1922
Published on আগস্ট 7, 2020মহিবুল ইজদানী খান ডাবলুঃ
১৫ আগস্ট বিশ্বের এক জঘন্যতম ও কলংকময় দিন। এইদিন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রতি বছর এই দিনটি এলেই আমার মনের মাঝে অতীতের অনেক স্মৃতি ভেসে আসে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবউজ্জল নাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন স্বপরিবারে এই মহান নেতাকে হত্যা করা হয় তখন আমি জাতীয় ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর শাখা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। এই সময় আমার রাজনীতির অনেক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন জাতির জনকের জেষ্ঠ্য পুত্র শেখ কামাল (কামাল ভাই)। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পনেরই আগস্ট পর্যন্ত আমার ছাত্র রাজনীতির মধ্যমণি ছিলেন তিনি। কামাল ভাইকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ১৫ আগস্ট পচাত্তরের পূর্ববর্তী সময় কামাল ভাইকে নিয়ে আমার রাজনৈতিক জীবনের কিছু স্মৃতি আজ এই শোকের মাসে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
কোথা থেকে কেমন করে ৪৩ বছর পার হয়ে গেল। আজও জাতির জনকের হত্যাকারীদের বেশ কয়েকজন খুনি দেশের বাহিরে পালিয়ে থাকার কারণে শাস্তি কার্যকর হয়নি। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুঃখ-বেদনা আর কি হতে পারে। সময়, পরিস্থিতি আর পরিবেশের কারণে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়, আর ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তব। পঁচাত্তরে যাদের জন্ম তারা আজ পরিপূর্ণ যুবক। পচাত্তরের পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যা ইতিহাস প্রচার করে বাস্তব ও সত্য ইতিহাস থেকে এসকল তরুণদের অনেক দূরে সরিয়ে রাখে। তাদের এই অপপ্রচারের কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আজ তারা করছে নানা সমালোচনা।
১৯৭২ সাল। আমি তখন ঢাকা আইডিয়াল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আর সভাপতি ছিলেন ফরিদপুরের গোলাম কিবরিয়া। কলেজ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রতিদিন সন্ধায় আমাকে যেতে হতো মিরপুর ৩০ নম্বর রোডে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির অফিসে। উপর তলায় কেন্দ্রীয় অফিস আর নিচের তলায় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অফিস। এখানেই একদিন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল ইসলাম (নুরু ভাই) আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন কামাল ভাইকে। সময়ের তালে তালে ইতিমধ্যে ৪৩ বছর পার হয়ে গেছে। যার ফলে অতীতের অনেক কিছুই এখন আর মনে পরে না। আবার অনেক সময় হঠাৎ করেই কিছু কিছু স্মৃতি মনের মাঝে ভেসে উঠে।
কামাল ভাই। শেখ কামাল হিসেবে যিনি সকলের কাছে পরিচিত। তার আরেক পরিচয় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জেষ্ঠ্য পুত্র। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি লে. পদে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা কামাল ভাই জেনারেল ওসমানীর পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্ধালয়ে সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পুনরায় শিক্ষা জীবনে ফিরে আসেন কামাল ভাই। এই সময় কামাল ভাই ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সরাসরি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ দেখাশুনা করতেন তিনি। এই কামাল ভাইকে নিয়ে আমার রাজনৈতিক জীবনের অনেক স্মৃতি আছে যা আমরণ স্বরণীয় হয়ে থাকবে।
সৈয়দ নুরুল ইসলাম (নুরু ভাই) ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। কামাল ভাইয়ের অত্যন্ত কাছের প্রিয় ও বিশস্ত ব্যক্তি। ঐসময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখার জন্য কামাল ভাই নুরু ভাইয়ের উপর অত্যন্ত আস্থা ও নির্ভরশীল ছিলেন। কামাল ভাইয়ের একজন বিশস্ত ও একনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে নুরু ভাইয়ের জনপ্রিয়তা ছিল অসীম। ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নুরু ভাই ও কামাল ভাইয়ের কাছের ব্যক্তি হিসেবে আরো ছিলেন আব্দুর রউফ শিকদার, মোহাম্মদ ইউনুস, কামাল মজুমদার, পারভীন সুলতানা নাজমা বেগম, মুবারক হোসেন সেলিম, আব্দুস সামাদ পিন্টুসহ আরো কয়েকজন যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের সকলের আলাদাভাবে দেখাশুনা হতো একটু বেশি। আমাদের এই গ্রুপকে কামাল ভাই একটু ভিন্নভাবে দেখতেন বলে ছাত্রলীগের অনেকের ঈর্ষাও হতো একটু বেশি।
কামাল ভাইয়ের খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। বিশেষ করে ফুটবল। ঢাকার আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় ছাত্রলীগ গঠনের পর একসময় কামাল ভাই জাতীয় ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর ও জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে একটি প্রীতি ফুটবল খেলার উদ্যোগ নিলেন। খেলার স্থান ঠিক করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠ। সেদিনের সেই প্রীতি ফুটবল খেলায় আমিও খেলেছিলাম। খেলায় কোন পক্ষ জিতেছিল তা ঠিক মনে নেই। তবে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেকেই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে এখনো সক্রিয়। এখানে যাদের নাম আমার মনে আছে তারা হলেন, ওবায়দুল কাদের, ডাক্তার মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, শেখ শহীদুল ইসলাম, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইসমত কাদির গামা, মনিরুল হক চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মিলন, মমতাজ হোসেন, চন্দন সরকার, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মুকুল বোস, মোহাম্মদ ইউনুস, আব্দুর রউফ শিকদার, শেখ কামাল, গেন্ডারিয়ার প্যাটেল, কামাল মজুমদার, তেজগাঁও কলেজের তাহের, তিতুমীর কলেজের রফিক, জগন্নাথ কলেজের মোজাম্মেল, মতিঝিল টিএ্যান্ডটি কলেজের কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া, ঢাকা কলেজের আজিজ বাঙাল, হাবিবুর রশিদসহ আরো অনেকে। খেলার শেষে আমরা একত্রে কামাল ভাইকে সাথে নিয়ে ছবিও তুলেছিলাম।
কামাল ভাই তাঁর সারাদিনের কাজের শেষে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অফিসে এসে আমাদের সকলের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি যেমনই ছিলেন কমল মনের অধিকারী তেমনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের কর্মীরা ছিল তার প্রাণের চেয়েও বেশি। সঠিক মনে পরছে না তবে ৭৩-এর শেষে সম্ভবত কোনো এক মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা আসেন। ঢাকার মিরপুর মোহাম্মদপুরের বিহারী, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও জামাত মুসলিম লীগ পন্থীরা ঢাকার তৎকালীন তেজগাঁও বিমান বন্দরে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে স্বাগত জানায়। এ ছিল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির জন্য এক বিরাট অপমান, এক বিরাট আঘাত। ভুট্টো সেই ব্যক্তি যার কারণে বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সেই মানুষটিকে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সবকিছু ভুলে গিয়ে এতবড় সম্বর্ধনা! এর বিহিত অবশ্যই একটা করা উচিত। ভুট্টোকে বুঝতে হবে বাংলার স্বাধীনচেতা মানুষ তোমাকে চায় না। যারা তোমাকে স্বাগত জানিয়েছে তারা পাকিস্তানের মুষ্টিমেও দালাল।
ঐদিন সন্ধ্যায় মিরপুর ৩০ নাম্বার রোডে ছাত্রলীগ অফিসে এসে আমরা সকলে মিলিত হলাম। ছাত্রলীগ কর্মীদের মুখে চোখে তখন সংগ্রামী প্রতিবাদী কণ্ঠ আগুনের মত জ্বলছে। এত বড় অপমান কি করে সহ্য করা যায়। এর একটা বিহিত করতেই হবে। ভুট্টোকে দেখাতে হবে, প্রতিবাদ করে বলতে হবে, আমরা তোমার রক্ত মাখা হাতের কথা ভুলিনি, কখনো ভুলবো না, ভুলতে পারি না। রাতে ছাত্রলীগ অফিসে বসে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান, প্রচার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনসহ আমরা সকলেই একসাথে সিদ্ধান্ত নিলাম ভুট্টোকে আগামীকাল সাভার স্মৃতিসৌধে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি।
আগামীকাল সকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন সাভার স্মৃতিসৌধে শহীদদের সম্মানে মাল্যদানে যাবেন তখন তাকে আমরা কালো পতাকা প্রদর্শন করবো। সিদ্ধান্ত অনুসারে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ অফিসে সারারাত ধরে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হলো। শুরু হলো পোস্টার আর ব্যানার লেখার কাজ। রাতে ঢাকা নিউমার্কেট পোস্ট অফিস সংলগ্ন আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে গিয়ে পোস্টার ও ব্যানার লেখার জন্য যাবতীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসি। সারারাত ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ, সেন্ট্রাল কলেজ, ইডেন কলেজসহ আসে পাশের অন্যান্য কলেজগুলোতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের খুব ভোরে মিরপুর রোড ছাত্রলীগ অফিসের সামনে আসতে বলা হলো। এ ব্যাপারে আইডিয়াল কলেজ ছাত্রলীগের আব্দুস সামাদ পিন্টু (বর্তমানে মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ) মামুন সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজের আব্দুর রউফ শিকদার (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা মিরপুর), মোহাম্মদ ইউনুস, সেলিম (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা), দেলওয়ার, পারভেজ, সামীম (বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাসচিব সামীম মোহাম্মদ আফজাল), পারভীন (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী) ও নাজমা বেগম (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) লালমাটিয়া কলেজ, ফজিলাতুন্নেসা (বর্তমানে এমপি) ইডেন কলেজ, নুরুল হক খান সেলিম নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ, আবু তাহের তেজগাঁও কলেজ, রফিক তিতুমীর কলেজ নেতৃবর্গের উপর কর্মী জড় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোবহানবাগ, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর, কলেজগেট, রায়ের বাজার, কাটাসুর, জিগাতলা এলাকার কর্মীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। ঐদিন রাতে আমরা কয়েকজন তেজগাঁও রেলক্রসিং এর পাশে গিয়ে কয়েকটি ট্রাক ভাড়া করি। গভীর রাতে আমাদের কর্মতৎপরতার খবর পেয়ে কামাল ভাই ছুটে আসেন আমাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। আমি আগেই বলেছি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ ছিল কামাল ভাইয়ের প্রাণপ্রিয় সংগঠন, অতি প্রিয় সংগঠন। আমাদের সকলকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাই এত রাত হওয়া সত্তেও তিনি আমাদের পাশে এসে উৎসাহ দিতে কোনো কৃপণতা করেননি। কামাল ভাইকে এত রাতে ছাত্রলীগ অফিসে দেখে কর্মীদের মনে আরো প্রেরণা ও উৎসাহ বৃদ্ধি পায়।
পরদিন সকাল সকাল আমরা কয়েকটি ট্রাকে করে সাভার স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে রওনা হলাম। এই সময় আমাদের মুখে ছিল স্লোগান ও হাতে ছিল ব্যানার আর প্লাকার্ড। এখানে এসে আমরা সকলেই রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে স্লোগান দিতে থাকি। পুরো এলাকা ঘিরে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ক্যামেরা হাতে ভুট্টোর জন্য অপেক্ষায়। এখানে উল্লেখ্য যে ভুট্টো ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এত বড় সম্বর্ধনার জোয়ার দেখে ঢাকা থেকে সড়ক পথে সাভার এসে মাল্যদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে আমাদের প্রতিবাদী মিছিল আর স্লোগানের কথা শুনে নিরাপত্তার অজুহাতে সাহেব তার সে পরিকল্পনা বাতিল করেন। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে একটি রাশিয়ান হেলিকপ্টারে কয়েক মিনিটের জন্য মাল্যদান করে তৎক্ষণাৎ সাভার স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করেন। ভুট্টোর মাল্যদানকালে আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রচণ্ড আওয়াজে স্লোগান দিতে থাকি, ‘কিলার ভুট্টো-মার্ডারার ভুট্টো গো ব্যাক গো ব্যাক। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না।’ স্মৃতিসৌধের চারিদিকে তখন লোকে লোকারণ্য। ওখানে রক্ষী বাহিনীর লোকও ছিল অনেক। কারণ রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প স্মৃতিসৌধের খুব কাছেই ছিল। মাঝখানে খালে পানি থাকাতে আমরা কেউই স্মৃতিসৌধের নিকটে যেতে পারছিলাম না।
হঠাৎ একসময় স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আর বিহারীদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। কলাবাগানের হারুণের (এখনো কলাবাগানের স্থায়ী বাসিন্ধা) মাথায় আঘাত লেগে ফেটে যায়। তাঁকে একটি ট্রাকে করে দ্রুত ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের মাথায় আহসান ক্লিনিকে নিয়ে আসি। খবর পেয়ে কামাল ভাই সাথে সাথে ক্লিনিকে ছুটে আসেন এবং আহত হারুনের মাথায় হাত রেখে স্নেহের দৃষ্টিতে সান্তনা দিতে থাকেন। এই সময় কামাল ভাই আমাকে বললেন, ‘সব দিক দিয়ে হারুণের খেয়াল রাখার জন্য। তাঁর চিকিৎসার যেন কোনো ত্রæটি না হয়। কামাল ভাইকে পাশে দেখে রক্তাক্ত হারুণ আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে বললো, ‘কামাল ভাই, আমি রাজাকারদের দেখিনি, ওরা পেছন থেকে আমাকে আঘাত করেছে। সামনা-সামনি হলে দেখে নিতাম।’ হারুণের এই কথা শুনে কামাল ভাই তাঁর মাথায় হাত রেখে আদর করে দেন। এই হলো আমাদের কামাল ভাই। যার মন যার প্রাণ, যার সবকিছুই ছিল ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীদের জন্য। প্রতিটি কর্মীর প্রতি কামাল ভাইয়ের ছিল অসীম প্রাণঢালা ভালোবাসা।
ঢাকা শহরের প্রতিটি কলেজের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ কর্মীদের উৎসাহিত করার জন্য কামাল ভাই সব সময় পাশে থাকতেন। কর্মীদের কোথাও কোনো অসুবিধা যাতে না হয় তার খোঁজ-খবর নিতেন তিনি। কখনো কখনো তিনি নিজেও নির্বাচনী প্রচার মিছিলে এসে যোগদান করতেন। তবে রউফ, ইউনুস, নুরু ভাই ও আমাকে তিনি একটু বেশি আদর করতেন এবং আমাদের সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। এই কারণে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অনেকেই আমাদের একটু অন্যচোখে দেখতো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার দেশের বাড়ি সিলেট দেখে আমার সাথে ঠাট্টা করে কামাল ভাই কখনো কখনো সিলেটি ভাষায়ও কথা বলতেন।
কামাল ভাই কখনো কখনো নুরু ভাইসহ আমাদের কয়েকজনের সাথে ৩২ নাম্বার রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসার নিচতলার ড্রইং রুমে বসে নগর ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় বসতেন। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি আমাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আগামী দিনে ঢাকা মহানগরের নেতৃত্ব দিবি তোরা, তোদের উপর আমার অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন।’ এই সময় কামাল ভাই যখন আমাদের সাথে কথা বলতেন তখন তিনি তাঁর লম্বা কালো গোঁফে হাত দিয়ে তা দিতেন আর কালো চশমার ফাক দিয়ে আমাদের দিকে তাকাতেন। কখনো কখনো মিটি মিটি হাসি আবার কখনো কখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
১৪ আগস্ট ১৯৭৫ সাল বৃহস্পতিবার। ঐদিন রাতে ঢাকা মহানগর জাতীয় ছাত্রলীগ অফিসের ছাদে জগন্নাথ কলেজের ভিপি জিন্না ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে এক শোকসভার আয়োজন করা হয়। ছাত্রলীগনেতা শেখ কামাল ভাই ছিলেন এই শোকসভার প্রধান অতিথি। এখানে এসে তিনি রাত আনুমানিক নয়টায় ভাষণ দিয়েছিলেন এবং এই ভাষণ ছিল তার জীবনের শেষ ভাষণ। সেদিন কেন জানি না কামাল ভাইকে খুব ব্যস্ত মনে হয়েছিল। সেদিন কামাল ভাইকে মনে হলো একটু অন্য রকম। ১৪ আগস্ট রাতে এই সময় কোনদিন কল্পনাও করিনি এই দেখাই হবে কামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের সকলের শেষ দেখা। সভা শেষে কামাল ভাইকে তাঁর আকাশী রঙের টয়োটা গাড়িতে বিদায় জানানোর সময় তিনি শুধু বলেছিলেন তোরা বাসায় যাওয়ার সময় একবার ইউনিভার্সিটির কলাভবন ঘুরে যাবি। এই ছিল কামাল ভাইয়ের শেষ কথা।
১৫ আগস্ট শুক্রবার ১৯৭৫ সাল। মুসলিম জাতির কাছে একটি অতি পবিত্র দিন। ঐদিন ভরে মুয়াজ্জিনের আজানের পরপরই ঢাকাবাসী শুনতে পায় প্রচণ্ড গুলির শব্দ। সোবহানবাগ মসজিদে সেদিন গুলির শব্দে অনেকেই আর নামাজে যেতে সাহস করেনি। আমরা থাকতাম তখন সোবহানবাগ কলোনিতে। বাসার আসে-পাশে শুধু গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রাণরক্ষার্থে আমরা সবাই ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। আমাদের বাসাটা ছিল নিচরতলায়। মাঝে-মাঝে প্রচণ্ড শব্দে ঘর কেঁপে উঠছিল। হটাৎ জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম টিনের গ্যারেজের ছাদের উপর কালো পোশাকধারী সৈনিক। দেখে মনে হলো আর্টিলারির সেপাই। হাতে তাদের ভারী অস্ত্র। এর মাঝে মোহাম্মদপুর থেকে ছোটো ফুফুর টেলিফোন এলো এবং বললেন রেডিও শুনার জন্য। রেডিও খুলতেই আওয়াজ এলো, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর রেডিওতে এই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিলো। ঘোষণায় সান্ধ্য আইন জারি করার কথাও বলা হলো। আমাদের বাসার দেওয়ালের ওপর পার ঘেষে চলে গেছে মিরপুর রোড। হটাৎ একটি গাড়ি ব্রেক করে থামার শব্দ শুনলাম। সাথে সাথে মিলেটারিদের দৌঁড়াদৌঁড়ি ও গুলির শব্দ। তারপর সব নিরব।
দুপুরে শুক্রবার জুম্মার নামাজের জন্য কিছু সময় সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলো। নামাজ পড়ার জন্য কলোনির ওপারে সোবহানবাগ মসজিদে আসলে পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হলো। এখানেই জানতে পারলাম কর্নেল শাফায়েত জামিলের হত্যার কথা। মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে ওনাকে অনার গাড়িতে বসা অবস্থায় পবিত্র এই মসজিদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে তিনি ছুটে এসেছিলেন। নিজের জীবন দিয়েও রক্ষা করতে পারেননি তিনি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। এর আগে সকালে যে গাড়ি থামার শব্দ শুনেছিলাম সেটা ছিল কর্নেল শাফায়েত জামিলের গাড়ি এবং তাঁকেই গুলি করে মারার শব্দ। পবিত্র মসজিদের সামনে খুন করতেও ভয় পায়নি খুনিরা। এদিকে খুব শীঘ্রই খান আতা খুনি মিলেটারিদের সমর্থনে গান রচনা করে ফেললেন যা কয়েকজন সুপরিচিত শিল্পীর কণ্ঠে রেকর্ড করে রেডিওতে প্রচারিত করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতি আর ফিরে পাবে না। তবে তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব এখন এসে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার উপর। ৯৬ ও পরবর্তীতে ২০০৮ ক্ষমতায় এসে তিনি জাতির আশা আকাংখার অনেক কিছুই ইতিমধ্যে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। দেখা যাক এখন বাকি কাজ পূরণে আগামী নির্বাচনে জনগনের সমর্থন আদায়ে তিনি সফল হতে পারেন কি না।