2663
Published on অক্টোবর 27, 2020এম নজরুল ইসলামঃ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে চারদিকে যখন নেতিবাচক খবর তখন প্রবৃদ্ধিতে আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে পেছনে ফেলছে প্রতিবেশী দেশগুলোকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, মহামারীর মধ্যেই চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। শুধু ভারতই নয়, চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবৃদ্ধিতে ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই একটি বড় অর্জন। তবে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম আরও জোরদার করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু, যিনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্ধারণ করা সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকারের কারণেই বাংলাদেশের এই অগ্রগতি।
দেশের অর্থনীতিতে করোনার বিরূপ প্রভাব কিভাবে পড়েছে সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। এ সময়ে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে দেশের রফতানি খাতে। রাজস্ব আদায়ের হার আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। চাকরি হারিয়েছে লাখো মানুষ। অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল করোনার কারণে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার অপেক্ষার প্রহর বাড়বে। কিন্তু জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি এবং সরকারের পর্যবেক্ষণে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। এই চিত্রটি খুবই ইতিবাচক। কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি এবং সরকারের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে যে স্বপ্ন রয়েছে তাতে করোনা কোন প্রভাব ফেলবে না। মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই তিন সূচক অর্জন করতে পারলে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেয়া হয়। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘে যে পর্যালোচনা হওয়ার কথা রয়েছে, সিডিপি ও সরকারের যৌথ প্রতিবেদনে দেখা গেছে সেখানে বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
প্রতিবছরই বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো যে পূর্বাভাস দেয় তার সঙ্গে সরকারের প্রাক্কলনের বড় ধরনের ফারাক দেখা যায়। এ নিয়ে বিতর্কও কম হয় না। এবারও দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা মত দেখা যাচ্ছে। করোনাকালে প্রবৃদ্ধি নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে বিতর্ক। বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার প্রভাবে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ শতাংশের নিচে। আরেক বহুজাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে চলতি বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। আরেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অবশ্য বলছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৮ শতাংশ। এখন থেকে ছয় মাস আগে বহুজাতিক সংস্থা আইএমএফ জানিয়েছিল করোনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে। ছয় মাস পর এসে এখন আইএমএফ বলছে, চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৮ শতাংশ। আর আসছে ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হবে ৪.৪ শতাংশ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের যৌথ বার্ষিক সভায় প্রকাশ করা আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলছে, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি।
উল্লেখ্য, অন্য সংস্থাগুলো প্রবৃদ্ধির হিসাব করে থাকে অর্থবছর ধরে। আর আইএমএফ প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করে থাকে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকাবর্ষ ধরে। আইএমএফের মতে করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে প্রথম কয়েক মাস ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকলেও জুলাই থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে। সংস্থাটির মতে, চলতি বছর যে ২২টি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হতে পারে সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে বলেও জানিয়েছে আইএমএফ।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শীর্ষ প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের বরাত দিয়ে বিজনেস টুডে এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৮৮৮ ডলারে উন্নীত হতে পারে। এদিকে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি সাড়ে ১০ শতাংশ কমে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নামবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা গত চার বছরে সর্বনিম্ন। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশের যৌগিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হারে (সিএজিআর), যা ভারতের ক্ষেত্রে ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে দ্রুত বর্ধমান রফতানি খাত, দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হারের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির যথেষ্ট অবদান আছে। বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের রফতানির সঙ্গে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে।
এখন থেকে এক মাস আগে আরেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৮ শতাংশ। ম্যানিলাভিত্তিক সংস্থাটির মতে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি, রফতানি ও রেমিট্যান্স সাফল্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। একই সঙ্গে করোনা মহামারী সঙ্কট কেটে যাচ্ছে। ফলে আশা করা যায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে ৬.৮ শতাংশ।
অপুষ্টির হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতি অব্যাহত থাকায় ক্ষুধামুক্তির লড়াইয়েও গত এক বছরে বড় অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট সম্প্রতি চলতি বছরের যে ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ প্রকাশ করেছে তাতে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উঠে এসেছে ৭৫তম অবস্থানে। কেবল সূচকের অবস্থানে অগ্রগতি নয়, যে চার মাপকাঠিতে বিচার করে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা জিএইচআই করা হয় তার সবগুলোতেই গতবারের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ স্কোরের দিক দিয়েও এক ধাক্কায় অনেকটা উন্নতি করতে পেরেছে। ক্ষুধা সূচক বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ অপুষ্টির শিকার, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম, ওই বয়সী শিশুদের ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের অনুপাতে কম এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ৩ শতাংশ।
তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি যখন নেতিবাচক ধারায় তখন ইতিবাচক পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির আগেই স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে এখন বাংলাদেশ। একটি সমৃদ্ধ দেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।
লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি, অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক
সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ