3211
Published on আগস্ট 5, 2020পাভেল রহমানঃ
ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট মাঠে প্রথম দেখি শেখ কামালকে। সাদা শার্ট, সাদা ফুলপ্যান্ট আর মাথায় হ্যাট পরা এক যুবক হাতে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে মাঠে নামছেন। আর সেই মাঠে ব্যাট হাতের শেখ কামালের ছবি তুলছি আমি। সে সময় খেলোয়াড়দের কেউ ৫০ কিংবা ১০০ রান হাঁকালে আম্পায়ারদের অনুমতি সাপেক্ষে ক্রিজে গিয়ে ছবি তুলতে হতো। সেদিন সেই ব্যাটসম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। সেটাই আমার প্রথম শেখ কামালের ছবি তোলা। এত দিন দূর থেকে দেখা শেখ কামাল সামনাসামনি অন্য রকম! নেই কোনো অহংকার, নেই কোনো বাহ্যিক গরিমা। সাধারণ এক যুবক! শরীরের চেয়ে বড় একজোড়া গোঁফ। সেই গোঁফের নিচে অমলিন একটুকরো হাসি যেন সময় লেগেই আছে ঠোঁটজুড়ে। অন্য সবার চেয়ে কনিষ্ঠ বলে আমার ক্যামেরায় একটু যেন বেশি বেশি ব্যাট উঁচিয়ে পোজ দিলেন তিনি।
আমি ভাবিনি সেই প্রথম দেখা শেখ কামাল আমাকে মনে রাখবেন! ঐতিহাসিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের সকালে আবার দেখা হয়ে গেল কামাল ভাইয়ের সঙ্গে। আমাকে দেখেই কামাল ভাই শুভানুধ্যায়ীদের আনা এক পিস কেক আমার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘কেমন আছ তুমি?’ আমি চমকে উঠি তাঁর সম্ভাষণে। তিনি অনুরোধের সুরে বললেন, ‘তুমি কি আমাদের আবাহনীর ছবি তুলে দেবে?’ প্রথম সাক্ষাতেই তিনি আমাকে দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন। শেখ কামাল ভাইয়ের মুখের কথায় আমার আনন্দ আর ধরে না!
সেই সন্ধ্যায় গণভবনে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে গেল আমার জীবনে! দেশের বিখ্যাত সব খেলোয়াড়কে নিয়ে আবাহনীর কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে আসেন। আমার ক্যামেরায় সেই সন্ধ্যায় দারুণ এক ছবি উঠে এল। উৎফুল্ল বাবা আর ছেলের। দেশের তারকা ফুটবলার আর ক্রীড়াবিদেরা—এক এক করে সালাউদ্দিন, অমলেশ দাদা, শামছু ভাই, আশরাফ ভাই, হারুন ভাই, তারেক ভাই, অনেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আকস্মিক কামাল ভাই আমাকে ডাকলেন, ‘পাভেল পাভেল।’ তাঁর সামনে আসতেই তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আব্বা, ও হচ্ছে আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার।’ ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। একটু আরাম করে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু। ‘আবাহনীর ফটোগ্রাফার’ শুনেই নড়েচড়ে বসলেন। তিনি বিস্মিত! বললেন, ‘কী! তোদের আবাহনীতে আবার ফটোগ্রাফারও আছে নাকি?’ বঙ্গবন্ধুর কথায় এবার আমি আরও নার্ভাস হয়ে পড়লাম। এমনিতেই এত এত সুপারস্টার বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে, সেখানে আমি পুঁচকে এক ফটোগ্রাফার! বঙ্গবন্ধুর মতো অমন বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগছিল। ‘আবাহনীর ফটোগ্রাফার’ শুনেই বঙ্গবন্ধু মুচকি হাসিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর তাতেই আমার আমার হার্টবিট তুঙ্গে। কামাল ভাই তখন সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ আব্বা, আছে তো। আর ওর নাম হচ্ছে পাভেল।’ পাভেল নামটা পছন্দের ছিল কামাল ভাইয়ের। এবার আমার নাম পাভেল শুনেই বঙ্গবন্ধু কেন জানি আমাকে কাছে টেনে নিলেন। স্মিতহাস্যে আমার বাঁ গালে তাঁর ডান হাত বুলাতে লাগলেন আর বলে উঠলেন, ‘পাভেল! বাহ, কী চমৎকার নাম তোমার।’
এতটা বছর পর আজও সন্ধ্যার সেই স্মৃতি আপ্লুত করে আমাকে। বিস্মিত হই এই ভেবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল নগণ্য এক ফটোগ্রাফার আমাকে কী করে এত সম্মানিত করে দিলেন!
এই একটি ঘটনা থেকেই আমি বুঝে ফেলি শেখ কামাল মানুষ হিসেবে কত বড় মাপের ছিলেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের।
কামাল ভাইয়ের সুন্দর একটা মন ছিল। যে মনে অঙ্কুরিত হতো নিত্যনতুন ভাবনা। আর সেই ভাবনায় আমরা সংগঠিত হয়েছি আবাহনীতে, নাট্যচক্রে, ঢাকা থিয়েটারে, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী, মহান একুশের শ্রদ্ধায় কিংবা নবান্ন নাটকের মঞ্চে। এত প্রতিভাধর মানুষটি অল্প কদিনেই আপন হয়ে যান। তাঁকে জানার সুযোগ আসে আমার।
স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামের আর যুদ্ধের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখতেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে তুলবেন এক নতুন ক্রীড়াদিগন্ত। স্বাধীন দেশে সীমিত সুযোগের মধ্যে তিনি আবাহনীর মতো ক্রীড়া সংগঠন গড়ে তোলেন। নতুন প্রজন্মের কাছে আবাহনী ক্রীড়া চক্র সারা দেশে যেন ক্রীড়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। একসময়ের প্রচণ্ড প্রতাপশালী ফুটবল ক্লাব মোহামেডানকে পেছনে ফেলে শত বাধা টপকে আবাহনী ক্রীড়া চক্রকে নতুন ধারার ফুটবলের গৌরবের উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন কামাল ভাই। সাফল্যের চূড়ান্তে ট্রিপল ক্রাউন লাভে উৎফুল্ল হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আবাহনীর প্রধান উপদেষ্টা। ক্রীড়াজগতে নিজ সন্তানের অসীম সাফল্যে বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন আনন্দিত আর সন্তানের গর্বে ভরা এক পিতা।
আবাহনী ক্রীড়া চক্র সারা দেশের শাখা গঠনে আমরা চলেছি ফরিদপুর। পদ্মা নদী পারাপারের জন্য বিশেষ ফেরি তখনো ভেড়েনি ঘাটে। এরই ফাঁকে আরিচা ঘাটে খবর ছড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল এসেছেন। ক্ষুদ্র ফেরিওয়ালাদের ভিড় পড়ে গেল তখন। কলাওয়ালা, ডাবওয়ালা ছুটে এলেন। তাঁদের অনুরোধ একটাই, রাজার (বঙ্গবন্ধু) ছেলে যেন তাঁদের এই ভালোবাসা গ্রহণ করেন।
বিশেষ ফেরিটি আমাদের মাত্র পাঁচটা গাড়ি নিয়েই ছেড়ে দিল। ব্যাপারটি কামাল ভাইয়ের চোখে পড়ল বেশ কিছুক্ষণ পরে। তিনি ফেরিকে তাৎক্ষণিক ঘাটে ফিরতে বললেন, আর অপেক্ষমাণ যাত্রীদের গাড়ি, বাসসহ যে কটা প্রাইভেট ট্যাক্সি নেওয়া যায়, তুলে নিতে বললেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় শেখ কামাল কতটা আদর্শবাদী ছিলেন। নিজের কথা শুধু ভাবেননি।
ফরিদপুরে আবাহনীর জোশ দেখে উৎফুল্ল কামাল ভাই। আবাহনী ক্রীড়া চক্রের শাখা উদ্বোধনের পর পর্যায়ক্রমে সারা দেশে জনপ্রিয় এই ক্লাব খোলা হবে—ঘোষণা দিলেন কামাল ভাই ফরিদপুরে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেখ কামাল ছিলেন প্রাণবন্ত আর অমায়িক ব্যবহারের এক যুবক। ছোট–বড় সবার সঙ্গে তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় ব্যবহারের অধিকারী একজন মানুষ। সহপাঠী থেকে শিক্ষক—সম্মান করতেন সবাইকে। ছিল না কোনো দাম্ভিকতা। ছিল না প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টের পুত্রসুলভ কোনো অহমিকা। নিজে একজন ক্রীড়াবিদ হিসেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ খ্যাত ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল খুকী ভাবিকে পছন্দ করতেন কামাল ভাই। পারিবারিকভাবে আয়োজনে হলো কনে দেখার পালা। বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসভবনে দুই পরিবারের গুরুজনদের নিয়ে ‘কনে দেখা’–র অনুষ্ঠানে সেই সন্ধ্যায় প্রথম সাক্ষাতেই বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে গেলেন ভাবি পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকীর প্রতি। বেগম মুজিব আগেই পছন্দ করে বসেছেন। কনে দেখার সেই সন্ধ্যায় হাসিনা আপা ছোট ভাইয়ের বউকে শরবত খাওয়ালেন। ছোট দেবর শেখ রাসেল মিষ্টি ভাবিকে পেয়ে আনন্দে আটখানা। সেই সন্ধ্যারাতেই কামাল ভাইয়ের বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হয়ে যায়—১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে।
একদিন আমার বাড়ি ফিরতে আজিমপুর মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে গেল কামাল ভাইয়ের নিল টয়োটা। আমাকে আজিমপুর কলোনির বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসেন কামাল ভাই। কেউ একজন গাড়ির ভেতর থেকে পুলিশের উদ্দেশে বলে বসলেন, এটা শেখ কামালের গাড়ি। কিন্তু সার্জেন্ট সে কথা আমলে নিলেন না। তিনি গাড়ি চেক করবেন। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। পুরো গাড়ি তল্লাশি করলেন সেই রাতে। প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বলে বিন্দুমাত্র বাড়তি সুবিধা নেননি!
মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী শেখ কামাল শুধু ক্রীড়াতেই সাফল্য আনেননি, তিনি ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন অনুরাগী শিক্ষার্থী। ছিলেন ছায়ানটের ছাত্র। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে ধানমন্ডির বাড়িতে তালিম নিলেও পিয়ানোর প্রতিও তাঁর দারুণ আগ্রহ ছিল। তাঁর তিনতলার ঘরে ছিল বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। সাতসকালে তালিমের পর তিনি তাঁর প্রিয় নীল টয়োটায় ছুটতেন শংকরের আবাহনী ক্লাবে, আর ধানমন্ডির আবাহনীর প্র্যাকটিস ফিল্ডে। কখনো কখনো সাতসকালে কামাল ভাইয়ের সঙ্গী হতাম আমিও। আবাহনীর খেলোয়াড়দের সঙ্গে কামাল ভাই অংশ নিতেন ফুটবল খেলায়। খেলোয়াড়দের সকালের নাশতা, দুপুরের আর রাতের খাবার সবকিছুতেই তিনি তদারকি করতেন। বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে তিনি প্রচুর নাম করেছিলেন। কামাল ভাই খেলতেন ক্রিকেটও। আউটার স্টেডিয়ামে নিয়মিত ব্যাট হাতে সাদা হ্যাট পরে নামতেন তাঁর গোঁফের নিচের মোহনীয় হাসি নিয়ে। দিনের শুরু সংগীতে, ফুটবল, ক্রিকেটে হলেও তিনি সন্ধ্যায় স্টেজে থাকতেন নাটকের অভিনয়ে ব্যস্ত। তাঁর অভিনীত নাটক নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন ভারত সফরে। কলকাতার স্টেজে মুনির চৌধুরীর বিখ্যাত ‘কবর’ নাটক মঞ্চায়ন করেন তিনি। বাংলা একাডেমি মঞ্চেও অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন শেখ কামাল।
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ কামাল, আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই কামাল ভাইয়ের ঋণ আমি কী করে শোধ করব, আজও তার উত্তর খুঁজে ফিরি…
আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা অর্পণ করছি।
লেখকঃ আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাকালীন আলোকচিত্রী।