4006
Published on নভেম্বর 6, 2020আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবের সাংগঠনিক তৎপরতা যেন আরও বেড়ে যায় ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে। পুরো প্রদেশ ঘুরে ঘুরে প্রান্তিক মানুষের খাদ্য সংকট ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়গুলো বিভিন্ন জনসভায় তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমেও সাক্ষাৎকার দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার পক্ষে কথা বলছিলেন। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের অবিবেচনামূলক আচরণের ফলে পূর্ব পাকিস্তান যে তার ন্যায্য অধিকার হারাচ্ছিল, তাও তিনি জনগণের দৃষ্টি সীমানায় আনছিলেন। গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনেই তার এসব কথাবার্তার সন্ধান মেলে। ১৯৫৮ সালের ৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় তিনি দুই প্রদেশের আর্থসামাজিক বৈষম্যের হৃদয়গ্রাহী এক বিবরণ তুলে ধরেন। ইংরেজিতে লেখা প্রতিবেদনটি বাংলা করলে এমন দাঁড়ায়- ‘আমার যদি যথেষ্ট অর্থ থাকত, তা হলে আপনাদের আমি করাচি নিয়ে যেতাম এবং দেখাতাম পূর্ব পাকিস্তান থেকে আহরিত রাজস্ব দিয়ে তারা কতটি শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছেন। পূর্ব পাকিস্তানকে পুরোপুরি তারা অবহেলা করছেন। আমরা সবকিছুতেই অন্তত ৫০ শতাংশের হিস্যা চাই’ (গোয়েন্দা প্রতিবেদন, পঞ্চম খ-, পৃষ্ঠা ২৮)। ২৪ জুলাই দৈনিক মর্নিং নিউজকে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন। এতে তিনি বলেন- ‘কেন্দ্রীয় সরকার যদি মনে করে তারা আমাদের প্রভু, তা হলে বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমি জানি না, এই করাচিগোষ্ঠী আরও কতদিন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে এ খেলা খেলবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বৈরশাসনের অধীন থাকতে চায়নি। তারা বরাবরই সাংবিধানিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে চেয়েছেন (ওই, পৃষ্ঠা ২৮)।
এর কিছুদিন পর ১ আগস্ট পল্টনে এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ জারি করার তীব্র সমালোচনা করেন শেখ মুজিব। ওই সময়ই দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষের খাদ্য সাহায্য না দিয়ে মুসলিম লীগ ৩০০ জিপ ও ৩ হাজার মাইক্রোফোন কিনতে চাইছিল। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এই টাকা কোত্থেকে আসছে?’ ২৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে আরেকটি জনসভায় অভিযোগ করেন, ‘মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। উদ্দেশ্য- পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আরও শোষণ করা’ (ওই, পৃষ্ঠা ২৯)। একই প্রতিবেদনে গোয়েন্দারা লিখেছেন, ‘অধুনা বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার আগ দিয়ে তার বিশ্বস্ত কর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তারা যেন সামরিক আইন প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে চুপ থাকেন। কিন্তু তারা যেন গোপনে মুখে মুখে বলে বেড়ান যে- (ক) পূর্ব পাকিস্তানে পাঞ্জাবি শাসন জারির অংশ হিসেবেই সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই কথাও বলে যান যে, বাংলা ভাষার কোনো ভবিষ্যৎ রইল না। (খ) পূর্ব-পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে। (গ) পূর্ব পাকিস্তান চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেল’ (ওই, পৃষ্ঠা ২৯)। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের খুবই সক্রিয় ও প্রভাবশালী সদস্য। তিনি খুবই ভালো সংগঠক। তবে তিনি খুবই উচ্চাভিলাষী।’
এসব প্রতিবেদন থেকে আঁচ-অনুমান করা যায়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে খুবই ভয় পেতেন এবং গুরুত্ব দিতেন। তাই সামরিক আইন জারি হওয়ার পর পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। মোনায়েম সরকার তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি’ প্রথম খ-ের অষ্টম অধ্যায় ‘আইয়ুব খানের সামরিক শাসন (১৯৫৮-৬২) পূর্ব পাকিস্তান, রাজনীতি, শেখ মুজিব ও বিভিন্ন আন্দোলন’-এ লিখেছেন, ‘দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট দেখিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এক অধ্যাদেশবলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাগুলো বরখাস্ত এবং দেশের শাসনতন্ত্র অবৈধভাবে বাতিল করেন’ (পৃষ্ঠা ২৮৪)। উইকিপিডিয়ার ইংরেজি ভার্সনে আছে ৭ ও ৮ তারিখের মধ্যরাতে ইস্কান্দার মির্জা এই অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। অনেক রাজনীতিবিদ পরদিন সকালে খবর পেয়েছেন, দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন করাচিতেই ছিলেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির খবর পান তিনি তেজগাঁও বিমানবন্দর নেমে। ‘তার সামনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত চরম দুঃসংবাদটি তুলে ধরা হয়। তিনি বুঝলেন যে, বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য তার সংগ্রাম চরম দুর্যোগের মধ্যে নিপতিত হলো’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮৬)।
গোয়েন্দা প্রতিবেদেনে সামরিক শাসন জারি সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের করাচি থেকে ঢাকা ফেরার খবরটি আছে। তাও গোয়েন্দা বিভাগ যথাসময়ে সংরক্ষণ করতে পারেনি। ১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবরের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যে ৮ অক্টোবর করাচি থেকে ফিরেছেন, এ খবরটি ইমিগ্রেশন অফিসার জানাননি। টেলিফোন বার্তায় খবরটি গোয়েন্দা বিভাগকে জানানো হয় ১০ অক্টোবর’ (গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ৫ম খ-, ১৬ নম্বর প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ৩৯)।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় ১১ অক্টোবর। অনেক স্থানে সেটি ১২ তারিখ দেখানো হয়। মোনায়েম সরকারও ১২ তারিখ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এ ১১ তারিখই দেখানো হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ১২ অক্টোবরের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘১২ অক্টোবর সকাল ৮টায় জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪২)। একদিন আগে-পরের বিষয়টি ভুলবশত নয়, কোনো কারণবশতই নির্ধারিত হয়েছে। হয়তো আগের রাতেই তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে পরের দিন সকালে। তাই বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট দেখাচ্ছে ১১ তারিখ। আর গোয়েন্দারা দেখাচ্ছেন পরদিন কারাগারে আনার পর থেকে। মোনায়েম সরকার অবশ্য বলেছেন, ‘২০ অক্টোবর থেকে তাকে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়’ (‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি’, মোনায়েম সরকার সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি ২০০৮, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা ২৮৬)।
আটক হওয়ার পর শেখ মুজিব তার সহকর্মীদের হতাশ না হতে বলেন। যেসব কর্মী জেলখানার গেট পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তাদের তিনি বলেন সামরিক শাসন বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু এবার তাকে টানা ১৪ মাস জেলে থাকতে হয়। আর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনও স্থায়ী হয় ১০ বছর। এ দশ বছরের বেশিরভাগ সময়ই শেখ মুজিবকে জেলে থাকতে হয়। শুরু হয় তার দীর্ঘ মর্মান্তিক, নিষ্ঠুর জেলজীবন। এ জীবনের ভোগান্তি তাকে একাই যে শুধু পোহাতে হয়েছে, তা নয়। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তার পুরো পরিবারকে। ছেলেমেয়েরা ছিলেন পিতাহারা, স্ত্রী ছিলেন স্বামীহারা। মোনায়েম সরকার লিখেছেন, “শেখ মুজিবকে জেলে বন্দি করে রাখার পর তার পরিবারের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ওই অবস্থাতেও শেখ মুজিব প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার জন্য বেগম মুজিবকে উপদেশ দিয়েছেন। শেখ মুজিব ছিলেন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা। তিনি ছিলেন সুশৃঙ্খল, নিয়মনিষ্ঠ ও পরিবারপ্রিয় ব্যক্তি। পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের বড় জামাতা ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া তার রচিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে লিখেছেন” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮৮-২৮৯)।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ১৯ নম্বর প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ১২ অক্টোবর ভোর ৬ থেকে ৭টার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ১১৭ সেগুনবাগিচার বাড়ি গিয়ে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং তার বাড়িতে তল্লাশি চালায়। ওই তল্লাশির ভিত্তিতে তার সম্পত্তির একটি হিসাব দেখানো হয়- যার অনেকখানিই মিথ্যা/বানোয়াট বলে বোঝা যায়। যেমন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান নিজের নামে কোনো সম্পত্তি করেননি। তার বেশিরভাগ সম্পত্তিই তার আত্মীয়স্বজন ও বিশ্বস্ত বন্ধুদের নামে’ (গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩)। তার যদি এত সম্পত্তি থাকত, তা হলে পরিবারকে আর গ্রামে পাঠানোর চিন্তা করতে হতো না। তার পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট পরবর্তীকালে আমরা দেখব।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে পাকিস্তান আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম স্বাক্ষরিত একটি পিটিশন দাখিল করা হয়। ১৭ অক্টোবরের প্রতিবেদন (প্রতিদেন নম্বর ২০) থেকে জানা গেছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন পাকিস্তান আন্দোলনের সাহসী কর্মীদের মধ্যেও সবচেয়ে সাহসী। তিনি প্রথম শ্রেণির মুসলিম লীগ কর্মী। বিনা বিচারে এর আগে তিনি দীর্ঘকাল জেল খেটেছেন। ১৯৪৮ সাল থেকে আড়াই বছর জেল খেটে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। আবারও বিনা অপরাধে নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এমনিতেই অসুস্থ, চিকিৎসাধীন। আবারও তাকে আটক করে একটা জীবন-মরণের হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭)।
১৫০ নম্বর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের নির্দেশে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে ১৫২ নম্বর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গোয়েন্দা বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্টের অনুমতি ছাড়া তিনি কোথাও যেতে পারবেন না। রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত বলে তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নিতে পারবেন না। আর জনজীবন বিপন্ন হতে পারে- এমন কোনো মতামত প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কাউকে দেবেন না।
লেখকঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়