চাইছে...।

মুজিব- বামপন্থীদের নিয়ে আমি গণতান্ত্রিক যুবলীগ করেছি। আওয়ামী লীগে এনেছি। তাদের বলেছি- সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তানের সবচেয়ে বিপদের কারণ হবে। তারা অসময়ে বিপ্লবের ডাক দিতে চেয়েছিল। আমি বলেছি- সাম্প্রদায়িকতা রুখতে না পারলে সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

ভাসানী- তুমি কৃষকদের ভাষায় কথা বলতে পার, শ্রমিকদের ভাষা বোঝ।

মুজিব- আমি ছাত্রলীগ করা অবস্থাতেই খুলনা, ফরিদপুর, কুমিল্লায় ধান কাটা মজুর দাওয়ালদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের আন্দোলনের ডাক প্রথমে দিয়েছিল কমিউনিস্টরা। আমি কর্মচারীদের পাশে থেকেছি, জেল খেটেছি।

ভাসানী- তুমি  মন্ত্রীত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছ। তোমাকে মোবারকবাদ জানাই। পাকিস্তানে এমন বুকের পাটা কারও নাই। গত বছর নভেম্বর মাসে ভারতের রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নেহরুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তিরচী রেল দুর্ঘটনার জন্য তাঁর কঠোর সমালোচনা হয়। তুমি মন্ত্রী হিসেবে সুনাম পাচ্ছ। আমলারা তোমার মাথায় চড়ে বসতে পারে না। যে কোনো জটিল সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পার। তোমার কোনো বদনাম নাই। সেই তুমি মন্ত্রীত্বে লাথি মারলা।

মুজিব- হুজুর- আপনি দলের পদ, না হয় মন্ত্রীত্ব- একটি ছাড়তে বলেছিলেন। আমি মন্ত্রীত্ব ছেড়েছি। মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী চীন সফর  শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। আমার জাপান ও ফিলিপিন্সে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর তলবে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে চলে এসেছি। এর একটি কারণ অবশ্য আপনার নতুন দল গঠনের উদ্যোগ।

ভাসানী- তুমিও এই দলে যোগ দাও।

মুজিব- হুজুর, বামপন্থীরা কেউ রাশিয়ার দলে। কেউ আবার চীনকে বেশি পছন্দ করে। এই মজিবর রহমান বাঙালির পক্ষে। পূর্ব বাংলার পক্ষে। এখন নতুন দলে কিছু ভাল কর্মী হয়ত নিতে পারবেন। কিন্তু স্বায়ত্তশাসন আদায় করতে হলে, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি চাইলে এই মজিবরকেই লাগবে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সেটা রুখতে পরিকল্পনা আমার করা আছে। সময় হলেই প্রকাশ করব।

ভাসানী- তুমি নাকি পাকিস্তান টি-বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে মাসিক চার হাজার টাকা বেতন নেবে?

মুজিব- আমি টি বোর্ডের অনারারি চেয়ারম্যান। এই পদে দায়িত্ব পালনকালে আমি কোনো বেতন গ্রহণ করব না।

ভাসানী- তোমার পদত্যাগপত্র কবে গৃহীত হবে?

মুজিব- চীন থেকে আসার পরেই হয়ে যেত। কিন্তু আপনি নতুন দল গঠন করার তারিখ ঠিক করেছেন জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে। ফলে আওয়ামী লীগ ঠিক রাখার কাজে সবাই ব্যস্ত। শুনেছি, ৮ আগস্ট পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে।

ভাসানী- তোমার জন্য দোয়া থাকল।

মুজিব- আপনার নতুন দলের জন্য শুভকামনা। আওয়ামী লীগের দুয়ার আপনার নতুন দলে যারা যাবে, তাদের জন্য খোলা থাকবে। পশ্চিমাদের সঙ্গে বেশি দিন থাকা যাবে বলে মনে হয় না। তারা পূর্ব বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে  চায়। এটা হতে দেব না। আরেকটা কথা বলে রাখি- পাকিস্তানে ধনিক শ্রেণি ও আমলারা এবং আর্মি ইলেকশন চায় না। তারা জানে, আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। এই দলকে তারা দুর্বল করতে চায়। আপনি যে ন্যাপ করতে চাইছেন এর পেছনে তাদের ইন্ধন আছে কীনা, ভেবে দেখবেন। 

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু- প্রথম খণ্ড, পঞ্চাশের দশক (বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত), বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে  গোয়েন্দা রিপোর্ট, চতুর্থ খণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধে দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড।

লেখকঃ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও গবেষক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত