2787
Published on জুন 23, 2020ড. হারুন অর রশিদঃ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম প্রাচীন, সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত দলটির আজ ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অন্যদিকে 'মুজিববর্ষ' পালন করছে জাতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। দুটি ঘটনাই আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বস্তুত আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিচ্ছেদ্য। যেমনটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন সত্তা। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সাত দশক ধরে আমাদের জাতীয় জীবনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।
মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর ১০ মাসের মধ্যে। এর আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার মাসের মধ্যে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি বুঝতে হলে বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রভাবনা। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, তিনটি রাষ্ট্র হবে। একটি পাকিস্তান, অন্যটি বাংলাদেশ এবং তৃতীয়টি ভারত। কিন্তু দেশভাগের সময় তা হয়নি। সে কারণে অন্য সবার বুঝতে সময় লাগলেও বঙ্গবন্ধুর বুঝতে সময় লাগেনি যে, পাকিস্তান বাঙালিদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্র নয়।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন পাকিস্তানের স্বাধীনতা বাঙালির স্বাধীনতা নয়। তার আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান সঙ্গে সঙ্গে শোষণ-নিপীড়ন শুরু হয়। বাঙালিরা সংখ্যায় ৫৬ শতাংশের বেশি হলেও বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতেও শাসকগোষ্ঠী সম্মত ছিল না। তারা কী পরিমাণ বাঙালি ও বাংলা ভাষাবিরোধী ছিল, তা বঙ্গবন্ধু জানতেন। সে কারণে তিনি প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্নে আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের সামসুল হক। বঙ্গবন্ধু ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালে তিনি সভাপতি হন।
আওয়ামী লীগ মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। আওয়ামী লীগ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬-৫৭ সালে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে বাঙালির মধ্যে অনেক ত্যাগী নেতা ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো স্পষ্ট, দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান কেউ গ্রহণ করতে পারেননি। বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ছয় দফাকে ভিত্তি করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয় আসে। নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু তখন কার্যত পূর্ব বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি একদিকে আলোচনার দরজা খোলা রেখেছিলেন, অন্যদিকে বাঙালিদের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই এ দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এতে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। সেই সরকারের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।
আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের জাতীয় মুক্তি এনে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে কেন্দ্রে এবং প্রদেশে তিন বছর তিন মাস ক্ষমতায় ছিল। এই সময়ে আওয়ামী লীগের অর্জন ছিল পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটি ঘোষণা। বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমিতে পরিণত করে বাংলা ভাষার গবেষণার দ্বার উন্মোচন করা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এর মধ্যেই তিনি যে কাজগুলো করেছেন, তাও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
স্বাধীনতা লাভের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন, তিন মাসের মধ্যে ভারতের সেনাদের ফেরত পাঠানো, এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাঠামো স্থাপন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আইন, সমুদ্রসীমা আইন, ছিটমহল বিনিময় চুক্তির মতো কাজগুলো বঙ্গবন্ধু করে গেছেন। ১৯৭৫ সালেও বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা বিনির্মাণে কিছু নীতি গ্রহণ করেন। এগুলো ছিল দুর্নীতির মূলোৎপাটন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রশাসনে গণতন্ত্রায়ন ও জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ড না ঘটলে এগুলো তার নেতৃত্বেই বাস্তবায়ন হতো।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তার দুই কন্যা নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। শেখ হাসিনা ভারতে থাকাকালীন ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই প্রথমে জিয়া ও পরে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর পর প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করে। এক মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও দুই বছরের কথিত ওয়ান-ইলেভেন বা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসন পেরিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড করেছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদসহ চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্বের রেকর্ড করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে, প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, দুর্যোগ মোকাবিলায় সফলতা, নারী ক্ষমতায়ন হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ সমাধান ও ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে ছিটমহল বিনিময় করতে সক্ষম হয়েছে এ সরকার।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা ধর্ষণ, গণহত্যা ও লুটপাট চালিয়েছে, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করে জাতির কলঙ্ক মোচন করেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ মহাশূন্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের মর্যাদা পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পরও পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করার ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবে পরিণত করার পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে এ সরকার। এই সময়ের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। আগামী শতাব্দীতে বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে, সেজন্য ডেল্টা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারে বা বিরোধী দলে থাকাবস্থায় সবসময়ই জনগণের দল হিসেবে জনগণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছে।
যমুনা নদীতে যে বঙ্গবন্ধু সেতু আমরা দেখছি, তা নির্মাণের পরিকল্পনা কখন হয়েছিল, অনেকেরই জানা নেই। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে রেজুলেশন গৃহীত হয়। সেখানে বলা হয়- যমুনা নদীর ওপরে একটি সেতু অথবা একটি টানেল নির্মাণ করা হবে। দেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করার সিদ্ধান্তও ছিল আওয়ামী লীগের। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ যে গঠনতন্ত্র তৈরি করেছিল, সেখানে বলা ছিল নারী ও পুরুষ উভয়ই এই দলের সদস্য হতে পারবে। ১৯৭৪ সালে কাউন্সিলে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়। এভাবে ৭১ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীনতাসহ সব অর্জনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এ দেশের লক্ষ কোটি মানুষের আবেগ-ভালোবাসার নাম। যে কারণে দলটি ৭১ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে জাতির অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে, জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। এই দল অবিনাশী। কাজেই ২০৪১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজটুকুও আওয়ামী লীগকে করতে হবে- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে চার দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আজকের অবস্থানে এনেছেন। এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুভেচ্ছা জানাই দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। আওয়ামী লীগ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়।
উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়