1710
Published on আগস্ট 7, 2020সুজাত মনসুরঃ
দিনটি ৫ আগস্ট, সনটি ছিল ১৯৪৯। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিই আজকে কাঁধে তুলে নিতেন পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব। আমরা পেতাম পিতা শেখ মুজিব আর বড় বোন শেখ হাসিনার মতো একজন দক্ষ দেশ ও জনগণের সেবক। ১৫ আগস্ট বিয়োগান্তক ঘটনায় নিহত আরেকজন মহীয়সী নারীর জন্ম তারিখও কিন্তু একই মাসে। শেখ কামালের জন্মদিনের মাত্র তিনদিন পর, আট আগস্ট। তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন-মরণের সঙ্গী শেখ ফজিলাতুননেসা, আমাদের বঙ্গমাতা। যিনি ছিলেন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের নেপথ্য স্থপতি। বঙ্গবন্ধু খোকা থেকে জাতির পিতা হওয়ার নেপথ্য কারিগর। তবে আমি নিশ্চিত তিনি বেঁচে থাকলে কোন অবস্থায়ই তাঁর জন্মদিন ঘটা করে পালন করতে দিতেন না। কেননা, তিনি ছিলেন বরাবরই নিভৃতচারী, আড়ালের মানুষ। তিনি কখনওই প্রকাশিত হতে চাননি। শেখ কামালও প্রকাশিত হতে চাইতেন না, তবে তাঁর কর্মই তাঁকে প্রকাশিত করত সাধারণের মাঝে।
শেখ কামাল হলেন ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত ব্যক্তি। যিনি জন্মের কয়েকমাস পরই দেখেছেন পিতাকে জেলে যেতে। শিশুকালের দুটি বছর কেটে গিয়েছে, নিজের পিতার সঙ্গে পরিচয় হবার সুযোগ ঘটেনি, সান্নিধ্য পাওয়া দূরে থাক, নিজের পিতাকে আব্বা বলেও ডাকতে পারেননি। বড় বোন শেখ হাসিনা যখন একদিন ক্ষণে ক্ষণে কাছে গিয়ে সদ্য জেল ফেরত পিতার আদর নিচ্ছেন আর আব্বা বলে সম্বোধন করছেন, তখন আরেক সন্তান ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে আর ভাবছে তার পিতা কাছে থাকলে সেও এভাবে আদর নিতে ও আব্বা বলে ডাকতে পারতেন।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে বদলে দেবার মানসে গড়ে ওঠা ছাব্বিশ বছরের টগবগে যুবক শেখ কামালের জীবনের শুরু এক আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আর যবনিকাপাত আরেক আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ শুরুর প্রত্যুষে। শুরু থেকে শেষ কখনই তিনি সুখের মুখ দেখেছেন বলে মনে হয় না। গোটা জীবনটাই ছিল চ্যালেঞ্জিং, দুঃখ-বেদনা আর ঝড়ঝঞ্ঝাপূর্ণ। এই ঝঞ্ঝাপূর্ণ জীবনের মাঝেই স্বপ্ন বুনেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন দেশের তরুণ সমাজকে জীবনের বাঁকে বাঁকে যুদ্ধজয়ের। গড়ে তুলেছেন দেশের আধুনিক ফুটবল ক্লাব ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়েছে ‘আবাহনী ক্রীড়া কমপ্লেক্সে’। দক্ষতার সঙ্গে খেলতেন ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাংস্কৃতিক ও নাট্যাঙ্গনকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’ ও গ্রæপ থিয়েটার ‘নাট্যচক্র’। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের সাথেও যুক্ত। খুব ভালো অভিনয় করতেন ও গান গাইতে পারতেন, বাজাতেন সেতার, ছিলেন ছায়াটনের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু পরিবারে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা সব সময়ই ছিল। বঙ্গমাতা এ বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। শুধু তাই নয়, সবকিছুতেই একটা পরিমিতবোধ শিক্ষা দেয়া হতো। শেখ কামাল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ রেহানা লিখেছেন, ‘আমাদের সময়ে জামা-কাপড়ের সংখ্যা তো কারোই বেশি ছিল না। কামাল ভাই, জামাল ভাই কারোই না। কামাল ভাই খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। খুব গুছিয়ে রাখতেন সবকিছু। কিন্তু বেশি কিছুই চাইতেন না। আমার কাছে এসে হয়তো কোনদিন বলতেন, দশটা টাকা দিবি? বিড়ি-সিগারেট কোনদিন খাননি। খরচ তো কিছুই ছিল না। কত যে তাঁর গুণ ছিল। আমি তো বলি, আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি তাদের মামার একটা গুণও পায়, সেও হবে অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। কামাল ভাই সেতার বাজাতেন। ধরা যাক, বাড়িতে অনেক মানুষ। আমার পরীক্ষা। পড়ব কোথায়? পড়ার জায়গার খোঁজে ছাদে গেছি। গিয়ে দেখি কামাল ভাই। হাতে সেতার। আকাশে চাঁদ। চারদিক থই থই করছে জোছনায়। কামাল ভাই বললেন, পড়তে হবে না আজকে। অত পড়ে কি করবি? আয় আমার সঙ্গে বস। গান ধর। আমি তাঁর সঙ্গে গান ধরলাম। একজন-দু’জন করে এসে বসে পড়ল পাশে। জামাল ভাই এলেন। হাসু আপা এলেন। আমরা গান করছি। আকাশে তখন চাঁদ, নারকেলের পাতার ফাঁকে অকৃপণ আলো বিলাচ্ছে কোনায় কোনায়। হাসু আপার কোলে রাসেল, তার ঢুলু ঢুলু চোখে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। হাসনাহেনার গন্ধ বয়ে আনছে রাতের বাতাস।’
সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন একজন নেপথ্যের কর্মী হিসেবে। কখনওই নেতৃত্বের আসনে বসেননি বা বসার ইচ্ছে পোষণ করেননি। এখন যেভাবে বাবা কিংবা মা জীবিত অবস্থায়ই রাজনীতিতে আসন করে নেবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যেতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। এরকম দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই সরাসরি পরিচয় ও কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল ফজলের সঙ্গে। সেই পরিচয় ও তাঁদের মধ্যে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করেছেন শেখ কামাল সম্পর্কিত একটি লেখায়। তিনি লিখেছেন:
‘লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে,
: আপনাকে নিতে এসেছি।
বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম,
: তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ?
: জ্বি হ্যাঁ।
নিচু কণ্ঠে জবাব দিল ছেলেটি।
ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল ও নিজে এবং শুরু করল ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠব। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌত‚হল হলো, জিজ্ঞাসা করলাম,
: তুমি কি করো?
: অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিয়োলজিতে।
: ঢাকা থেকে?
: জ্বি হ্যাঁ।
শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম,
: তোমার নাম?
: শেখ কামাল।
: ও তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে।
: জ্বি হ্যাঁ’
তিনি আরও লিখেছেন:
‘এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং কার্ড করার জন্য নিজেই ব্যাগটি নিয়ে কিউর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলে কোনরকম অগ্রাধিকার খাটাতে চাইল না। দেখে আমার খুব ভাল লাগল। যখন ওর পালা এলো তখনই শুধু টিকেটটি বাড়িয়ে দিল। বোর্র্ডিং কার্ড-টার্ড হয়ে যাওয়ার পর বিমান ছাড়া পর্যন্ত ও থেকে যেতে চাইছিল। আমি অনেক বলে-কয়ে ওকে লাউঞ্জ থেকে বিদায় দিলাম। একই দিন ওর গাড়িতে ও আমাকে চারবার লিফ্্ট দিয়েছে, কিন্তু নিজে চারবারও বোধকরি কথা বলেনি। তাতে মনে হলো ও অত্যন্ত স্বল্পবাক।’
বিনয় ও কম কথা বলা বঙ্গবন্ধু পরিবারের চিরায়ত ঐতিহ্য। দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির সন্তান হয়েও তিনি কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। কিন্তু দুঃখজনক হলো বিনয়ী, ভদ্র, সৎ, নিষ্ঠাবান বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি পাগল শেখ কামালকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়ে। শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান হবার কারণে তাঁকে নিয়ে এমন কোন অপপ্রচার ও অপবাদ দেয়া হয়নি যা একজন মানুষের চরিত্রে চরমভাবে কালিমালেপনের জন্য যথেষ্ট নয়। আর সেক্ষেত্রে প্রধানতম ভ‚মিকা রেখেছে মুক্তচিন্তা-মুক্তমত প্রকাশের নামে আমাদের মিডিয়াগুলো। কিন্তু আজ সত্য উদ্ভাসিত।
ক্রমশ শেখ কামালের অসাধারণ গুণাবলীর কথা প্রকাশমান। কেননা সত্য চিরকালের, মিথ্যা ক্ষণিকের। দুঃখ একটাই এক আগস্টে শুরু হওয়া শেখ কামাল নামক অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্বের বর্ণিল ইতিহাস মাত্র ছাব্বিশ বছরের মাথায় আরেক আগস্টেই শেষ হয়ে গেল। অনেকটা অসমাপ্ত গল্পের মতো। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিই হয়তো নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে। যে কাজটি করছেন বড় বোন শেখ হাসিনা। সঙ্গে আছেন ছোট বোন শেখ রেহানা।