ঐতিহাসিক ছয়দফা দিবসের প্রেক্ষাপট ও প্রভাব

2575

Published on জুন 9, 2020
  • Details Image

কিশোর কুমার পাল:

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, ইতিহাসের মহানায়ক, রাজনীতির কবি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্র্তৃক ঘোষিত ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এটি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা ও শিক্ষাক্ষেত্রে বাঙ্গালিদেরকে সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বস্তুত তারই বিরূদ্ধে ৬দফা পূর্ব বাংলার বাঙ্গালিদের প্রাণের দাবি, বাঁচার দাবি, ‘ম্যাগনা কার্টা’, বিল অব রাইটস্।

ছয়দফা আন্দোলনের ইতিহাসঃ ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেও বাঙ্গালিরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে নাই, ১৯৫৮ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি, ১৯৬৫ পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, ১৯৬০-৬১, ৬৪-৬৫ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ব্যয় ৯৭০ কোটি টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ২১৫০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের ট্রেজারিতে পূর্ব পাকিস্তান ২০০ কোটি টাকা বেশি বৈদিশিক মুদ্রা জমা, কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে ৮৪% পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ১৬% পূর্ব পাকিস্তানী। সেনাবাহিনীতে অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানী। সকল বাহিনীর সদর দপ্তর ওখানে। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর ভোটাধিকার। এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব জাতীয়তাবাদী চেতনায় রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন।

ছয়দফা দাবিসমূহঃ

১. ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা, সরকার সংসদীয় প্রকৃতির, সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকল আইনসভা গঠন, জনসংখ্যানুপাতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক। বাকী সকল বিষয়ে প্রদেশগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
৩. ক. সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু। অথবা,
খ. সমগ্র দেশের জন্য ১টি মুদ্রা চালু থাকবে, সাংবিধানিক বিধানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের বন্ধ করা, ‘স্টেট ব্যাংকের’ অধীনে দুই অঞ্চলের জন্য দুটি ‘রিজার্ভ ব্যাংক’ থাকবে।
৪. সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য, আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহে আদায়কৃত অর্থের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকার পাবে।
৫. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা, মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রদেশ সমহারে মিটাবে। কেন্দ্রীয় বৈদেশিক নীতির আলোকে আঞ্চলিক সরকার বিদেশে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ, চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
৬. আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে অঙ্গরাজ্যগুলো “আধা সামরিক বাহিনী”/ “মিলিশিয়া” রাখার ক্ষমতা থাকবে।

১৯৬৬ পরবর্তী রাজনীতিতে ছয়দফার প্রভাবঃ

বঙ্গবন্ধু ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত তিনি ৩২টি জনসভা করেন। সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেফতার, অত্যাচারের প্রতিবাদ এবং শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন হরতাল আহŸান করা হয়। কর্মসূচির ধারবাহিকতায় আহূত হরতালের দিনেই শ্রমিক মনুমিয়া, শফিক, শামসুলসহ ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়নগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শহীদ হয়। সেই থেকে “৭ই জুন ছয়দফা দিবস” হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সরকার ১৯৬৮ সালে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তাকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা “আগরতলা মামলা” তৈরি করে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ১৯৬৮ সালের ১৯শে জুন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে কড়া প্রহরায় “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্যদের মামলা” শুরু হয়। তখন গোটা দেশে আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলতে থাকে মানুষের বিক্ষোভ। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ। অতি দ্রুত শেখ মুজিব জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়।

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ছয়দফাঃ

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ১১ দফা ঘোষণা করলে আন্দোলন তীব্রতর হয়। ১৮ তারিখ পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হয়। সরকার মুজিবকে বন্দি অবস্থায় হত্যার পরিকল্পনা করে, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঘাতক ভুলক্রমে এই মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করে। ১৮ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানি সেনারা শান্ত মাথায় বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড.শামসুজ্জোহাকে। ঢাকায় সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। নির্বিচারে গুলি চালায় সেনাবাহিনী। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় জননেতা মওলানা ভাসানী হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন “শেখ মুজিবকে নিশর্ত মুক্তি দিতে হবে এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।” বাধ্য হয়েই ২২শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব- মোনায়েম সরকার মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেন। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে আগা মোঃ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

১৯৭০ এর নির্বাচন ও ৬ দফাঃ

১৯৭০ সালের সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানে ১ম ও শেষ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফাকে বাঙ্গালির ‘ম্যাগনা কার্টা এবং নির্বাচনকে ৬ দফার প্রশ্নে ‘গণভোট’ হিসেবে গ্রহণ করে। নির্বাচনে বিজয়ী হলে ৬ দফা ও ১১ দফার আলোকে সংবিধান প্রনয়ণের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দকৃত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে বরাদ্দকৃত ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের প্রদত্ত ভোটের ৭৫.১১% ভোট লাভ করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছয়দফার প্রভাবঃ

৬দফা ছিল স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে যা দমন করার জন্য আইযুব সরকার জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, হামলা, মামলার পরও বাঙ্গালিরা পিছু হাটে নি। হাজারো শোককে শক্তিতে পরিণত করে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়। ৬ দফা থেকে সরে ১দফা, ১ দাবি, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত্বে ৬দফার দাবিগুলি সংগ্রামী মানুষকে অনুগ্রেরণা যুগিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ ও চুড়ান্ত বিজয়ঃ

১৯৭০ নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ইয়াহিয়া-ভূট্টো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ এর ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা দিয়ে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করলে বাঙ্গালি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘোষণা করে। ঐ ইশতেহার বঙ্গবন্ধুকে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ ঘোষণা করে।। ঐদিনই বঙ্গবন্ধু ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দেন। ৭ দিন হরতাল শেষে তিনি রমনার রেসকোর্স ময়দানে ১৯ মিনিটের ‘মুক্তিযুদ্ধের কলাকৌশল ও বাঙ্গালির করনীয়’ সম্পর্কে এক ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’ দেন যা আজ বিশ্ব স্বীকৃত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫মার্চ রাত ১১.৩০ মিঃ ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে ঘুমন্ত, নিরস্ত্র ও অসহায় বাঙ্গালির উপর গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চ প্রথম পহরে তিনি লিখিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ নারীর সম্ভমহানির মধ্যদিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের লাভ করে। জন্ম হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের।

লেখকঃ প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, দিগরাজ ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, মোংলা, বাগেরহাট।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত