পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির পথ-ছয় দফা

2545

Published on জুন 6, 2020
  • Details Image

হাসনাত আসিফ কুশলঃ

১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী বহুজাতিক ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলে পৃথক দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব থাকলেও জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বই তাতে প্রাধান্য পেয়েছিলো। এর ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একাটি ‘অবাস্তব ভৌগোলিক কাঠামোর’ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো। এ রাষ্ট্র ছিলো উদ্ভট রাষ্ট্র। এর মাঝখানে ছিলো বারোশত মাইল বিস্তৃত একটি বিদেশি ভুখণ্ড।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর ভেতর চলতে থাকে পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্য, নিপীড়ন। শুরুতেই আসে ভাষার দিক থেকে নিপীড়ন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলার স্থলে মুষ্টিমেয় কয়েক পুঁজিপতি ও আমলার ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে চক্রান্ত করেছিলো, বাঙালিরা তার বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বেলেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশ কতৃক ছাত্র হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার জনগণ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু সামরিক শাসনের দুর্বুদ্ধিতে ১৯৫৮ সাল থেকে চলতে থাকে আইয়ুব খানের দুঃশাসন। ফলে পূর্ব বাংলার গণতন্ত্রমনা রাজনীতিবিদদের ওপর খড়গহস্ত হয় তার সরকার। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয় (পৃষ্ঠা নং ১৩১, ছয় দফা অধ্যায়, আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, মহিউদ্দিন আহমদ)। এ পর্যায়ে শেখ মুজিবের প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ দুটো পুস্তিকা লেখেন- ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ’ ও ‘পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’। ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘শেখ মুজিব প্রচণ্ড পরিশ্রম, ত্যাগ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।...কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বিরাট একটা বোমা ফাটালেন- ছয় দফা।’

তখন ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে। আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করেছেন সবে। পাকÑভারত যুদ্ধের পর যখন আইয়ুব খান পাকিস্তানব্যাপী সমালোচিত হচ্ছিলেন, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি নসরুল্লাহ খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ সম্মেলনে যেতে বললেও তিনি শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কয়েকজনকে এ সম্মেলনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তবে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন ‘মানিক মিয়া’র পরামর্শে লাহোরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস সাত দফা প্রস্তাব প্রস্তুত করেন। সপ্তম প্রস্তাব ছিলো প্রদেশে নির্বাচিত গভর্নরের বিধান রাখতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় মতাদর্শ যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুগামী, সেহেতু এ দফাটি বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত মনে করলেন শেখ মুজিব। আর এ কারণে এটি ছয় দফা হিসেবে পরিচিত।

‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ের ‘ছয় দফা’ অধ্যায়ের ১৩৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, শেখ মুজিব যখন লাহোরে ছিলেন তখন তাঁর কর্মস্থল আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির যে ঘরে বসে তিনি এ খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন, তার একটি কপি সাংবাদিক আব্দুর গাফ্ফার চৌধুরীর হাতে আসে। তিনি এটা সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ-এ ছাপিয়ে দেন। এ সময় ছয় দফা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য করতে থাকে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ-এর প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানের মন্তব্য নেতিবাচক বলেও উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমদ। এ ব্যাপারে আতাউর রহমান খানের মন্তব্য ছিলো এমন: ‘অধিবেশন চলাকালে শেখ মুজিব হঠাৎ নিক্ষেপ করলেন ছয় দফা। প্রস্তাব বা দাবির আকারে একটা রচনা নকল করে সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হলো। কোনো বক্তৃতা বা প্রস্তাব নেই, কোনো উপলক্ষ নেই, শুধু কাগজ বিতরণ। পরে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। জাতীয় কন্ফারেন্সে এই দাবি নিক্ষেপ করার কী অর্থ হতে পারে ?’

আতাউর রহমান যা বলতে চেয়েছেন তার মর্ম, শেখ মুজিব লাহোরে যে ছয় দফা প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন, তখনও তার সময় হয়েছিলো না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই ছয় দফাই বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ২৯৫ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ‘৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিলো বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ।...’

ছয় দফা বাস্তবায়ন ও শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার রাজপথে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের স্ফূরণ হয়। পূর্ব বাংলার মানুষ ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন করতে থাকে। ধিক্কার দিতে থাকে আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রকে’। এমন অবস্থায়ও আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে ঢাকায় তার সরকার গঠনের দশকপূর্তির উৎসব হিসেবে ‘উন্নয়ন দশক’ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এটাই তার পতন ঘনিয়ে আসার পূর্বাভাস দেয়।

আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ‘মিথ্যা’ অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আইয়ুব খানের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের স্ফূরণ ঘটে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ ও মেনন গ্রুপ), জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (দোলন গ্রুপ) একাংশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। আওয়ামী লীগের ছয় দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তারা এক সংবাদ সম্মেলনে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।

ছয় দফা ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়নের সমুচিত জবাব। কিন্তু এ প্রস্তাবের প্রতি আইয়ুব খান সরকারের উন্নাসিকতা বাংলার মানুষকে অভ্যুত্থানের পথে নিয়ে যায়। বিশেষ করে এতে যা তুলে ধরা হয়েছিলো তা বাঙালিদের জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তথাপি এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সরকার চরম ঔদ্ধত্য দেখায়। তাদের এ বিমাতাসুলভ নীতিই বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর ডাকে হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১১ জন নিহত হন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এতে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। এর ফলে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

ছয় দফার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
লাহোরে উত্থাপিত ছয় দফা প্রস্তাবকে শেখ মুজিব ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ বলে আখ্যায়িত করেন। শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘তিনি যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন তা বাংলার মানুষের বাঁচার দাবি হিসেবে করেন, সেখানে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি উত্থাপন করেন যার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ৮ মে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয় এবং করাচি সেনানিবাসে নিয়ে যাওযা হয় তাঁকে (পৃষ্ঠা নং ২৫২, কারাগারের রোজনামচা)। এরপর ১৯৬৭ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁকে মুক্তি দেয়ার পর জেলগেটের বাইরে পদার্পনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান আর্মি, নেভি, এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট-এ আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় (পৃষ্ঠা নং ২৫৪, কারাগারের রোজনামচা) এবং করাচি সেনানিবাস থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে (পৃষ্ঠা নং ২৫৫, কারাগারের রোজনামচা)। ছয় দফার ভিত্তিতেই পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান সরকারবিরোধী ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়। এ বিক্ষোভ পরবর্তীতে রূপ নেয় গণআন্দোলনে এবং সেখান থেকে সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থান। ছয় দফার চেতনায়ই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়।

লেখকঃ অনলাইন এক্টিভিস্ট

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত