শেখ কামাল : শিল্প-সাহিত্য ও ললিতকলা চর্চার স্মৃতিকথা

1944

Published on আগস্ট 7, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক আসলাম ভূঁইয়াঃ

৫ আগস্ট, প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন। এ মাসের ১৫ আগস্ট তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্য মা, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী এবং শহীদ শেখ কামালের সহধর্মিণী সুলতানা কামাল (খুকি) একই সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নিহত হন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রজীবনে নাটক, নৃত্যনাট্য, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ সাহিত্য-ললিতকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ছিল নিয়মিত মহড়া অনুষ্ঠান দেখা কিংবা অংশগ্রহণ করার কেন্দ্রবিন্দু।

আমার বিভাগের অনুজ সহপাঠী শহীদ শেখ কামাল ছিলো আমার ঘনিষ্ঠ সহচর, অংশীদার ও বন্ধুও বটে। আমরা একসঙ্গে ৫টি নাটকে (তার মধ্যে একটি পশ্চিম বাংলার কলকাতায় মঞ্চস্থ হয়) অভিনয় করেছি। তিনটি নাটক আমার লেখা এবং আমার পরিচালনায় টিএসসিতে মঞ্চস্থ হয়। নাটকের নাম ‘অতৃপ্ত কান্না’ ‘থিওরি মৃত্যু ও একটি স্বপ্ন’ এবং ‘ইতিহাসের রায় জনতার জয়’ কলকাতায় মঞ্চস্থ নাটকটি বার্নডশ্-এর লেখা You Never Can Tell-এর অনুবাদ ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ অনুবাদ করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী। পরিচালনা করেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। অন্য যারা অভিনয় করেন এ নাটকে তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফেরদৌসী মজুমদার। এছাড়া যেসব নাটকে শেখ কামাল অভিনয় করেন তা হলো, ‘এক নদী রক্ত, পলাতক এবং আমি মন্ত্রী হবো।’

নাট্য অভিনয় ছাড়া শহীদ শেখ কামাল ভালো সেতার বাদক ছিলেন। বিভাগীয় উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক অনুষ্ঠানে সর্বদা প্রথম স্থান দখল করে নিতেন। আমরা দু’জনেই একই হলের ছাত্র ছিলাম। সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের বাস্কেট বল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন শেখ কামাল। তাঁর দক্ষতা নিরুপণ করে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্কেট বল টিমের প্রধান করা হয়।
তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাও উল্লেখ করার মতো। যেমন পেশাদারী নাট্য সংস্থা ‘নাট্যচক্র’ সেটি ডাকসুর উদ্যোগে গঠিত হয়। তিনি যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন। ডাকসুর বিনোদন সম্পাদক ম. হামিদ ছিলেন আহ্বায়ক। আমারও যুগ্ম-আহ্বায়ক হওয়ার সৌভাগ্য হয়। সম্ভবত এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম, পেশাদারী নাট্য সংস্থা বা নাট্যচক্র। শহীদ শেখ কামালের পদচারণা শিল্প-সাহিত্যের বাইরেও ছিলো যা উল্লেখ করার মতো। তিনি ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ প্রতিষ্ঠা করে এ দেশে আধুনিক ফুটবলের সূচনা করেন। এ ছাড়া প্রথম পপ সঙ্গীত সংস্থা ‘স্পন্দন’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। তারপর ফিরোজ সাঁই এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন, তিনিও প্রয়াত।

কলকাতায় মঞ্চস্থ ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ নাটকে শেখ কামাল ভালো অভিনয় করেন। নাটকের পর তাঁর ও ফেরদৌসী মজুমদারের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য শত শত নারী-পুরুষ লাইন ধরে তাঁদের ঘিরে ফেলে। এখনও যা আমার স্মৃতিতে ভাস্বর। সুলতানার (খুকি) সঙ্গে তাঁর মন দেয়া-নেয়ার বিষয়টি আমরা জেনে ফেলি। শহীদ শেখ কামাল আমাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতো তাই খুব লজ্জা পেয়ে আমাকে বলেছিলো, ‘ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, লজ্জায় আপনাকে আমি নিজে কিছু বলিনি।’ বস্তুত সে তাঁর সব বিষয় আমার সঙ্গে আলোচনা করতো, পাঠাগারে যাওয়া, একসঙ্গে খাওয়া এবং পড়াশোনার বিষয় বই-পুস্তুক, নোট আদান-প্রদান সর্বদাই চলতো। একজন সুহৃদ ছিলো শহীদ শেখ কামাল। সবাইকে জাদুকরের মতো দ্রুত আপন করে নিতো। তাঁর কাছ থেকে কেউ কখনও কিছু চেয়ে খালি হাতে ফিরেছে বলে আমার মনে পড়ে না। অত্যন্ত সমাজ সচেতন ব্যক্তি ছিলো শেখ কামাল। তাঁর এবং সুলতানা খুকির সম্পর্কের বিষয় কেনো জানি খুব দ্রুত জানাজানি হয়ে যায়। দু’জনকেই সবার প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।

শহীদ শেখ কামাল এমএ পরীক্ষা শেষ হবার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন। অনার্স পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান পেয়েছিলেন। এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই তিনি বিদেশি ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের হাতে সস্ত্রীক নিহত হন। তাঁর মতো মানুষের আজ খুবই প্রয়োজন ছিলো। বেঁচে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে রাজনীতি করতেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ঢাকা কলেজের প্রধান সংগঠক হিসেবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়, রাজপথে মিছিল নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন এক মহান শিল্পী। অভিনয় শিল্পী, সেতার বাদক, বিতর্ক এবং উপস্থিত বক্তৃতাসহ সাহিত্য-ললিতকলার সব শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিলো।

শেখ কামাল মানুষ হিসেবে কোমল হৃদয়ের ব্যক্তি, প্রকৃত অর্থে শিল্পমনা পরিশীলিত একজন মানুষ। মানবদরদী ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন শহীদ শেখ কামাল। আচার-আচরণে অতি সহজ-সরল, সদালাপী, সদা হাসি-খুশি মনখোলা প্রাণবন্ত যুবক। সাদামাটা পোশাক পড়তেন, কোনো বাহুল্য ছিলো না। নিরহঙ্কার, দরদী হৃদয়ের একজন সৎ মানুষ ছিলেন শহীদ শেখ কামাল। আমি যখনই আমার অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, আমার বিশ্বাস সাহিত্য-নাট্যচর্চার স্মৃতিকে স্মরণ করতে চাই। শহীদ শেখ কামালকে স্মরণ করা ছাড়া, আমার সেসব হারানো দিনের স্মৃতিকে ধারণ করতে পারি না। হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে এই সুহৃদয় অনুজ সহপাঠীকে কেনো হারাতে হলো? তিনিও দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। সামরিক বাহিনীর কমিশন প্রাপ্ত অফিসার হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসির দায়িত্ব পালন করেছেন যুদ্ধকালে। শিল্প-সাহিত্য ললিতকলার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করি এবং তাঁর পরিবারের সবার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত