সাধারণের মাঝে অনন্য-সাধারণ শেখ কামাল

1950

Published on আগস্ট 7, 2020
  • Details Image

ওয়ালিউর রহমান:

শেখ কামালকে নিয়ে আমার জানাশোনা খুবই কম, তবে জেনেভাতে আমি শেখ কামালকে খুব কাছ দেখেছি, একজন স্বল্পভাষী মগ্ন পাঠককে আমি দেখেছি। আমি তখন জেনেভাতে বাংলাদেশ মিশন প্রধান, বঙ্গবন্ধু আসলেন চিকিৎসা করাতে। সেইবারে ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে তিনি ২২ দিন ছিলেন জেনেভাতে। বঙ্গবন্ধুর এই সফরেই শেখ কামালকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। শেখ কামাল মগ্ন স্বভাবের ছিলেন, খুবই কম কথা বলতেন তিনি, বই ছিলো তাঁর প্রাণ, অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিলো তাঁর মধ্যে।

শেখ কামাল যখন ১৯৭২ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনেভাতে আসলেন, জেনেভাতে থাকাকালীন সময়ে শেখ কামালকে তেমন একটা দেখা যেত না বাইরে, বইয়ের মাঝে নিজের একটি বলয় তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি। বাইরে যতটুকু সময় কাটাতেন রেয়ার বই খুঁজতেন তিনি। অনেকের অনেক শখ থাকে, পোশাক থেকে শুরু করে ব্র্যান্ডের জিনিসপত্রের প্রতি আগ্রহ থাকে, শেখ কামালের এগুলোর কিছুই ছিলো না, তিনি চাইতেন বইÑঅজানাকে জানার জন্য বই ছিলো তাঁর প্রিয় বন্ধু।

আমি শেখ কামালকে কখনোই বঙ্গবন্ধুর কাছে কিছু চাইতে দেখিনি, তাঁর কোনো কিছুর দরকার পড়লে তিনি বেগম মুজিবের কাছে চাইতেন, অবশ্য যতটুকু তাঁকে দেখেছি তাতে তাঁর চাহিদার পরিমাণ খুবই নগন্য ছিলো। সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সন্তানেরা যেভাবে ফ্যামিলির আয়ের মধ্যে নিজেদের মানিয়ে নেয়, শেখ কামাল তেমনটাই ছিলেন; সাধারণের মাঝে অনন্য-সাধারণ ছিলেন তিনি। জেনেভাতে থাকাকালীন সময়ে শহরের পাশেই লেক জেনেভার পাড়ে লা রিজার্ভ হোটেল-এর সামনে মাঝে মাঝে ঘুরতেন তিনি। এই হোটেলে চমৎকার বাগান ছিলো, নির্জন এই বাগানে শেখ কামাল একাকী ঘুরতেন; তাঁর মতো করেই নিবিড় প্রকৃতির মাঝে তিনি একাকিত্বকে উপভোগ করতেন।

শেখ কামাল জেনেভাতে থাকাকালীন সময়ে মাত্র দু’বার আমার কাছে গাড়ি চেয়েছিলেন, এই দুইবার রেয়ার কিছু বইয়ের খোঁজে তিনি বের হয়েছিলেন জেনেভা শহরে। তিনি একজন মগ্ন পাঠক ছিলেন। মাঝে মাঝে আমার কাছেও বই চাইতেন। জেনেভার চমৎকার একটি বইয়ের দোকানের খোঁজ আমি তাঁকে দিয়েছিলাম, কয়েকবার সেখানে তিনি গিয়েছিলেন; কিছু বই সেখান থেকে সংগ্রহও করেছিলেন। শেখ কামাল মৃদুভাষী ছিলেন, কখনোই তাঁকে আমি উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। মাঝে মাঝে তিনি আমার অফিসে বসতেন, আমার স্টাফদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইতেন, অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিলো তাঁর। সুইজারল্যান্ডের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি নিয়ে তখন তিনি অধ্যয়ন করেছেন।

ওই সময়ে মিউনিখে অলিম্পিক গেমস্-এর আসর বসেছিলো, তখন শেখ জামাল ও বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীদের কয়েকজন অলিম্পিক গেমস্ দেখতে যাওয়ার বায়না করলো, বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তাদের যাওয়া উচিত কিনা; আমি না করে দিলাম। ঠিক এর দু’দিন পরেই ৫ সেপ্টেম্বর অলিম্পিক গেমস্ ভিলেজে ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের উপরে হামলা করলো ফিলিস্তিনিরা। ওই ঘটনায় এগারোজন ইসরায়েলি খেলোয়াড়কে পণবন্দি করে, তাদের মধ্যে দু’জন ঘটনার সময়েই নিহত হয়, বাকি নয়জনকে উদ্ধার অভিযানও পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে যান বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পুরো ফ্যামিলি। বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ রেহানা, শেখ জামাল, শেখ রাসেলও তখন জেনেভাতে।

শেখ কামাল সম্পর্কে এই সামান্যকিছু বলার কারণ হচ্ছে, তাঁর সারল্য আর সহজ জীবনকে কাছ থেকে দেখা; আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত শেখ কামালের সঙ্গে কাটানো কিছু সময়। বাঙালির জীবনে এমন সব্যসাচী পুরুষ খুব কমই এসেছে। শেখ কামাল একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন, ছিলেন ঢাকার কালচারাল অঙ্গনের প্রধান সংগঠক। পরে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে শুনেছি তিনি সাধারণ জনগনের মধ্যে মিশে যেতেন অতি সাধারণ হয়ে। কখনোই রিজার্ভ থাকেননি, মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির মধ্যমণি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনও তিনি শুরু করেছিলেন, বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য সেই আন্দোলন করেছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে।

আজ শেখ কামাল নেই, তবে তিনি আছেন, আমাদের মননে। শেখ কামালের সরব উপস্থিতি আমাদের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শেখ কামালের মতো মহান হৃদয়ের মানুষের কখনো মৃত্যু নেই। তিনি চিরজাগরূক, চিরভাস্বর হয়ে আমাদের মননে বেঁচে আছেন, থাকবেন হাজার বছর।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত