স্মৃতিপটে নভেম্বর

1920

Published on নভেম্বর 16, 2020
  • Details Image

সুলতান মাহমুদ শরীফঃ 

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী সারাবিশ্ব ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পক্ষে সমর্থণ আদায় করার জন্য, পূর্ব বাংলায় নৃশংসভাবে গণহত্যার অবসানের জন্য, পশ্চিমাবিশ্বের মোড়লদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে, একাত্তরের অক্টোবরের শেষ দিনে দেশে ফিরে গেছেন। এইসময় তিনি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে দায়িত্বে থাকা স্যার আলেক ডগলাস হিউম্যানের সাথেও জরুরী বৈঠক করেন। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার আপা পান্তের ক্যানসিংটনের রাজপরিবার বেষ্টিত এলাকার বাড়িতে তার সাথে আমাদেরকে দেখা করার সুযোগ করে দেন। সেই সাক্ষাতে মিসেস গান্ধীর মুখ থেকে শুনলাম যে, তিনি সকল দেশেই মহা সমাদরে গৃহীত হলেও আমেরিকার হোয়াইট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে দেখা করার সময় যে ব্যবহার পেয়েছেন তাতে কষ্ট পেয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ে হোয়াইট হাউসে পৌছে সাক্ষাতের অপেক্ষায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আধ-ঘন্টার ও বেশী ইচ্ছা করেই বসিয়ে রাখা হয়েছিল। আলোচনায় একরোখা নিক্সন তার সাথে যে ব্যবহার করেছিল তা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর জন্য সম্মানজনক ছিল না। বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন বোঝা গেল। আমাদের তিনি নিশ্চিন্ত করলেন যে, যতবড় ঝুঁকিই আসুক না কেন, বাংলার মুক্তিকামী মানুষের সাথেই তিনি থাকবেন। আমরা সে সন্ধ্যায় আশ্বস্থ হয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। মিসেস গান্ধী দিল্লীতে ফিরে গেলেন।

এর কয়েকদিন পর দিল্লী থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীরত একজন বাঙালি অফিসার আমাকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে খবর পাঠালেন, যেনো দিল্লীতে সময়ক্ষেপন না করে চলে যাই। কারণ একদিকে মিসেস গান্ধী বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা শেষ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আর অন্যদিকে একটা ষড়যন্ত্র পাকানো হচ্ছে যাতে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এলেও বাংলাদেশের মানুষের কর্তৃত্ব খর্ব করে পাকিস্তানের সাথে একটা সমঝোতা করা যায়। অন্যথায় বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় এর একটা তৎপরতা চলছে। এতে ভারতের সিভিল সার্ভিসের একটি অংশের সহযোগীতারও আভাস পাওয়া গিছে। আমি তখন উপার্জন ছাড়া অবস্থায় দীর্ঘদিন আছি। আমার স্ত্রীর মাসিক বেতনই আমাদের একমাত্র সংসারের আয়। আমাদের কাছে লন্ডন-দ্ল্লিী-কলকাতা যাওয়ার খরচের কোন উদ্ধৃত টাকা তখন ছিল না। আমার দুই বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে টিকেট ও কিছু খরচের টাকা নিয়ে নভেম্বর মাসের একসময় দিল্লী চলে যাই। এর আগে আমি জুলাই মাসের মধ্যম সপ্তাহে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের ভিডিও চিত্র ও বিভিন্ন ডকুমেন্ট নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লন্ডনে ফিরে এসেছিলাম।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তখন বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে দিল্লীতে আমাদের অস্থায়ী দূতাবাস চালাচ্ছেন ও তার ভাড়া বাড়ি থেকে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। দিল্লীতে পৌছে বিমানবন্দরে বাঙালি কর্মচারীদের সহায়তায় এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসা পাকিস্তান দূতাবাসের দুই অফিসার শিহাব উদ্দীন ও মি. আমজাদ এর মধ্যে শিহাব উদ্দীনের দিল্লীর বাসার ঠিকানা পেতে সক্ষম হলাম। এবং বিমানবন্দর থেকে শিহাব উদ্দীন সাহেবের বাড়িতে চলে গেলাম। শিহাব উদ্দীনের স্ত্রী পঞ্চাশের দশকে বরিশালের সদর গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন এবং আমার এক ছোট খালার সাথে ওই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন। সেইসূত্রে তিনি আমাকে তার ছোটবেলা থেকে চিনতেন বলে চিনে ফেললেন ও অত্যন্ত সমাদরের সাথে গ্রহণ করলেন। আমি হুমায়ুন রশিদ সাহেবের বাসায় বিকাল বেলা গিয়ে হাজির হলাম, তার সাথে আমার এর আগে কোনদিন দেখা হয়নি। কিন্তু তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন ও আদর আপ্যায়ন করলেন। উনার ও মিসেস চৌধুরীর আন্তরিক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। জনাব চৌধুরীর সহযোগীতায় সে রাতেই শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান এমপি ও আবুস সামাদ আজাদ এমপির সাথে দেখা হয়। এই দুই নেতার সাথে পূর্ব থেকেই আমার সখ্যতা ছিলো। তাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম যে, আমি বাংলাদেশ সংক্রান্ত যা শুনেছি সে রকমের একটা উদ্যোগ হয়েছিল। কিন্তু শেখ মণির নেতেৃত্ব যুব নেতারা এটা জানতে পেরে সরাসরি মিসেস গান্ধীর শরণাপন্ন হলে তিনি পুরো বিষয়টা জানার ফলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। কলকাতায় মোস্তাক, জহিরুল কাইয়ুম, হোসেন আলী, মাহবুবুল আলম চাষী ও তাহের উদ্দীন ঠাকুরের সাথে আমেরিকা ও কলকাতায় থাকা পাকিস্তানপন্হী একজন ভারতীয় মুসলমান রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সাথে অন্যান্য জড়িতদের রাষ্ট্রীয় খবরদারীর মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। যেসব ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের লোকরা তাদের প্রভাব বলয় থেকে সম্ভাবনাময় স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তাদের উপরও নজরদারী বাড়ানো হলো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সমূহ বিপদ দূর হলো। এ তো একাত্তর সালের নভেম্বরের কথা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। তার হাতে স্বাধীন দেশটি উঠে দাঁড়ালো। বঙ্গবন্ধু দেশে সব মানুষকে একত্রিত করে সমস্ত বিভেদকে ভূলিয়ে দিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। দেশের মানুষের মধ্যে প্রাণ ফিরে এলো। যুদ্ধবিদ্ধস্ত সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে চুরমার হওয়া এই দেশটা উঠে দাঁড়ালো। এসময় আমরা দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত কিছু নেতা নতুন, নতুন কিছু রারাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে হইচই শুরু করতে লাগলো। বাহাত্তরের প্রথম দিক থেকেই তারা দেশী-বিদেশী নতুন বন্ধুদের সাথে যোগসাজশ শুরু করল। আশ্চর্যজনকভাবে নকশালপন্হী,পাকিস্তানপন্হী, চীনপন্হী, সামাজিক উচ্ছিষ্ট আর আমেরিকার পদলেহনকারী কিছু লোক দেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করার জন্য প্রস্তুত হলো। সুশীল নামধারী ঠকবাজেরা একত্র হয়ে গেলো তাদের সাথে। স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যে তারা সিরাজুল আলম খানের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে প্রথম ভাঙ্গন নিয়ে আসে। জাসদ নাম দিয়ে একটি দল ও গঠণ করল। তৃতীয় ফ্রন্ট হিসাবে এই সুযোগে আভির্বূত হলো রাশিয়ানপন্হী কমিউনিষ্টদের একটি মোর্চা। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে পারস্পরিক সহযোগীতার একটি চুক্তি হয়েছিল তার পথ বেয়ে রাশিয়ানন্হী বলয়টি শক্তি অর্জন করতে লাগলো।

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনসমর্থণের ফলে এদের সকলেরই ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে গেলো। আমরা যখন দিবানিশি দেশের মানুষের জীবন জীবিকার উন্নতির চেষ্টা করছি তখন তারা, সরকারের সমস্ত অগ্রযাত্রাকে বাঁধাগ্রস্ত করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিয়ে আসতে কোন জনসমর্থণ যোগাড় করার উপায় নাই বুঝে এই পর্যায়ে তারা সেনাবাহিনীর নীতিচরিত্রহীন মুক্তিযুদ্ধে অসমসাহস প্রদর্শনকারী কিছু উচ্চাবিলাসী সেনা অফিসার ও চাকুরীচ্যুত সেনা অফিসারদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে ভয়াবহ ১৫ই আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে বাংলাদেশকে তছনছ করে দিলো। পচাত্তর সালের ১৫ই আগস্টের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কুশীলবরা ও তাদের উচ্ছিষ্টভূগীরা পচাত্তরের অক্টোবরের মধ্যেই টের পেলো যে তাদের দিন ফুরিয়ে গেছে। জনগণ একতাবদ্ধ হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সাথে সাথে সামরিক জান্তাবিরোধী মিছিলে মিছিলে ঢাকার রাস্তায় মানুষের ঢল তখন। মোস্তাক রাষ্ট্রপতি ভবনে এমপিদের আটকিয়ে অক্টোবরের প্রথমদিকে একটি সভা করে তাদের কোন সমর্থণ নিতে পারলো না। যখন এই খুনী দ্বিতীয়বারে চেষ্টা করেও এমপিদরে তার পক্ষে নিতে পারলো না, তখন তার আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা নতুন পরিকল্পনা শুরু করলো। জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে আসতে লাগলো। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহটাতে ঢাকা উত্তাল হয়ে উঠলো। ছাত্রলীগের উদ্যোগে এই সময় ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে মিছিল নিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ঠিক এই অবস্থায় ষড়যন্ত্রের পাকিস্তান ও আমেরিকান হোতারা তাদের ক্রীড়নকদের সহযোগীতায় নতুন ফন্দি আটলো । তারা খুনী জিয়াকে নিরাপদে রেখে তাহের ও খালেদ মোশাররফকে চালের গুটি হিসাবে ব্যবহার করে, সাধারণ সৈনিক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করলো।

একদিকে খালেদ মোশাররফ, অন্যদিকে কর্নেল তাহেরকে খেলায় নামিয়ে আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তানের সেসময়ের বেতনভোগী এজেন্টরা ২রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশকে বন্ধ করে দিলো। রেডিও টেলিভিশনের প্রচারণা বন্ধ রেখে গোপণে হত্যাকারী মোসলেম ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে জাতীয় নেতাদের হত্যা করে,এই খবর গোপন রেখে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। খালেদ মোশাররফ হায়দর ও হুদাদের সহ ১১জন সেনা কর্মকর্তাকে ৭ই নভেম্বরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো। পরে কর্ণেল তাহেরকে ধরে নিয়ে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করে। পাকিস্তানের মূল অনুচর জিয়াউর রহমানকে মার্শাল ল এডমিনিস্টেটর করে তাকে দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে বিনা বিচারে হাজার, হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করলো। জেল হত্যার সপ্তাহেই খালেদ মোশাররফের সাহায্যে মোস্তাকের সহযোগীতায়, ৭৩ এর নির্বাচিত পার্লামেন্ট বাতিল করে মোস্তাককে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে পুতুল সায়েমকে রাষ্ট্রপতি বানালো জেল- জুলুম এবং হত্যা চালিয়ে জিয়া নিহত হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা তার করায়ত্ত রাখলো। জিয়াকে দিয়ে যখন আর চলছিলো না, তখন এরশাদকে ব্যবহার করে চট্টগ্রামে মঞ্জুরকে সাক্ষীগোপাল বানিয়ে জিয়া হত্যার পর মঞ্জুরকেও হত্যা করা হলো। জিয়ার পুরো শাসনকালে ঢাকা শহরে সারারাত কারফিউ বলবৎ রাখতো। রাতের আধাঁরে আরেকটি হত্যাযজ্ঞ করে জিয়াকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরশাদের কালেই গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য সভা সমাবেশের উপর আক্রমণ করে, গণতন্ত্রের মুক্তির দাবি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় জনসমুদ্রের মধ্যে নূর হোসেনকে হত্যা করা হয়। এর পরেই এরশাদের শাসনের অবসান হয়। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও সমস্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নেয়। বহুমৃত্যু ও ক্ষতবিক্ষত মানুষের আহাজারির মধ্যেই জনগণের রোষে খালেদা জিয়ার সরকারের বিদায় হয়। একটি সুষ্ঠু গণভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুদিনের প্রত্যাশা পূরণ করার অঙ্গীকার পালন করে যাচ্ছেন। গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে।

লেখক: সভাপতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত