3182
Published on নভেম্বর 11, 2020ড. আতিউর রহমান:
১৯৫৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে যাওয়ার পর তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ওপর নেমে এলো দীর্ঘ দুর্ভোগ। এই দুর্ভোগ তাকে বারবারই পোহাতে হয়েছে। জীবনের বেশিরভাগ সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে কাটাতে হয়েছে রাজপথে, সভা-সমিতিতে, মিছিল-মিটিংয়ে, জেলে। আর তার জীবনসঙ্গিনী শুধু তার প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছেন। একই সঙ্গে সামলেছেন নিজের সংসার এবং ব্যাপক পরিসরে দলীয় সংসার। দলের কর্র্মীদের ছিলেন তিনি বড় আশ্রয়ধাত্রী। সন্তানদের গড়ে তোলার পাশাপাশি দলকে দেখভালের কাজেও তিনি ছিলেন সমান সক্রিয়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু অবশ্য তার স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তাই তো তিনি হয়েছেন বঙ্গমাতা। স্বদেশকে তিনি তার সন্তানের মতোই ভালোবেসেছেন। এ কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে ফজিলাতুন্নেছার অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সেই ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাদের। তার পর তো কলেজে উঠেই শেখ মুজিব কলকাতা পড়তে চলে গেলেন। দেশভাগের পর ঢাকা এসে শুরু করলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতি। পুরো প্রদেশ চষে বেড়াচ্ছেন। একদণ্ড সময় নেই স্ত্রী-সন্তানদের জন্য। বাকিটা সময় জেলেই কাটিয়েছেন। জেলই ছিল তার দ্বিতীয় স্থায়ী বাসস্থান।
১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব মন্ত্রী হওয়ার পর পরই বেগম মুজিব ঢাকায় এসেছিলেন সংসার পাতবেন বলে। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন শেখ মুজিব মন্ত্রী ছিলেন। যে কয়টা দিন মন্ত্রী ছিলেন, দারুণ এক দুর্যোগপূর্ণ সময় তাকে পার করতে হয়েছে। শপথ নেওয়ার দিনই আদমজীতে পাকিস্তানিচক্রের ষড়যন্ত্রে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। শপথ নিয়েই ছুটে যান ওই দাঙ্গা থামাতে। ঢাকায় ফিরেও শান্তি নেই। ঢাকা শহরেও বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গার চেষ্টা চলছিল। তিনি দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শান্তি স্থাপনের জন্য। এর কিছুদিন পরই প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তাকেসহ আরও কয়েক মন্ত্রীকে নিয়ে করাচি গেলেন। গর্ভনর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু করাচিতে পূর্ববাংলা সরকারের যে পতন ঘটানো হবে, তেমন ষড়যন্ত্রের আলামত দেখে এলেন। কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরে এসে দেখলেন তার স্ত্রী তখনো ভালো করে সংসার পাততে পারেননি। তাই তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দেবে আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা। ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হলো না। নিজের হাতের টাকা-পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, নবম মুদ্রণ ২০২০, পৃষ্ঠা ২৭০)। দুপুরে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বেলা ৩টার দিকে টেলিফোন এলো কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করে পূর্ববাংলার মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করেছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলেন। রাতে ফিরে দেখলেন সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে এসে ফিরে গেছে। তিনি নিজেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে টেলিফোন করে গাড়ি পাঠাতে বললেন। গাড়ি এলো। সন্তানদের ঘুম থেকে ওঠাতে দিলেন না। স্ত্রীকে শুধু বললেন, ‘তোমাকে কী বলে যাব, যা ভালো বোঝো করো। তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও’ (ওই, পৃষ্ঠা ২৭১)। তবে বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে গিয়েছিলেন, যদি তার স্ত্রী বাড়ি যেতে না চান, তাহলে একটি বাড়ি ভাড়া করে দিতে। তিনি তা করে দিয়েছিলেন। তাদের দেখাশোনাও করতেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর বেগম মুজিবকে নিয়ে জেলগেট গেলে মোহাম্মদ খানকেও গ্রেফতার করা হয়। তাই আতাউর রহমান খানের সঙ্গে পরে যখন বেগম মুজিব শেখ মুজিবের সঙ্গে জেলে দেখা করতে যান, তখনো তিনি বলেছিলেন সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে (গোয়েন্দা প্রতিবেনদন, চতুর্থ খ-, পৃষ্ঠা ৪২)। কিন্তু বেগম মুজিব কষ্ট করেই চলেছেন। ঢাকায় থেকে সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন।
১৯৫৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রী হলে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছেলেমেয়েদের নিয়ে খানিকটা স্বস্তিতে সংসার করার সুযোগ পান। তবে তাও খুব বেশিদিনের জন্য নয়। এবিএম মূসা তার ‘মুজিব ভাই’ বইয়ে লিখেছেন, এক সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হলেও সারাজীবন তিনি থেকে গেছেন গাঁয়ের সহজ-সরল মেয়ে হিসেবেই। সব সময়ই তার কোলের কাছে ধরা থাকত একটা পানের কৌটা। তবে ৩২ নম্বরের বাসায় বসে তিনি শুধু পান চিবাতেন না, সব সময় খবর রাখতেন স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের। প্রয়োজনে উপযুক্ত শলাপরামর্শ দিতেন। আর কর্মীদের সাহায্য-সহযোগিতা করার কথা তো আগেই বলেছি।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ মুজিবুর রহমান বারবারই তার প্রিয় রেণুর কথা লিখেছেন। এ দুটি গ্রন্থ শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেনই তার স্ত্রীর উৎসাহে। জেলখানায় খাতা কিনে দিয়ে আসতেন। পরে ওই খাতা স্বামীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে যত্ন করে আলমারিতে তুলেও রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ওই খাতা হারিয়েও গিয়েছিল। পরে ভাগ্যক্রমেই খাতাগুলো তাদের সুযোগ্য বড় কন্যা শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছায়। তা না হলে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক অজানা ইতিহাস হয়তো জানতেই পারতাম না। জানতে পারতাম না তার সহধর্মিণী প্রাণপ্রিয় রেণুর কথা। অজানাই থেকে যেত মহীয়সী নারীর অসামান্য অবদানের কথাও।
দুইবার মন্ত্রী হওয়া ছাড়া আর একবার বীমা অফিসে চাকরি করা ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো পেশাগত আয় ছিল না। তার পুরো রাজনৈতিক জীবনের ব্যয় নির্বাহ করেছেন পিতা লুৎফর রহমান আর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা। বাবার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা চাইতে পারতেন না। তখন স্ত্রীই হাত বাড়িয়ে দিতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত, বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত’ (ওই, পৃষ্ঠা ২৫)। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রথম খ-েও আছে ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পূর্ববাংলার আইবি স্পেশাল সুপাররিনটেন্ডেন্ট পুলিশ এম ইউসুফ শেখ মুজিবের সামগ্রিক রাজনৈতিক জীবনের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক জীবন, তার আয় এবং এ যাবৎ রাজনৈতিক কার্যাবলির বিবরণ দেন। তিনি লেখেন, ‘পিতা ও স্ত্রীর সম্পত্তি থেকে যে আয় আসে, তা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মাসিক একটা ভাতা পান, তা দিয়েই তিনি চলেন’ (গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৩১৯)। শুধু আর্থিক সহযোগিতাই নয়, স্বামীর রাজনীতিতে তার উৎসাহ-অনুপ্রেরণারও কোনো কমতি ছিল না। ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইনে গ্রেফতার হলে তার পুরো পরিবার মিন্টো রোডের বাসা ছেড়ে সেগুনবাগিচার ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া নেন। ১৯৬১ সাল থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি মূলত ফজিলাতুন্নেছাই গড়ে তোলেন একটু একটু করে। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি গণভবনেও যাননি, বঙ্গভবনেও যাননি। নিজের হাতে গড়া বাড়িতেই ছিলেন আর এখানেই তিনি পুরো পরিবার নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন। সত্যি সত্যিই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন-মরণের সাথী।
রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে ছিলেন, ফজিলাতন্নেছা তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। সেসব কথা কিছু শেখ মুজিবুর রহমান ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন। সেগুলো বিমর্ষতায় ভরা। ১৯৬৭ সালে জেলে থাকার সময় লিখেছেন, “১১ তারিখ রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নিবে না। ঈদ করবে না। কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন করো। এই ঈদটা আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার আব্বা ও মায়ের কাছে বাড়িতেই করে থাকি। ছোট ভাই খুলনা থেকে এসেছিল আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। কারণ কারও কাছে শুনেছিল ঈদের পূর্বেই আমাকে ছেড়ে দিবে। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নাই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট। তাই এখনো বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভালো না, কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এলে রাসেল আমাকে মাঝে মাঝে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। আমিও বেশি আলাপ করতে পারলাম না। শুধু বললাম, ‘চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে। আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কী! তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।’ ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রেণুকে বললাম, বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভালো করে ঈদ করিও। না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে” (পৃষ্ঠা ২০১)। এই হৃদয়ভেজা বিবরণে কার না চোখের কোণে পানি জমে!
এমন দুঃখ দিয়েই শেখ মুজিবের জীবন গড়া। আর সব দুঃখের ভাগীদার ছিলেন তার প্রিয় রেণু। শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে ছিলেন, ফজিলাতুন্নেছা চাইলেই যে তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন, তা নয়। জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে আবেদন জানাতে হতো। কখনো কখনো ওই আবেদন বাতিলও হতো। তখন আবার আবেদন করতে হতো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর। তিনি অনুমতি দিলে জেল কর্তৃপক্ষ দেখা করার সুযোগ দিত। তা এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা। গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর পাতায় পাতায় ভরে আছে জেলে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য কতই না কাঠখড় তাকে পোড়াতে হয়েছে।
আমাদের এ ধারাবাহিক আলোচনায় আমরা এখন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পঞ্চম খ-ে আছি- যাতে বর্ণিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫৮ সালের রাজনৈতিক জীবন। আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি পর পরই ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন। ২০ অক্টোবরের প্রতিবেদনটিতে আছে, ফজিলাতুন্নেছা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে ডিআইজি বরাবর দরখাস্ত লিখেছেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অনুমতি পেলেও জেল কর্তৃপক্ষ দেখা করার অনুমতি দেয়নি। ইংরেজিতে লেখা চিঠিটি বাংলা করলে এ রকম দাঁড়ায়- ‘জনাব, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিক্রমে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার আকুল আবেদন জানাচ্ছি। জেলগেট থেকে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে তিনি নিরাপত্তা বন্দি। প্রতি বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করার অনুমতি দিয়ে বাধিত করুন’ (গোয়েন্দা প্রতিবেদন, পঞ্চম খ-, পৃষ্ঠা ৫১)।
লেখকঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়