১৯৬৬ পরবর্তী রাজনীতিতে ছয় দফা আন্দোলনের প্রভাব

4069

Published on জুন 7, 2020
  • Details Image

জাহিদ হাসান:

ছয় দফা দাবি উত্থাপন কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা ছিল না। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ১৮ বছর ধরে পূর্বাঞ্চলের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উপনিবেশিক মনোভাব, এ অঞ্চলের জনগণ ও রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি, ৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধ প্রভৃতি কারণ ছয় দফা দাবিকে যুক্তিযুক্ত করে তুলেছিল। ছয় দফা আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও এর প্রভাব ছিল দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে ছয় দফার দাবিগুলো ছিল প্রাণের দাবি, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপারটি ছিল একদম উল্টো। লাহোরে ছয় দফা উত্থাপিত হবার পরদিনই পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারী করাচিতে পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী আবদুল হাই চৌধুরী ৬ দফাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা’ বলে আখ্যা দেন। ১৫ মার্চ আইয়ুব খান বলেন, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ছয় দফা ঘোষণা করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবকে তিনি পাকিস্তানে এক নম্বর শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন। ছয় দফা সমর্থকদের ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারী’ আখ্যা দিয়ে তাদের উচ্ছেদকল্পে প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন। অর্থাৎ ছয় দফার প্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক ও অত্যন্ত কঠোর। মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বলা হয়, ছয় দফা পাকিস্তানকে বিভক্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। ধর্মভিত্তিক দলগুলো মন্তব্য করে যে, ছয় দফা ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব বিপন্ন করবে।

এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৮-২০ মার্চ, ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেই ভাঙ্গন দেখা দেয়। কতিপয় নেতা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আলাদা জোট গঠন করেন, তারা ৮ দফাও ঘোষণা করেন। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ প্রথম থেকেই ছয় দফার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। কোনো কোনো ন্যাপ নেতা এক সিআইএ’র পরিকল্পনা বলে আখ্যা দেন। ন্যাপের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফার পাল্টা ১৪ দফা ভিত্তিক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।

তবে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ ছয় দফা লুফে নেয়। এর মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান বারবার গ্রেফতার হতে থাকেন এবং জামিনে ছাড়া পান। অবশেষে ৮ মে ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে’ তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কয়েক দিনের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের সকল প্রধান নেতাকে আটক করে ফেলা হয়। ২০ মে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির এক সভায় সকল বন্দীদের মুক্তির দাবিতে ৭ জুন, মঙ্গলবার পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতাল পালনকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে ১১ জন নিহত হন এবং শতাধিক আহত হন, অসংখ্য জনকে গ্রেফতার করা হয়। এতে হিতে বিপরীত হয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

৭ জুনের ঘটনার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৮ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় পরিষদ এবং ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বর্জন করেন। দৈনিক ইত্তেফাক ৬ দফার পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। ১৬ জুন ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়।

ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবিগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির মহাসনদ। তাই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ৬ দফার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। ছয় দফা ঘোষণা করায় শেখ মুজিবুর রহমান দারুণভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হন। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।

ছয় দফা আন্দোলন কিছু দিনের জন্য স্তমিত হলেও এর রেশ কাটেনি। ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে যখন আন্দোলন জোরদার হতে থাকে তখন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন। এটিকে আমরা আগরতলা মামলা হিসেবে জানি। আগে থেকেই কারাগারে বন্দি থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করা হয়। তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকল বন্দীদেরকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আইয়ুব সরকার যে উদ্দেশ্যে এ প্রহসনমূলক মামলা নাটকের অবতারণা করে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই মামলাটি যে ষড়যন্ত্রমূলক ছিল, তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মামলা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খান সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এমনকি এ গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হলে আইয়ুব খান তার ১১ বছরের শাসন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল আইয়ুব খানের জন্য আত্মঘাতী স্বরূপ। অন্যদিকে, এই মামলা বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিল শাপে বর। এই মামলার সূত্র ধরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত হন। কারামুক্তি লাভের একদিন পর অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফাকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালায়। নির্বাচনের ফলাফল সবারই জানা, আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। অর্থাৎ, ছয় দফা ছিল একটি স্টার্টিং পয়েন্ট। এরপর ক্রমান্বয়ে আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করেছিল এই ছয় দফা।

মূলত ৬ দফার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। ৬ দফা আন্দোলনের মাত্র ৫ বছরের মাথায় পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ইতিহাসবিদ, গবেষকরা অকপটে স্বীকার করে নেন যে, ছয় দফা আন্দোলন না হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হতো না।

জনগণের আবেগ বুঝতে সক্ষম না হলে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না। রাজনীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে জনগণের কত কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাই প্রমাণ হয়। ৬ দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ- উক্তিটি যথার্থ। ছয় দফা উত্থাপন না হলে আর কতকাল বাঙালিকে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকতে হত, তা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত