4755
Published on মে 29, 2020ডঃ মোহাম্মদ সেলিমঃ
পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণকে স্বায়ত্তশাসন, মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ভাষার প্রশ্নে যে আন্দোলনের শুরু, মুক্তিযুদ্ধে তার সমাপ্তি। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ ঘটে। ভাষার প্রেম রূপান্তরিত হয় দেশপ্রেমে। মাতৃভূমি, মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ বাঙালি মুসলমানের মনোজগতে এক নবজাগরণের সৃষ্টি করে। এই পর্বে নেতৃত্ব দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী। শুরু থেকেই জাতীয় নেতাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব এবং আদর্শবাদী যুবকদের একটি দল। যাঁদের অনেকে পরবর্তীকালে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে জনপ্রিয় তরুণ নেতা শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর থেকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু। এই পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। বাঙালির দীর্ঘ বঞ্চনা, বৈষম্য আর শোষণের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় ছয় দফা কর্মসূচি; যা ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ হিসেবে আপামর বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। কেউ কেউ ছয় দফাকে বাঙালি জাতির ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলেও আখ্যায়িত করেন।
ছয় দফার তাত্ক্ষণিক পটভূমি হিসেবে ১৯৬৫ সাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। একই বছর মৌলিক গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী প্রহসন বাঙালিদের ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। পরের বছর ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের জাতীয় কনভেনশন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। লাহোরে বাধা পেয়ে তিনি ঢাকার তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে গণমাধ্যমে ছয় দফার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন।
ছয় দফার সংক্ষিপ্ত রূপ
প্রথম দফা : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে।
দ্বিতীয় দফা : প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বাদে সব বিষয় প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
তৃতীয় দফা : পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা করে মুদ্রাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
চতুর্থ দফা : কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের কাছে।
পঞ্চম দফা : প্রদেশগুলো নিজ নিজ বৈদেশিক মুদ্রা ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে।
ষষ্ঠ দফা : প্রদেশগুলো আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে।
ছয় দফা কোনো মনগড়া ভাবনার বিবরণ ছিল না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৮ বছর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাঙালির সীমাহীন বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায্য অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার সুচিন্তিত দলিল। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ ১৮ বছরে প্রদেশ বা কেন্দ্রে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারেনি। প্রশাসনে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। কারণ বাঙালি হওয়াটাই ছিল অযোগ্যতা। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু প্রায় সমস্ত অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর বৈদেশিক ঋণের বোঝা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। নানা অযৌক্তিক অজুহাতে সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নেওয়া হতো না। এসব কিছুই ছিল ঐতিহাসিক সত্য, তাই পাকিস্তানি শাসকরা প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য আর ভয়ভীতি দেখিয়ে ছয় দফার আন্দোলন দমন করতে পারেনি। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন ছয় দফাকে বাঙালিদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য, যৌক্তিক ও জনপ্রিয় করেছে। বাঙালি জাতির মৌল রাজনৈতিক চেতনা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আরো শাণিত হয়েছে।
ছয় দফা নিয়ে অগ্রসর হওয়া এত সহজ ছিল না। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই সমর্থন করেননি। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। মওলানা ভাসানী ছয় দফাকে সিআইএর দলিল বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তবে দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মুখে জবাব দেওয়া হবে। এত ভয়ভীতি, হুমকি বঙ্গবন্ধুকে একটুও টলাতে পারেনি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ছয় দফার বাস্তবায়ন ছাড়া বাঙালির জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়। তাই এই অকুতোভয় বীর দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছিলেন, ‘সরাসরি রাজপথে যদি আমাকে একা চলতে হয়, চলব। কেননা ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’
বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই জানতেন ছয় দফা প্রচারে তিনি বেশি সময় পাবেন না। পাকিস্তান সরকার ও ডান-বাম সব রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে। ছয় দফা সবার শত্রু। সুতরাং তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে—এটাও নিশ্চিত। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রথমবারের মতো জনসভায় তিনি ছয় দফা ব্যাখ্যা করেন। পরে অসংখ্য পথসভা, জনসভায় সারা দেশের অগণিত মানুষের সামনে তিনি ছয় দফার নানা দিক তুলে ধরেছেন। ছয় দফা যত জনপ্রিয় হয়েছে, ব্যক্তি শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আরো সংহত হয়েছে। ছয় দফা আন্দোলনই তাঁকে বাঙালি জাতির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন জনসভায় তিনি আবেগময় ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করেছেন। কিন্তু তাঁর ভাষণ ছিল যুক্তি ও তথ্যনির্ভর। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে ছয় দফার সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান দেশের শতকরা ৭৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসী বাস করে। তথাপি পূর্ব পাকিস্তানকেই বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকারে পরিণত হইতে হইয়াছে কেন? কেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইনসাফ করা হয় নাই? যদি পূর্ব পকিস্তানে পাকিস্তানের তিন-তিনটি রাজধানী থাকিত, যদি সামরিক বাহিনীর তিনটি সদর দপ্তরই এখানে থাকিত, যদি দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক রাজধানী ঢাকায় হইত, যদি বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলির সদর দপ্তর এখানে থাকিত তবে আমরা নয়, ছয় দফার মতো দাবি লইয়া সংগ্রাম করিত পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা।’
১৯৬৬ সালে ছয় দফার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগের ডাকে তত্কালীন পূর্ব বাংলায় হরতাল চলাকালে পুলিশ ও ইপিআর নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালায়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, মুজিবুল হকসহ অনেকে শহীদ হন। গ্রেপ্তার হন কয়েক হাজার মানুষ। ১৯৬৬ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়। দিনটি তাই পালিত হয় ছয় দফা দিবস হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা নির্মম, নিষ্ঠুর পথ বেছে নিয়েছিল। ফল হয়েছে উল্টো, জনগণ আরো অধিকমাত্রায় আস্থা, বিশ্বাস নিয়ে ছয় দফার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যার প্রমাণ মাত্র ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ছয় দফা আন্দোলনের কারণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রুতে পরিণত হন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন, নির্বাচন-পরবর্তী মুজিব-ইয়াহিয়া সংলাপ সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ছয় দফা।
ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা জানি, প্রাচীনকালে এই ভূখণ্ড নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। মধ্যযুগে, বিশেষ করে মোগল ও ইংরেজ আমলে ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে উঠলেও জাতিগতভাবে আমাদের একক সত্তার উন্মেষ হয়নি। ছয় দফা আন্দোলন এ দেশের মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের লাহোরে উত্থাপিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৬ বছর পরে বঙ্গবন্ধু লাহোরে ছয় দফা উত্থাপন করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, ছয় দফা থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ছয় দফার বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। তাই বলা যায়, ছয় দফার মধ্যে বাস্তবে ছিল এক দফা, তা হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।
লেখক : ডিন, ফ্যাকাল্টি অব আর্টস. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ