বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের জাতীয় সংগীতঃ দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার প্রস্ফুটন

1103

Published on নভেম্বর 1, 2020
  • Details Image

ড. মীর মেহবুব আলম নাহিদঃ

বঙ্গবন্ধু। তিনি এ মহাবিশ্বের “বিষ্ময় পুরুষ”। তাঁর পঞ্চান্ন বছর পাঁচ মাসের বীরোচিত জীবনে ৪৬৮২ দিন কারাগারে অন্তরীণ থেকেছেন। তিনি জাতিকে কী কী দিয়ে গেছেন হয়তো সে বিষয়ে ভাববার এক চিলতে সময় আমাদের নেই অথবা আমাদের মধ্যে সেই দেশাত্মবোধ কাজই করেনা। তিনি দিয়েছেন একটি স্বাধীন ভূখন্ড ও তার উপর মুক্ত আকাশ; তিনি উপহার দিয়েছেন একটি জাতীয় পতাকা এবং দিয়েছেন জাতীয় সংগীত। জীবনব্যাপী তাঁর সংগ্রাম, অবদান এবং অর্জনে তিনি হয়ে ওঠেন “বাঙালি জাতির জনক”। পিতা, আপনার স্বপ্ন পূরণে আপনারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার শক্ত হাতে আপনার পতাকা, আপনার দেয়া জাতীয় সংগীতের সুরে-ছন্দে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে আপনার বাংলাদেশ। পিতা, আপনার এ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে আমি গর্বিত।

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত। গানটি বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন বাঙালিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। স্বদেশী কর্মীরা এবং বিপ্লবীরা এই গানটিকে বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমের চেতনায় আলোড়িত করবার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ১৯২০ এর দশক থেকে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের পতনের সাথে সাথে এই গানটির প্রচলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে গানটি পুনরায় প্রাণ পায় এবং আমাদের হয়ে ওঠে।

ইতিহাসের আলোকে দেখা যায় ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগ আয়োজিত এক সভায় গানটি বাজানো হয়। বিশেষ করে ৭ই মার্চ, ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে গানটি বাজানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২৩শে মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা উপলক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে এটি বাজানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার এই গানটিকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং সে অনুযায়ী গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হতো।

বাংলাদেশ সংবিধান ৪.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গানটিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেছে। যার প্রথম দশ লাইন কন্ঠ সংগীত হিসেবে এবং প্রথম চার লাইন যন্ত্র সংগীতের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রিয় পিতা, কে জানতো ১৭ই মার্চ, ১৯২০ সালে এই পৃথিবীতে আপনার শুভাগমনের পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১] আপনার জন্য ১৯০৬ সালে, আপনার বাংলাদেশ জন্মের ৬৫ বছর পূর্বেই এমন গান রচনা করবেন, যে গানকে আপনি আমাদের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দেবেন।

জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের যথার্থ সম্মান দিচ্ছি কি আমরা, প্রতিদিন? সম্ভবত না। কিশোর আর তরুণদের সুনাগরিক হিসেবে তৈরি করবার জন্য, তাদের মনে দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবার জন্য এই দু’টির থেকে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় উপকরণ বুঝি আর নেই। এখন প্রশ্ন যে কীভাবে সেটা তৈরি করা সম্ভব? খুবই সহজ। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, আমি বরাবরের মতোই খুব আশাবাদী এই শ্রেণিকে নিয়ে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই শ্রেণির কল্যাণই এখন আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া জরুরি। আপনার কাছে আমার এই ভাবনাটি বা প্রস্তাবটি হাস্যকর মনে হলেও এটাই সত্য। বলছি শুনুন...

“বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ: মূল্যবোধের পুননির্মাণ ভাবনা” শিরোনামের পূর্ববর্তী লেখায় বলেছিলাম “আমাদের অন্বেষণ হোক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ^াসী প্রতিশ্রুত তরুণ, আওয়ামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যে অবিচল-অনঢ়।” আমরা যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছি তারা নিশ্চয়ই দেখেছি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে সকালবেলা ক্লাস শুরুর আগে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে স্কুলের সামনের মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আনুষ্ঠানিকতা করতেন, নিয়মিত।

অবশ্য শহর অঞ্চলে এর ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যায়। সকালে জমায়েত হবার মতো মাঠ বা স্থান অধিকাংশ স্কুলেই নেই। তাহলে কি এই শিক্ষার্থীরা এই নিয়মের সঙ্গে অভ্যস্থ হবে না? ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে স্কুলের প্রবেশ পথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা থাকবে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে প্রবেশকালেই পতাকাকে সালাম প্রদর্শন করবে। ক্লাস শুরুর পূর্বে নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ কক্ষে থেকেই দাঁড়িয়ে পূর্ণ মর্যাদায় জাতীয় সংগীতে অংশগ্রহণ করবে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বাংলাদেশের সকল ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত। জাতীয় পতাকার প্রতি, জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান জানানোর আরও কিছু নিয়ম আছে যা সবার জন্য অবশ্য পালনীয়। যেমন পতাকাকে সালাম দেবার সময় পতাকার দিকে তাকানো, জাতীয় সংগীত চলাকালীন স্ব-স্ব অবস্থানে সবাইকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে, দুই হাত পাশে মুষ্ঠিবদ্ধ থাকবে, গানটি সমবেতভাবে গাইতেও হবে।

পরিবারের গন্ডি ছাড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের প্রথম দশ বছর অন্তত এই চর্চা চলে নিয়মিত। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও যদি দেশমাতৃকার প্রতি, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বা দেশকে ভালোবাসতে না শিখি, এভাবে যদি মূল্যবোধের স্থিতি না হয় তাহলে তার থেকে হতভাগা আর কে আছে!

বিষয়টিকে খুব হালকা করে দেখবার সুযোগ নেই। এরকম ছোটো ছোটো বিষয়ের অনুশীলনেই শিশু বেড়ে ওঠে, দেশকে ভালোবাসতে শেখে। নয়তো ভয়াবহভাবে বাড়তে থাকবে সাম্প্রতিক সময়ের “কিশোর গ্যাং” এর শাখা প্রশাখা। মনে রাখা জরুরি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় আসীন। সুতরাং, এসব বিষয়ে নজর দেয়া এবং সুষ্ঠুভাবে তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে থাকবে। কিশোর এবং তরুণদের পরিকল্পিতভাবে দেশকে চিনতে সহযোগিতা করতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অভিনব উপায়ে তাদের কাছে প্রচার করতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতীয় সংগীত আর দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার প্রস্ফুটন ঘটবে। আমরা সেই সুন্দর দিনের দিকে তাকিয়ে আছি।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত