ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু

4536

Published on নভেম্বর 12, 2020
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

কলিকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়তে গিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে। সেখানে তিনি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। গোপালগঞ্জে পড়াশোনাকালেই যুক্ত হয়েছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে। একইসঙ্গে মুসলিম লীগের কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৮ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসন শহীদ সোহরাওয়ার্দি সরকারি সফরে গোপালগঞ্জ গেলে তিনি তাদের সঙ্গে পরিচিত হন। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির। দু’জনের মধ্যে তখন থেকেই চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। কলিকাতায় পড়াশোনার জন্য যাওয়ার পর দু’জনের মধ্যে কাজের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সোহরাওয়ার্দি সাহেব হয়ে ওঠেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মেন্টর বা গুরু।

ইসলামিয়া কলেজ ছিল বাংলাদেশের মুসলিম ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। দ্রুতই শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হয়ে ওঠেন। রাজনীতির বাইরেও তিনি দক্ষ ক্রীড়াবিদ, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী, রিলিফের কাজে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে তিনি লঙ্গরখানা পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৪৬ সালে কলিকাতা ও বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করেন। সে সময়ে ভারতবর্ষে কেবল বাংলা প্রদেশেই মুসলিম লীগ সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর পদে রয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। সঙ্গতকারণেই এই আন্দোলন কর্মসূচি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ বা রাজ্যে কীভাবে পালিত হবে, সেটা ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেস নেতৃত্ব উভয়ের নজরে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয় বাংলা এবং এ প্রদেশের রাজধানী কলিকাতার ওপর। এ প্রদেশে তখন হিন্দু ও মুসলিম লোকসংখ্যা প্রায় সমান, মুসলিম কিছুটা বেশি। মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির জন্য এটা ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের মূল কর্মসূচি ছিল হরতাল।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের কর্মসূচি বিষয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার নেতারা এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন। আমাদের আবার ডাক পড়ল দিনটি সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, ‘‘তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায় তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, ‘আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি।’’ আমরা গাড়িতে গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লায় সমানে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোন কথা নাই, ‘‘পাকিস্তান’’ আমাদের দাবি। এই দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। ‘সোহরাওয়ার্দি সাহেব তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বলে দিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোনো গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে।’ [পৃষ্ঠা ৬৩]

যে কোনো গণআন্দোলন সফল করতে হলে আমজনতার সংশ্লিষ্টতা চাই, এ শিক্ষা সে সময়ের মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম সাহেব দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। বাংলা অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক এবং হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে এই স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াক, এ প্রত্যাশা তাঁর ছিল এবং এ জন্য তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, শরৎ বসু ( নেতাজী সুভাষ বসুর বড় ভাই)সহ আরও কয়েকজন নেতা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে উঠলে তিনি এর পক্ষেই থাকেন। তবে চেষ্টা ছিল, নতুন দেশটি যেন গণতান্ত্রিক পথে থাকে, সাম্প্রদায়িক বিভেদ এড়িয়ে চলে। নবাব-জমিদারদের স্বার্থ নয়, বরং শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে বেশি মনোযোগী হয়। সে সময়ের মুসলিম লীগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ নেতা তাঁর এ চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই দলে।

আওয়ামী লীগ নেতা মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি ( প্রথম খণ্ড) গ্রন্থের ‘১৯৪৯-এর রাজনীতির ভাঙ্গাগড়ার পর্ব : মুজিব নেতৃত্বের উত্থান’ অধ্যায়ে ১৬ আগস্টের হরতাল প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘‘১৯৪৬ সালে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে সফল করে তোলার জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ইসলামি কলেজ এবং বেকার হোস্টেলের যে সকল ছাত্র কাজ করেছিলেন তাদের একজন ম. মুজাফফর আলী ২৮ ডিসেম্বর (১৯৯৭) তারিখ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, শেখ মুজিব কয়েকজন ছাত্রনেতা নিয়ে তৎকালীন বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিরবাসায় যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দি ছাত্রদের নিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস সম্পর্কে প্রচার জোরেশোরে চালানোর জন্য শেখ মুজিবকে নির্দেশ দেন।

‘১৫ই আগস্ট বিকেল বেলা আমরা দেখতে পেলাম ২০টি ট্রাক কয়েকটি মাইকসহ বেকার হোস্টেলের গেটের সামনে হাজির। মুজিব ভাই আমাদের নির্দেশ দিলেন সন্ধ্যার সাথে সাথেই আমরা যেন হোস্টেলের ডাইনিং হলে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে ট্রাক মিছিলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকি।... ট্রাক মিছিলের একেবারে সামনের ট্রাকে মুজিব ভাই-এর সঙ্গে অনেকের মধ্যে আমিও ছিলাম।... বড় বাজার থানার তৎকালীন মুসলমান ওসি জনাব মোকাদ্দাস হোসেন আমাদের সামনে এসে সাবধান করে দিয়ে গেলেন যেন আমরা কংগ্রেস বা হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার স্লোগান না দেই।’

কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নেয়। এর পেছনে ছিল মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড ও হিন্দু মহাসভার চক্রান্ত। উভয়ে কাজ করেছে নিজ নিজ সংকীর্ণ স্বার্থে, মিলেছে এক মোহনায়। মুসলিম লীগ প্রাদেশিক নেতৃত্বের একটি অংশ খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে সক্রিয় হয়। আবুল হাশিম ‘আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা নাজিমুদ্দিন ‘কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরেজের বিরুদ্ধে নয় হিন্দুদের বিরুদ্ধে।’ [পৃষ্ঠা : ১৩৪]

মহাত্মা গান্ধীর হরতাল বা সব কাজ বন্ধ রাখার কর্মসূচি অনুসরণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতবর্ষের মুসলমানদের প্রতি সব কাজ বন্ধ আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিনটি অমঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসে। উভয় সম্প্রদায়ের উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। দাঙ্গা যারাই শুরু করুক, জনমনস্তত্ত্বে এ ধরনের সহিংসতার কী প্রভাব পড়বে, সেটা অপরিণামদর্শীরা ভাবেনি বা ভাবতে চায়নি। কেবল ধর্মের কারণে মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে! হত্যাকাণ্ড যারা প্রত্যক্ষ করেছে তারা প্রকৃতপক্ষে দেখেছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ক্রোধ ও ঘৃণা। নির্ঘুম রাতের নিস্তদ্ধতা ভেঙে অসহায় মানবতার আর্তনাদ থেমে থেমে শোনা যেতে থাকে শহর ও গ্রামে। দাঙ্গার রেশ কাটতে না কাটতেই মহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান হচ্ছে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান, অন্য কিছু হবে কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস অশুভ শক্তির কারণে ব্রিটিশবিরোধী গণআন্দোলন থেকে বিচ্যুৎ হয়। কিন্তু বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতাকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক শেখ মুজিবুর রহমান এ আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি লক্ষ্য স্থির করেন বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এ জন্য চাই স্বাধীন রাষ্ট্র। এ পথে চলতে গিয়ে বার বার সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তরফে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। কখনও তা এসেছে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা হিসেবে, কখনও বা বাঙালি-বিহারি সমস্যা হিসেবে। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে অনন্য দক্ষতায় তা মোকাবেলা করেছেন।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের কিছুদিন আগে এই কলিকাতা শহরেই আরেকটি হরতাল প্রত্যক্ষ করেছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ১৮ দিন আগে ২৯ জুলাই পালিত এ হরতালের ইস্যু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতবর্ষের ডাক ও তার বিভাগের কর্মচারীরা তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল। এক পর্যায়ে তারা ধর্মঘট ডাকে। এই ধর্মঘটের সমর্থনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। তখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত তুঙ্গে। কমিউনিস্ট পার্টির হরতালেও তাই ব্যাপক সমর্থন মেলে। এ হরতাল কীভাবে পালিত হয়েছিল সেটা জানা যায় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেত্রী মনিকুন্তলা সেনের ‘সে দিনের কথা’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘ধর্মঘট ছিল মূলত ডাক, তার এবং টেলিফোন অফিসের কর্মচারীদের। কিন্তু সমর্থনে বেরিয়ে এলো স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সমস্ত সরকারি কর্মচারী। বেসরকারি অফিস-দফতর, পরিবহন, কলিকাতা বন্দর, রেল এবং রেডিও অফিস সমস্তই সেদিন ডাক ও তার বিভাগের সমর্থনে অচল হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজদের প্রচারকেন্দ্র রেডিও স্টেশন আগলে বসেছিল কিছু সাহেব ও পুলিশ বাহিনী। কারণ রেডিও স্টেশনে তারা ধর্মঘট করতে দেবে না। কিন্তু কলিকাতার সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীরা তাদের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। সাহেবদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের হাতাহাতি হয়, মাথা ফাটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অচল হয় রেডিও স্টেশন। রেডিও স্টেশনে মেয়েদের গায়ে ইংরেজ কর্তাদের হাত তুলতে দেখে কলিকাতার খ্যাতনামা ব্যক্তিরা ধিক্কার জানিয়েছিলেন।

‘সেদিন চৌরঙ্গীর সব অফিস, দোকান-বাজার, এমনকি হোটেলগুলো পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সাহেবদের বাড়িতেও শুনেছিলাম সেদিন ছিল অরন্ধন। কারণ বয়-বাবুর্চি, বেয়ারা সবাই অনুপস্থিত। সেদিন সকালে পায়ে হেঁটে চৌরঙ্গী ঘুরেছিলাম। দেখেছিলাম সাহেবদের ৩-৪ তলা বাড়িগুলো সবই বন্ধ, জানালা পর্যন্ত খোলা নেই। হঠাৎ হঠাৎ কেউ খিড়কি ফাঁক কওে রাস্তা দেখে আবার বন্ধ করে দিচ্ছিল। একটা গোড়া সৈনিক চৌরঙ্গীকে নিরাপদ মনে করে মোটর সাইকেলে যাচ্ছিল। রাস্তায় হৈ হৈ রব শুনে সে লোকটাও নাকি পড়িমড়ি করে ছুটে পালায়। সেদিন মনে হয়েছিল শ্রমিক শ্রেণি শক্ত হয়ে দাঁড়ালে দেশি-বিদেশি মালিকরা কত ভয় পায়। মনে হয়েছিল, আমাদের স্বাধীনতা আর বেশি দূরে নয়।

‘দুপুরে ময়দান থেকে বেরুল মিছিল। বিশাল মিছিল, সমস্ত কারাখানা শ্রমিক, অফিস-দফতরের কর্মচারী, টেলিফোনের মেয়ে, এমনকি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে, বিশাল সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী সেই মিছিলে সামিল হলো। ট্রাম-বাসের শ্রমিকেরা এসেছিল ইউনিফর্ম পরে। আমরা মহিলা সমিতির কর্মীরা যে যেখানে ছিলাম সবাই প্রায় যোগ দিয়েছিলাম ওই মিছিলে। কলিকাকার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, হোটেলের বয়-বেয়ারা আর কলিকাতার বাইরের অসংখ্য মানুষ একইসঙ্গে সেদিন পথে হেঁটেছিলাম।

‘চলতে চলতে মিছিলটা যখন লালবাজারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল দেখলাম গেটটা ভেতর থেকে তালাবন্ধ। অনেকে রসিকতা করে গেটের লোহার শিকে ছেঁড়া চটি টাঙিলে দিল। লালবাজারে লাল-কালো একটা মুখও দেখা গেল না।’

মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধানে দুটি হরতাল, অথচ চরিত্রে কত পার্থক্য। দুটিই সর্বাত্মক হরতাল ছিল। অথচ একটিতে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। তারা বুঝে যায়, ভারতবর্ষকে পরাধীন রাখা আর সম্ভব নয়। কিন্তু ১৬ আগস্ট দ্বিতীয় হরতালের পেছনে ছিল এই ব্রিটিশ শাসকদেরই গভীর চক্রান্ত। তারা ধর্মের নামে যে বিভেদের বীজ বপণ করে চলছিল কয়েক দশক ধরে, তা ফল দিতে শুরু করেছে। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করতে চলছিল, কিন্তু ধর্মের নামে, দ্বি-জাতিতত্ত্বের নামে উপমহাদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়। জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র।

পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু নিজে যে সব হরতাল আহ্বানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন কিংবা তাঁর মুক্তির জন্য যে সব হরতাল আহ্বান করা হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নজর রাখা হয়েছে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের প্রতি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এ অধ্যায়ের শুরু, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেষ। এই ২৩ বছরে সীমিত সংখ্যক হরতাল আহ্বান করা হয়েছে, কিন্তু কার্যকারিতার বিবেচনায় তা গণ্য হচ্ছে অনন্য হিসেবে। এ সময়ের প্রতিটি হরতাল কর্মসূচিতে জনগণ অংশগ্রহণ করেছে। সব কিছু তারা অচল করে দিয়েছে। এক একটি সফল হরতাল গণবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।

সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশল ও হরতাল- অজয় দাশগুপ্ত

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত