কোরবানির হাটে একদিন

2103

Published on জুলাই 24, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)ঃ 

সকাল-সকাল উঠেই বাপ-বেটা হাটে ছুটলাম। মোবাইলে বেশ কিছু অফার, অফার আছে ফেসবুকেও। সাথে আই.সি.টি মন্ত্রনালয় আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন-এর কোরবানির হাট তো আছেই। কোরবানির হাটে ঘোরাঘুরিটা এবার বেশ হবে। সূর্যকে নতুন একটা ল্যাপটপ কিনে দেয়া হয়েছে। করোনাকালে স্কুলের ক্লাস এখন অনলাইনে। ক্লাস এইটের সূর্যর কপালে এই ছুতায় জুটে গেছে সার্বভৌম একটা ল্যাপটপ। আর তাতে চেপেই বাপ-বেটার কোরবানির হাট যাত্রা। এসি রুমে বসে এই হাট থেকে সেই হাটে ছোটাছুটি করতে অদ্ভুতই লাগছে। এই গত বছরও তিনশ ফুটের গরুর হাটে যেয়ে হাঁটু সমান গোবরে পা ডেবে কি বিতিকিচ্ছিরি এক অবস্থা! এক পায়ের স্যান্ডেল সামলাই তো অন্য পায়ের স্যান্ডেল গোবরের গহীন তলদেশে। এর মধ্যেই পুরো হাট ঘোরা । কাজ হলো না। গরু পছন্দ হলে দামে হয় না, আর দাম কাছাকাছি গেলে গরুতে বনে না। রং খারাপ তো পিছা ছোট। শিংটা আরো বড় হলে মন্দ হতো না। দাঁত একটা বেশি তো কুজের উপর কাটা দাগ। কি আর করা? ঝামেলা একটা না একটা থেকেই যাচ্ছে। অগত্যা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের স্যান্ডেল রিকুইজিশন করে ছুটলাম একশ ফিটের গরুর হাটে। এটুকু পথ পাড়ি দিতে মোটামুটি দেড়টা ঘন্টা। একশ ফুটে আরও ঘন্টা তিনেক ঘোরাঘুরি। তারপর কপালে গরুর শিকে ছিড়লো।

বাপ-বেটা বীরদর্পে ফিরছি বাসায়। গাড়ি চলছে দশ-পনের কিলোমিটার স্পিডে। মাঝে-মাঝেই থামছে গাড়ি। আর গাড়ির পিছ পিছ হেঁটে আসছে গরু, সাথে হাট থেকে ভাড়া করা রাখাল। চোখ মুছতে মুছতে সাথে আসছে গরুর মালিক। অনেক কষ্টে নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানের যত্নে বড় করা গরুটিকে আজ শেষ বারের মতো বিদায় জানাবে আর অল্প সময় পরেই। সাথে আছে আমার এক ড্রাইভারও। গর্বিত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। পরিচিত-অপিরিচিত উৎসুক কেউ জিজ্ঞেস করলেই উৎসাহ নিয়ে গরুর দাম বলছে, পারলে পাচ-দশ হাজার বাড়িয়েই বলছে। আমি আর সূর্য অবশেষে ‘গরু জয়ের যুদ্ধে জিতে’ বীরদর্পে বাসায় ফিরে, গোসল সেরে, চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে বসতে বসতে সন্ধ্যা।

আজ অবশ্য গরু কিনতে সময় লাগলো সামান্যই। কেজি হিসেবে পছন্দের গরুটিকে কিনতে বড় জোর আধা ঘন্টা কি এক ঘন্টা। বিকাশে অর্ধেক দাম পাঠিয়ে বুকিংটাও কনফার্ম করে ফেললাম। ঈদের আগের দিন ডেলিভারি হবে। তারপর বাকি টাকা দেয়ার পালা।

গরু কেনাকাটা শেষ করে বাপ বেটা নেটফ্লিক্সে ছবি বাছাই করছি আর ভাবছি ধন্য এই ডিজিটাল বাংলাদেশ! এই ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণেই ডিজিটাল ভাবে হাটে-হাটে হবে এবারের কোরবানির ঈদে গরুর কেনা-বেচা, আর বেঁচে যাবে কতগুলো অমূল্য জীবন। আগামী কোরবানির ঈদের পর দেশে যদি কোভিডের দ্বিতীয় পিকটা দেখা দেয়, তাতে অনেকের মতো অবাক হবো না আমিও।

গত রোজার ঈদের আগে পরে কোটি কোটি মানুষের যে দেশব্যাপী ছোটাছুটি, তার কল্যাণে কোভিডটা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর আর বড়জোর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রোগ থেকে পরিণত হয়েছিলো জাতীয় রোগে। তখন যখন দেশে গড়ে হাজার খানেক মানুষের কোভিড রোগ ধরা পড়ছিল প্রতিদিন, এখন তা বেড়ে দাড়িয়েছে তিন হাজারের বেশিতে। তখন মারা যেত দিনে দশ জনের মতো মানুষ, আর এখন মারা যাচ্ছেন ৩০ থেকে ৪০ জন। আগামী কোরবানির ঈদ উদযাপনে আমরা যদি একটু সংযত না হই, তাতে এই তিন হাজার বেড়ে যদি ছয় হাজার হয়, আর প্রতিদিন যদি আমরা গড়ে আরও ষাট-সত্তর জন করে মানুষ হারাই, সেটাও কিন্তু খুব অবাক করা কিছু হবে না। এই যে ডিজিটাল গরুর হাট আর সাথে তিন দিনের কোরবানির ঈদের সরকারি ছুটি, এই দুইয়ের কল্যাণে আশা করি আমরা একটা বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে যাবো। হয়তো কোরবানির পর সত্যি-সত্যি ফ্ল্যাট হতে শুরু করবে কোভিডের ঘাড় ত্যাড়া কার্ভটি বাংলাদেশেও।

শুধু কি তাই, কোরবানির হাটকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরের এই যে এত শত যানজট, পরিবেশ দূষণ আর আবর্জনার পাহাড়, এসব কিছুই এবার হয়তো আর থাকবে না। নগরবাসীর কোভিড রোগের বোঝার উপর শাকের আটিটি কোরবানির ঈদ শেষে এবার বোধ হয় আর দেখার দরকার পরবে না।

বরাবর চাঁদাবাজরা গরুর ট্রাকগুলোর চাদা তুলে মেটাত তাদের ইয়াবার খরচ। ইয়াবার ব্যবসাতো এবার একেবারেই মাঠে মারা! একেতো কোভিডের কারণে সিমান্তে কড়াকড়ি, ইয়াবার চালানে ঘাটতি, তার উপর যদি চাদাবাজিতে এমন ধ্বস নামে, ইয়াবা ব্যবসার ধ্বস নামতে আর বাকি কোথায়? ইয়াবা ব্যবসায় এমন দুর্দিন বাংলাদেশে আর এসছে বলে মনে হয়না।

মাথায় বাড়ি মলম পার্টি আর ছিনতাইকারীদেরও। প্রতিবারই অনেক খামারি আর গরু বিক্রেতা ঘর ফিরতি পথে তাদের শিকারের সর্বস্বান্ত হয়েছেন, এমন খবর প্রত্রিকা আর টিভিতে দেখা যেত ঈদের পর। এখনতো খামারিরা খামারে খামারে আর গৃহস্থরা ঘরে বসেই পশুর হাটে পশু বিক্রি করছেন।

এবারে আমাদের ঈদ যেমন বাসায়, তেমনি খামারি আর গৃহস্থের ঈদও এবার বাসাতেই। এবার আর খামারির ছেলেকে আর গৃহস্থের পরিবারকে অধীর আগ্রহে বসে থাকেতে হবে না গরু বিক্রি করে তাদের পরিবারের প্রিয়জনটি ঈদের দুদিন পরে কখন ঘরে ফিরবেন এই আশায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা গরু কেনাকাটায় এই যে ডিজিটাল গরুর হাট, ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়েও আমরা নিশ্চয়ই ডিজিটাল হব। এই কোরবানির ঈদে প্রিয়জনদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়টা করে নিব জুমে, কারণ তাতে বেচে যাবে আরও আশিজন চিকিৎসকের প্রাণ। প্রাণে বাচবেন আরো পঁয়তাল্লিশ জন পুলিশ কর্মী। আরও কয়েক হাজার পরিবারকে প্রিয়জন হারানোর শোকে মূহ্যমান হতে হবে না ঈদের পর। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের নিজেদের কারণে আমরা হারাবো না আমাদের কোন স্বজনকে। ধন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ, ধন্যবাদ সবাইকে।

 

লেখকঃ চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত