বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছয় দফার প্রভাব

2489

Published on জুন 7, 2020
  • Details Image

নাজমুস সাকিবঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যে কয়টা শব্দ পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ৬ দফা তাঁর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য।৬ দফার মধ্যমে বাঙ্গালীর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার বীজ রোপণ করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেন। যথারীতি এর বিরোধিতা করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীরা। এবং তাদের পোষা অনেক পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ফলে বঙ্গবন্ধু ৬ তারিখের সম্মেলন বর্জন করেন। কিন্তু অগাধ মনোবলের অধিকারী এবং গগনচুম্বী দেশপ্রেম বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপক্ষে লড়ে যান।

তিনি ১৩ মার্চ আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী সংসদে ৬ দফাকে পাস করান। বাংলার কোনায় কোনায় তিনি চষে বেরিয়েছেন ৬ দফার স্বপক্ষে জন সমর্থন আদায় করতে। আমাদের বাঁচার দাবি – ৬ দফা নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ৬ দফায় ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির পথ। বাংলা চিরদিনের জন্য পশ্চিমা অত্যাচার আর শোষণের মুক্তি পাওয়ার উপায় ছিল ৬ দফায়।

দাবি গুলো হলঃ ১, দেশ রক্ষা আর পররাষ্ট্র নীতি থাকবে কেন্দ্রের হাতে,বাকি সব থাকবে রাজ্য সরকারের হাতে, ২, পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থ পাচার রোধের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ৩, পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখা, ৪, প্রাদেশিক সরকারে হাতে কর আরোপের ক্ষমতা প্রদান, ৫, পূর্ব ও পশ্চিমের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব রাখা,  ৬, পূর্বের নিরাপত্তার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা। এসব দাবি বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য যে যথাযথ তা বাংলার জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী সহ আরোও অনেক আওয়ামীলীগ নেতা ৬ দফার পক্ষে জন সমর্থন আদায়ে সক্রিয় হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী জনাব তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ৬ দফা সম্বন্ধে বলতেন “সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হতে” [সুত্রঃ বঙ্গবন্ধু ও ছয় দফা, দৈনিক ভোরের কাগজ, ৭ জুন, ২০১৬]। ৬ দফার অগাধ জন সমর্থন দেখে আইয়ুব সরকারের ভীত নড়ে যায়। তারা এর অপপ্রচার করা সহ আইয়ুব খাঁন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে যারা ছয় দফার পক্ষে কথা বলবে তাদের সাথে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা হবে। এবং আইয়ুব অনুগত গভর্নর মোনায়েম খান আওয়ামীলীগ নেতাদের কারা বন্দি করার হুমকি প্রদান করেন।

৬ দফা দাবি কালক্রমে ব্যাপক বিস্তৃত আন্দোলনের রুপ ধারণ করে। যার কারণে ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং সাথে সাথে সারা দেশ থেকে আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে বিপুল সংখ্যক নেতা কর্মীকে আটক করা হয়। এতে জনগণ ক্ষেপে গিয়ে আন্দোলন আরোও বেগবান হয়। ৭ জুন আওয়ামীলীগ শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়। স্বৈরশাসক গন হরতালের খবর না ছাপানোর জন্য গণমাধ্যম গুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করে। হরতাল পালনকারীদের উপর শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ, ইপিআরের গুলিবর্ষণের ফলে ১১ জন শহিদ হন।

৮ জুন অনেক সংবাদপত্র সরাকারি ভাষায় সংবাদ প্রকাশ করে। সরকারি ভাষ্যমতে আগের দিন অর্থাৎ ৭ জুন আওয়ামীলীগের সহিংসতার ফলে এ হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। বাংলার জনগণের নিজের অধিকারের দাবি সংবলিত বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ হিসেবে ৬ দফা আন্দোলন বাংলার জনগণের মনে জাতীয় চেতনা সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ৬ দফা যে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার প্রমাণ বহন করে তাঁর ১টি প্রমাণ হল ইত্তেফাকের মানিক মিয়া তাঁর রাজনৈতিক মঞ্চের ১টি লেখা। তিনি লিখেছিলেন “ ৬ দফা প্রস্তাবের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্য কোন ব্যক্তি এমনকি কোন দল বিশেষ নয়, দেশবাসীর সামনে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সমস্যা মাথা চড়া দিয়া উঠিয়াছে, ৬ দফার সুনির্দিষ্ঠ প্রোগ্রামের মধ্যেই সেই বাঁচা মরার সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রহিয়াছে, ইহাই সর্বশ্রেনীর জনগণের বিশ্বাস।“ [সুত্রঃ ইত্তেফাক , ২৭ মার্চ, ১৯৬৬]। ৬ দফার জনপ্রিয়তা এত বিশাল ছিল যে বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে এর পুস্তিকা সংরক্ষিত ছিল। এসব দেখে স্বৈরশাসকের ভৃত্যরা গ্রেফতার যজ্ঞে মগ্ন হয়।

১৯৬৬ সালের প্রথম তিনমাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৮ বার গ্রেফতার করা হয়। তৎকালীন আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ সহ বহু সংখ্যক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। এবং রাজ পথে আন্দোলন করলে জনগণের উপর পাশবিক নির্যাতন করা হত। ৬ দফাকে দমন করতে আইয়ুব সরকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া শুরু করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে। এতে বাংলার আবাল বৃদ্ধ বনিতা চরম ভাবে ক্ষেপে যায়। শুরু হয় যারা দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন।যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। শেখ মুজিবের মুক্তি হয় এবং আইয়ুব সরকারের পতন ঘঠে। ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। তিনি এসে গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।উক্ত নির্বাচনে বিজয়ী দল নতুন একটা গ্রহণ যোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করবে বলে ঘোষণা দেন।

১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রধান হাতিয়ার ছিল ১৯৬৬ এর ৬ দফা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ৬ দফার কথা সব সময় উল্লেখ্য করেছেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে ও আসনে জয় লাভ করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি ঘোষণা দেন যে পাকিস্তানের সংবিধাবন প্রণীত হবে ৬ দফার ভিত্তিতে। এর ফলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে দ্বিধাবোধ করা শুরু করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ভূট্টো সাহেবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। কয়েকবার ইয়াহিয়া,ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয় । তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রলোভন দেখিয়ে ৬ দফা থেকে সরে আসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু দেশ প্রেমিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাইনা, আমি এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। ক্ষমতা হস্তান্তরের একের পর এক বিলম্বতা দেখে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছা নাই। ফলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ১০ লাখ মানুষের সামনে ঘোষণা দেন “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। যার ফলে ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী ঘৃণিত হামলা চালায় এবংএর জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন । ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্ত ঢেলে বাঙ্গালী তাঁর স্বাধের স্বাধীনতা পায়। ৬ দফা না হলে আন্দোলন হতনা ,আন্দোলন না হলে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন হতনা।আইয়ুবের পতন না হলে ১৯৭০ এর নির্বাচন হতনা, ১৯৭০ এর নির্বাচন না হলে স্বাধীনতা আসত না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ৬ দফার প্রভাব খুব গভীর। 

লেখকঃ ছাত্র, স্নাতক ১ম বর্ষ, সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত