ছয় দফা : স্বাধীনতার বীজ বপন

2601

Published on জুন 7, 2020
  • Details Image

ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শামীম খানঃ

"সত্য যদি হয় ধ্রুব তোর
কর্মে যদি না রয় ছল,
ধর্ম দুগ্ধে না রয় জল
সত্যের জয় হবেই হবে
আজ নয় কাল মিলবেই ফল"

লক্ষ্য, কর্ম ও সততার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বিজয় সূর্য উদিত হতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপরোক্ত লাইনগুলো চিরন্তন সত্য। যেকোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সততা,নিষ্ঠা, একাগ্রতা খুবই জরুরী। আর সে লক্ষ্য যদি হয় একটি জাতিগোষ্ঠীর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার তবে মিথ্যা, প্রতারনা,নিজস্বার্থ পরিহার করে সততার সহিত পুরো জাতির বিশ্বাস অর্জন করে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে তার কর্ম দিয়ে সে বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন।ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে এসে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি স্বাধীন ভূখন্ড "বাংলাদেশ"।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এ সময়ে এই ভূখন্ডে ঘটেছে অনেক প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত ঘটনা। প্রত্যেকটি ঘটনাই বাঙালি জাতির অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছে।যে বিষয়টি বাঙালি জাতির চোখ খুলে দিয়েছে তা ৬-দফা। এই ৬-দফা দিয়েই আমরা বুঝতে পেরেছি আমরা কোন অবস্থায় আছি, আমাদের কোন অবস্থায় থাকা উচিত, আমাদের অধিকার কি ? আমরা আসলে কি চাই?

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের অবসান হলে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হলেও শাসনব্যবস্থা, সুবিধা-অসুবিধা, অর্থনীতি অলিখিতভাবে পাকিস্তানকে দুটি অংশে বিভক্ত করে।একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান।বরাবরই পূর্ব পাকিস্তান ছিল শোষিত ও বঞ্চিত।

১৯৫২ সালে ভাষার ক্ষেত্রে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে সর্বদা স্পষ্টতর হয়ে উঠে যে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারন উপেক্ষিত, শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ধারাবাহিক শোষন-নিপীড়ন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম দেয়।

১৯৬৫ সালে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও উদাসীন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। তাসখন্দ চুক্তির পর রাজনীতির গতিধারা নিয়ে আলোচনা করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বমোট ২১জন প্রতিনিধি যোগদান করেন।

১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালিন আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ সহ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ লাহোরে পৌঁছান। ৫ ফেব্রুয়ারি সাবজেক্ট কমিটির সভায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের দাবি হিসেবে বঙ্গবন্ধু মুজিব ৬-দফা প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনে আলোচ্যসূচির অন্তর্ভূক্তির দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ ফেব্রুয়ারীর সম্মেলন বর্জন করেন।

১৯৬৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনা না করে তাসখন্দ চুক্তি সম্বন্ধে তিনি কিছু বলবেন না।১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন।ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে লাহোরে সাবজেক্ট কমিটির মিটিং এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, তার দেওয়া ৬-দফা অন্তর্ভূক্ত করে আন্দোলনের কোনও প্লাটফর্ম হলে তিনি তার সাথে থাকবেন।

১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬-দফা প্রস্তাব ও দাবি আদায়ের লক্ষে কর্মসূচি গৃহীত হয়। ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে "আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি" শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।এই পুস্তিকা প্রচার এতটাই ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।

লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬-দফা উত্থাপন করা হয় ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ।

১৯৬৬ সালের ৬-দফা দাবিসমূহ :-

এক- পাকিস্তান হবে ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্র ও ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে, সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

দুই- কেন্দ্রীয়(ফেডারেল) সরকারের কাছে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক থাকবে। বাকি সব বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা নিরুঙ্কুশ থাকবে।

তিন- সমগ্র পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা সমস্ত পাকিস্তানের জন্য একটি মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে তবে একটি কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে মুদ্রা পাচার হতে না পারে তার জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

চার- ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলির রাজস্বের একটি অংশ সমহারে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে জমা হবে।

পাঁচ- অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে পন্য বিনিময়ে কোন শুল্ক ধার্য করা যাবে না এবং অঙ্গরাজ্যগুলো যাতে বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধি বিধান রাখতে হবে।

ছয়- আঞ্চলিক সংহিত ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য অঙ্গরাজ্যগুলিকে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দিতে হবে।

রংপুর, দিনাজপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ৬-দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য ৬-দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষন সহ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। পাকিস্তানি শাসকরা এই ৬-দফার প্রস্তাব কখনই ভালভাবে নেয়নি তাই বঙ্গবন্ধুকে ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বকে মামলা, জেল-জরিমানার মাধ্যমে হয়রানি করা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে বারবার গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়নগঞ্জে ঐতিহাসিক "মে দিবস" স্মরনে জনসভায় বক্তৃতা করার পর বঙ্গবন্ধু গভীর রাতে বাসায় ফিরলে বঙ্গবন্ধু সহ ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' হিসেবে অবিহিত করে পাকিস্তান সরকার। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপর গ্রেফতার-নির্যাতন প্রকট আকার ধারন করায় ২০ মে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং এ '৭-জুন' হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ৭ জুন হরতাল সফল করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারন জনগন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ৭ জুন হরতাল সফল করার জন্য যে প্রচারপত্র তৈরি করে তার কয়েকটি স্লোগান ছিল-

শ্রমিক-ছাত্র জনতা - এক হও
৬ দফা - কায়েম কর
টেন্ডুপাতা অর্ডিন্যান্স - বাতিল কর
পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা - দিতে হবে

এভাবে সকল অঞ্চলে ৭ জুন হরতাল সফল করার জন্য প্রচার-প্রচারনা চালায় আওয়ামী লীগ। ৭ জুন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন হয়েছিল। শ্রমিক-ছাত্র-জনতা হরতাল সফল করতে ঢাকা, টঙ্গী, নারায়নগঞ্জ সহ অনেক জায়গায় খুবই সক্রিয় ছিল। হরতাল যাতে সফল না হয় সেজন্য পাকিস্তানি সরকার শ্রমিক-ছাত্র-জনতাকে বাধা দিতে গিয়ে গুলিবর্ষন করে।

৭ জুন হরতাল সফল করতে গিয়ে মনু মিয়া,শফিক,শামসুল হক ও আবুল হোসেন সহ ১১ জন শহীদ হন। শ্রমিক জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে তারা প্রমান করেছে ৬-দফা প্রশ্নে তারা আপোষহীন। '৭ জুন' ৬-দফার ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ও শ্রমিক-জনতার জীবনদানের জন্য এই ৭ জুনই "৬-দফা দিবস" হিসেবে পালন করা হয়।

১৯৬০-৬৫ অর্থবছরে মোট ব্যয়ের ৭০.৫ শতাংশ ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে বাকিটা পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৫-৭০ অর্থবছরে মোট ব্যয়ের ৭০.৮২ শতাংশ ব্যয় করা পশ্চিম পাকিস্তানে বাকিটা পূর্ব পাকিস্তানে। যেখানে রপ্তানি(যেমন পাট) আয়ের সংখ্যাগরিষ্ট অংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে হতো সেখানে এ শোষন অন্যায় মেনে নেয়া কষ্টসাধ্য।রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সমানুপাতিক হারে ছিল না। সর্বক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান ছিল বঞ্চিত। তাইতো ৬-দফার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগন একমত ছিল এবং স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল যে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৬-দফা প্রচার-প্রচারনার আলোচনায় থাকায় নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয়। অনেকেই বলে থাকেন জনগনের এ রায় ৬-দফার পক্ষের রায়। এই নির্বাচনের ফলাফল দেখেই বলা চলে ৬-দফা হয়ে উঠেছিল মানুষের প্রানের দাবি।

১৯৫২, ৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০-এ পাকিস্তানি সরকারের আচরন দেখে এটা স্পষ্ট হওয়া গেছে বাঙালি জাতির মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীনতা। তাইতো বঙ্গবন্ধুর এক অঙ্গুলির নির্দেশে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। আর এই স্বাধীনতার জন্য সকল আন্দোলন সংগ্রামের ভূমিকা থাকলেও ৬-দফা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বীজ বপন স্বরুপ।

লেখক: সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ; সাবেক সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত