‘৬-দফা’ বাংলাদেশ বিজয়ের মন্ত্র

2402

Published on জুন 9, 2020
  • Details Image

আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ যুবায়েরঃ

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাল সবুজ পতাকা সম্বলিত যে দেশটি বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পেয়েছে সে দেশটির নাম বাংলাদেশ। বিশ্বের একমাত্র ভাষা যে ভাষার জন্য মানুষ আন্দোলন করেছে ও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে নিজেদের ভাষার অধিকার ফিরিয়ে এনেছে সে ভাষার নাম বাংলা। বাংলা ভাষার বাংলাদেশের মানুষগুলো নিজেদের অধিকার আদায়ের এবং দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য লড়াই শুরু করেছে ব্রিটিশ আমল থেকে এবং এখন পর্যন্ত লড়াই করে চলেছে। ব্রিটিশদের সাথে লড়ে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে তৎকালীন ভারতবর্ষের এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছে বাংলার জনগণ। সবশেষে, বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী ও পদ্মাসেতু নির্মাণে বাঁধা সৃষ্টিকারী দেশ বিরোধীদের সাথে লড়াই করে এবং সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে সারা বিশ্বে যে জাতি সাহসিকতার রোল মডেলে পরিণত হয়েছে সে জাতির নাম বাংলাদেশী। জন্মগতভাবে বাংলাদেশী মানুষ নির্ভিক ও অদম্য হলেও তাদের নির্ভয়ে পথ চলায় অনবরত যে নামটি এবং যার জীবন কর্ম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে সে নামটি হল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জীবন কর্মের অন্যতম হল ‘ছয় দফা’ দাবী প্রস্তাব উত্থাপন, যে দাবী ৭১ পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশ বিজয়ের মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে । নিচে সে বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করছি।

‘৬-দফা’ দাবী-

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক, এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে।

৫. দুই অংশের মধ্যে দেশিয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।

৬. প্রতি পূর্ব পাকিস্তানীকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের কল্যাণের জন্য উপরে উল্লেখিত ‘৬-দফা’ দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয় ফলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য এ ছয় দফা প্রস্তাব এবং নিপীড়িত জনতার মুক্তির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমেদের বিশ্লেষণ সহ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘‘আমাদের বাঁচার দাবিঃ ছয় দফা কর্মসূচী”শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘৬ দফা কর্মসূচীর’ প্রচারণায় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা পরিদর্শন করেন।  

পশ্চিম পাকিস্তানের জালেম সরকার বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচিকে অখন্ড পাকিস্তানকে দিখন্ডিত করার ষড়যন্ত্র মনে করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ‘৬-দফা’ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ৫২, ৫৮ ও ৬২ এর পরে পুণরায় শুরু হল ৬৬ পরবর্তী ইতিহাসের কালো অধ্যায়-

কালো অধ্যায়-১

ছয় দফা প্রচারকালে ১৯৬৬ সালের ৯ মে শোষক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। এরপর ৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার শুরু করা হয়। এ মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ১৯৬৯ সালে এ বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গণদাবির মুখে দখলদার সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে কিছুটা স্বস্তি আসে এবং আওয়ামীলীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয়দফা কর্মসূচির স্বপক্ষে গণরায়ের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসার পূর্বে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে অসম্মতি জানান। শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় নেতৃবৃন্দ সহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ থেকে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। 

কালো অধ্যায়-২

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বর্বর হানাদরবাহিনী গণহারে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষদের হত্যা করে। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের উপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কোন বাহিনীর আক্রমণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার কারণে অঘোষিতভাবে ছয়দফা কর্মসূচির পরিসমাপ্তি ঘটে। এবং পর্যায়ক্রমে ১০ এপ্রিল ৭১ এ তৎকালীন সময়ের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন হয়। এ সরকার দক্ষতার সাথে বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।

কালো অধ্যায়-৩

নয় মাস ধরে চলতে থাকে যুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের নির্মম অত্যাচারের স্বীকার হয়ে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী দেশ ত্যাগ করে। নয় মাস যুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণ করা হয় অসংখ্য বাংলাদেশী নারীদের।

৬৬ পরবর্তী তিনটি কালো অধ্যায় পেরিয়ে এবং অসংখ্য মানুষের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ৭১ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে।

৭ জুনে কেন ‘৬-দফা’দিবস পালিত হয়?

১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বঙ্গবন্ধুর আহবানে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবীতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৭ জুন তাই গর্বের সাথে বাংলাদেশে ‘ছয় দফা দিবস’ পালিত হয়। ‘৬-দফা’ নিয়ে উপরে আলোচনার মাধ্যমে বুঝা যায়- ১৯৫২ সালেই ভাষা আন্দোলনে রক্ত ঝরানোর দিন থেকে বাংলাদেশীদের মনে স্বাধীনতার বীজ বপন হয়ে গিয়েছিলো এবং ৬৬ তে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ‘৬-দফা’দাবী প্রত্যাখ্যান এবং বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের বিষয়টি সে বীজকে ধীরে ধীরে বৃক্ষে পরিণত করেছে। ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরিণত সে বৃক্ষ বিশ্বকে নিজের স্বরূপ দেখিয়েছে এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক সে বৃক্ষ প্রতিনিয়ত সুমিষ্ট ফল উপহার দিয়ে চলেছে। তাই সহজেই বলতে পারি- ‘৬দফা’ছিলো বাংলাদেশ বিজয়ের মন্ত্র।

লেখকঃ ফ্রিল্যান্স লেখক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত