1370
Published on অক্টোবর 18, 2020গোলাম কুদ্দুছঃ
প্রবহমান নদী, পাহাড়ের নির্জনতা, অরণ্যের মৃদুমন্দ হাওয়া, উত্তরের বরফের নদী-নীলিমার বিশালতা কিংবা মাটির গভীরতা অতিক্রমে স্রষ্টার সৃষ্টিকে কখনও উপহাস ও ছিন্নভিন্ন করেনি জাগতিক বা মহাজাগতিক কোন শক্তি। প্রকৃতি যা করেনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মানবকুলে যা কখনও ঘটেনি-কাঁদামাটির সোঁদা গন্ধে ভরা বাংলার মাটি তা প্রত্যক্ষ করল কোন এক কালরাতের শেষ প্রহরে।
নীরব-নিস্তব্ধ রাজধানী ঢাকা। রিক্সার টুংটাং শব্দ, ক্ষ্যাপা কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকার আর মাঝে-মধ্যে সুরিখানার কিছু মাতালের গোঙানির আওয়াজ এদিক-সেদিক। ঘুমের চাদর মুড়ি দিয়ে সুখনিদ্রায় নগরবাসী। বিলাসবহুল অট্টালিকা, ছাত্রাবাস, রেললাইনের বস্তি- সাড়াশব্দ নেই কোথাও। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটিতেও কোন ব্যতিক্রম ছিল না সেদিন। বাঙালী জাতি রাষ্ট্রের স্রষ্টা ঘুমিয়ে আছেন এ বাড়ির সাদামাটা একটি কক্ষে। পরিবারের বাকি সদস্যরাও প্রতিদিনকার মতো নিদ্রামগ্ন। কিছু অস্ত্রধারী জেগে আছে নিয়মমাফিক পাহারায়।
কে জানত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই রাত বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করবে। গোপনে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করা হয়েছিল তার প্রয়োগ হবে এই রাতে। মনুষত্ব, মানবিকতার আদর্শচ্যুত মানুষরূপী একদল হায়েনার বর্বরতায় নিকশ অন্ধকারে এই রাত্রি পরিণত হবে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম শেষ প্রহরে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার উদ্দেশ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক আর সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে বের হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির ক্রীড়নক সেনাবাহিনীর ক্ষমতালোভী ক্ষুদ্র একটি অংশ। নৃশংসভাবে তারা হত্যা করল জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, দুই পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামালকে সস্ত্রীক নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকের দল। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল সেই হত্যাকান্ডের ভয়ঙ্কর সময়ে লুকিয়ে থাকে সেন্ট্রি পোস্টের পেছনে। পরিবারের সবাইকে হত্যা করে খুনীরা খুঁজতে থাকে শিশু রাসেলকেও। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়ে যায়। ভয়ার্ত রাসেল কাঁদতে থাকে আর বলে, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’ সশস্ত্র ঘাতক বলে, চল্ তোর মায়ের কাছে। টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলায়। বাবা-মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে আঁতকে ওঠে আর কাঁদতে থাকে রাসেল, যেন হিমালয়ের সমান কষ্ট তার বুকে..। বাংলার তেরো শ’ নদী সব জল গড়িয়ে পড়ে তার দু’গাল বেয়ে। সামান্য দেরিও যেন সহস্র আলোকবর্ষসম খুনীদের কাছে। ঘাতকের দল মায়ের কাছে নিয়ে শিশু রাসেলকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়। নিথর নরম শরীর আঁছড়ে পড়ে মায়ের শরীরে। এমন নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকা- এর আগে কখনও দেখেনি কেউ। রাসেলের তখন কতই বা বয়স, দশ বা এগারো বছর। জন্ম থেকেই পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত। মায়ের আদর-স্নেহেই একটু একটু করে বেড়ে ওঠে। বাঙালীর মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু তো কারাগারেই কাটিয়েছেন জীবনের প্রায় তেরোটি বছর। শিশুপুত্রকে আদর করার, সোহাগ করার সুযোগই তো হয়নি তাঁর। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্মমতায় স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত রাসেল যখন পিতৃস্নেহ পেতে শুরু করল তখনই নিষ্ঠুর রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভ তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল। মুহূর্তেই যেন পূর্ণিমার আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। পৃথিবীর সমস্ত নদী যেন শুকিয়ে গেল। দুধেল গাভীর ওলান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে কাদামাটি লাল বর্ণ ধারণ করল। অচেনা এক ভোরের নির্মল বায়ু বারুদ আর লোবানের গন্ধে ভারি হয়ে উঠল।
প্রতিবছর অক্টোবর এলেই মনে পড়ে শিশু রাসেলের কথা। জরা-রোগব্যাধি কিংবা নিছক দুর্ঘটানায় তার মৃত্যু হয়নি। জাতির জনক আর রাষ্ট্রপতির কনিষ্ঠ পুত্র হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গভবন কিংবা গণভবনের আলোক ঝলমল পরিবেশে মখমলের বিছানায় থাকার কোন আগ্রহ বা সুযোগ হয়নি তার। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের বেড়াজাল শিশু রাসেলের চঞ্চলতা আর সারল্যকে অবদমিত করতে পারেনি কখনও। শিশুসুলভ মুখরতায় ঘুরে বেড়িয়েছে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক সেই বাড়ির প্রতিটি কক্ষ আর আঙ্গিনাজুড়ে। ধানমণ্ডি লেকের বৃক্ষারাজি আর কলকাকলিতে মুখর পাখিদের সঙ্গে যেন এক অজানা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে শিশু রাসেলের। কালরাত্রির শেষ প্রহরে শয়তানের নিষিদ্ধ গোলার দ্রিম দ্রিম শব্দ আর সাঁজোয়া গাড়ির কুৎসিত আলোয় উড়ে যায় পাখিদের সঙ্গে-যুথবদ্ধভাবে তার থাকার বাসনা। এমনকি সেও উড়ে গেল পাখিদের খোঁজে, অজানা-অচেনা কোন এক স্বপ্নলোকে।
পাখিদের প্রেম আছে, ভালবাসা আছে। এক কাক মরে গেলে শত কাক উড়ে এসে-কা কা রবে বিষণœ করে তোলে প্রকৃতি আর পরিবেশ। শোকের মাতম উঠে গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায়, দালানের ছাদ, লাইটপোস্টের ডানা আর শূন্য আকাশের বিশাল প্রান্তরজুড়ে। পাখিদের মধ্যে কাকের অবস্থান হরিজন পর্যায়ে। কাকের স্বভাব আর কর্কশ শব্দ অনিষ্টের প্রতীক বলে লোকসমাজে কুসংস্কার রয়েছে। তবে সেই কাকের চেয়েও কর্কশ আর অমঙ্গলের মানুষ রয়েছে আমাদের সমাজে। এরা নারী-পুরুষের বর্বর হত্যাকাণ্ডে ব্যথিত হয় না, শিশুদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়া খুনীদের বাহ্বা দেয়। মাতৃগর্ভের সন্তানকে যারা গুলি করে হত্যা করে- সেই নরপশুদের করে পুরস্কৃত। সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে যায় এই ঘাতকরা। ওরা হাতের মেহেদী আর আলতাপরা নববধূর আনন্দকে ক্ষমতার লোভ আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। যে নারী জীবনের সকল আনন্দ, ভোগ-বিলাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানুষের অধিকার ও বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য স্বামীকে সঁপে দিয়েছিলেন মহাকালে রথযাত্রায় তারও জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে এই পাষণ্ড খুনীর দল। মাতৃসম এই মহীয়সী নারীর বুক ঝাঁঝরা করে দিতে একবারও হাত কাঁপল না এই খুনীদের?
সে সময় এই খুনীদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করে অদ্ভুত এক কালো আইন জারি করা হয় এই বাংলাদেশে। ‘পনেরো আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না, শাস্তি দেয়া যাবে না।’ পরে দেখলাম খুনীরা রাষ্ট্রদূত হলো, এমপি হলো, রাজনৈতিক দল গঠন করল- আরও কত কী? কে তাদের এসব সুযোগ করে দিয়েছিল? তিনি আর কেউ নন, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোস্তাক আর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ভাবতে অবাক লাগে- একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জেনারেল জিয়া কীভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেন, পুরস্কৃত করলেন! তার নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়েও কি একবার রাসেলের কথা মনে পড়েনি? ক্ষমতা মানুষকে এত অন্ধ করে দেয়? বিবেক-মনুষ্যত্ব সবই কি ক্ষমতার মোহ আর প্রতিহিংসার কাছে হারিয়ে যায়?
আজ আমরা রাসেলের জন্য শোকের বিলাপ করব না। খুনীরা তাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সকল অপচেষ্টা আজ শতভাগ ব্যর্থ। রাসেল আজ বাংলার শিশু-কিশোর-তরুণদের ভালবাসার নাম। নির্যাতিত-নিপীড়িত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত শিশুদের প্রতীক হয়ে গ্রাম-বাংলার প্রতিটি লোকালয়ে রাসেল আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মানবিক চেতনা আর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রাসেলের কষ্ট-বেদনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশুর মুখের হাসি ফোঁটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। খুনী-ঘাতকের আস্তানা ছিন্নভিন্ন করে শান্তি ও মানবিকতার আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে- মুছে দিতে হবে তার প্রিয় হাসিনা’বু আর রেহানা আপু’র অশ্রুজল।
লেখক : গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ