2253
Published on জুন 9, 2020তাপস হালদারঃ
এই উপমহাদেশে ন্যায় সঙ্গত, জনসমর্থিত অনেক দাবিনামা পেশ হয়েছে। কিন্তু দুটো দাবিনামা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ইতিহাসে আমূল পরিবর্তন এনেছে। প্রথমটি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের সর্বসম্মত গৃহীত লাহোর প্রস্তাব। যেটি উপস্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। সে প্রস্তাবে ছিল ভারতের উত্তর-পঞ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলমান প্রধান অঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রস্তাবে একাধিক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল।
দ্বিতীয় দাবিনামা প্রস্তাবটি ছিল ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা পেশ।লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের জাতীয় সম্মেলনে যেন ছয় দফা আলোচনায় স্থান পায় সেজন্য সাবজেক্ট কমিটিতে উত্থাপন করেন।কিন্তু সম্মেলনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানালে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন বর্জন করেন। এবং প্রথমে লাহোরেই সাংবাদিক সম্মেলন করে ছয়দফা উত্থাপন করেন।যার ফলে পাকিস্তানী সরকার ও মিডিয়া বঙ্গবন্ধুকে বিছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার বিস্তারিত তুলে ধরেন।১৩ মার্চ আওয়ামীলীগের কার্য নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে ছয় দফাকে গ্রহণ করা হয়।1১৮,১৯,২০ মার্চ দলীয় কাউন্সিলে “আমাদের বাঁচার দাবি,ছয় দফা কর্মসূচী” শীর্ষক পুস্তিকা বিলি করা হয়। সেই কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু প্রথম বারের মত আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সমাপনী বক্তব্যে সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নেই।রাজনীতিতে কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামীলীগ আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত কর্মীদের ঐক্যই আওয়ামীলীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামীলীগ নেতার দল নয়। এ প্রতিষ্ঠান,কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই দফা আদায় করতে হবে। ছয় দফা আন্দোলন কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না।ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ”। ছয় দফা পেশ করার আগে বঙ্গবন্ধু বিরোধী সকল শীর্ষ নেতার কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ সাহস করে সমর্থন করতে পারে নি। দফা গুলো পড়ে বর্ষীয়ান নেতা আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবকে বলেন, তুমি কি আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চাও? এটা তো আমি হতে দিতে পারিনা। তোমারও দাবী পেশ করা উচিত হবেনা। এর জন্য তোমারও ফাঁসি হতে পারে। জবাবে শেখ মুজিব বলেন, জনগনের মুক্তির জন্য কাউকে না কাউকে ফাঁসির ঝুঁকি নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, নেতারা কেউ না থাকলেও জনগন তাঁর সাথে আছে। সেজন্যই তিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ছয় দফার পটভূমি হিসেবে ১৯৫৫ সাল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন পাক-ভারত যুদ্ধের ১৭ দিন পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও বৈষম্যমূলক মনে হয়েছিল। তারপর আবার আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী প্রহসন বাঙ্গালিদের ভীষন ক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল শুধু বঞ্চনা আর বঞ্চনা। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্র বা প্রদেশে কোথাও রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হতো না, সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন অজুহাতে বাঙ্গালিদের নিয়োগ দেওয়া হত না, প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হত না, বৈদেশিক বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের কিন্তু সমস্ত অর্থ ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর ঋনের বোঝা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। এরকম বৈষম্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে প্রচন্ড রকমের ক্ষোভ ছিল। সেজন্যই পাকিস্তানি শাসকরা মিথ্যা প্রচারণা, ভয় ভীতি দেখিয়ে ছয় দফাকে দমন করতে পারে নি। জেল-জুলুম নির্যাতন ছয় দফাকে বাঙ্গালিদের কাছে আরো গ্রহনযোগ্য, যৌক্তিক, জনপ্রিয় করে তোলে।
ছয় দফার সংক্ষিপ্ত রূপ:
প্রথম দফা: লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয় দফা: প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বাদে সব বিষয় প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
তৃতীয় দফা: পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করে মুদ্রা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
চতুর্থ দফা: কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের কাছে।
পঞ্চম দফা: প্রদেশগুলো নিজ নিজ বৈদেশিক মুদ্রা ও বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে।
ষষ্ঠ দফা: প্রদেশগুলো আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিয়ে ঘরে বসে থাকেননি। তিনি সারা দেশে ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য গণসংযোগ শুরু করেন। ৩৫ দিনে ৩২ টি জনসভা করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ৮ বার তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। সব শেষে ৮ মে নারায়ণগঞ্জে মে দিবসের জনসভা করে বাসায় ফিরলে পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এই সময়ই একটানা ৩৩ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে।
১৯৬৬ সালের ১৩ মে পল্টন ময়দানে আওয়ামীলীগ আয়োজিত এক জনসভা থেকে স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধু সহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে ৭ জুন হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। হরতালে ঢাকা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক,শামসুল,আবুল হোসেন সহ ১১ জন শহীদ হন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। সন্ধ্যায় কার্ফু জারি করা হয়। হাজার হাজার আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের রক্তে আন্দোলনের নতুনমাত্রা গড়ে ওঠে। সেজন্যই ৭ জুন ছয় দফা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ছয় দফাকে এগার দফায় অন্তর্ভুক্ত করে আন্দোলনে নামেন বাংলার ছাত্রসমাজ। ছাত্রসমাজের আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান বিদায় নেন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
ছয় দফা শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এমন কোন বাঙালি ছিল না যে ছয় দফাকে অন্তরে ধারণ করেনি। তাই কার্যত ছয় দফা জনগণের দলিলে পরিণত হয়েছিল। ছয় দফার হাত ধরেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ছয় দফাকে যুক্ত করে ছাত্রদের ১১ দফা ‘৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্তানী শাসকচক্র গড়িমসি শুরু করে তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেও ছয় দফার পর্যালোচনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করছে ছয় দফার ভিত্তিতে। ছয় দফাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।
লেখক: সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা