3397
Published on মে 27, 2020প্রণব কুমার পাণ্ডেঃ
বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ এর ক্রমবর্ধমান বিস্তারের ফলে বেশিরভাগ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি শুধু স্বল্প-মেয়াদী স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিপর্যয়ই সৃষ্টি করেছে তা না বরং পৃথিবীর সকল দেশ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশের মানুষের আয়ের উপর এর প্রভাব এতটাই যে সমাজে বৈষম্য আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, এই বৈষম্যের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সমাজ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মানবাধিকার, প্রাথমিক খাদ্যসুরক্ষা এবং পুষ্টির প্রভাবিত হচ্ছে। পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব, দুর্বল ও অনুন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সাবান ও স্যানিটেশন সংক্রান্ত সরঞ্জামের অভাব কভিড-১৯ এর বিস্তারকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে, উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মতো দেশের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে যত পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও বিপদজ্জনক হারে বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে রোগীর গ্রাফ পিকের দিকে উঠতে পারে এমন আশংকা করলেও বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে পিক আসলে কোথায় সেটি আন্দাজ করা এ মুমূর্তে খুবই কঠিন। অনেকেই আবার বলছেন, জুন মাসের শেষের দিকে এই গ্রাফ নিন্মমুখী হতে শুরু করবে। ফলে অবস্থা যে খারাপের দিকে যাচ্ছে সেটি সহজেই অনুমেয়। এই অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে পারে; কারণ ঈদকে কেন্দ্র করে যে হারে মানুষ ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া শুরু করেছে তা থেকে অনুমান করা যায়, কভিড-১৯ এর সংত্রমণ এত দিন ঢাকা ও তার আশে পাশের শহরগুলোতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও তা এখন গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। সরকার ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধ সত্বেও মানুষের ঢল কোনভাবেই কমছে না।
রোগীর সংখ্যা বাড়ার মধ্যে দোকান ও সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াসহ লকডাউন শিথিল করা সংক্রান্ত সরকরের কয়েকটি সিদ্ধান্ত জনগণের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। যদিও সরকার সুস্পষ্টভাবে নির্দেশণা দিয়েছে যে, সব বাজার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিকে অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশিকা অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে। তবে, একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, এই সমস্ত ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা আদৌও সম্ভব কি? ফলে, অনেকেই ধারণা করেছেন সরকারের এই সিদ্ধান্তসমূহের প্রভাবে সংক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এ কথা ঠিক যে, প্রত্যেক সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে সরকারে উপযুক্ত কারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পোশাক শিল্প, যা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। কারণ তাদের বেশিরভাগ কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে বা যাবে, যদি অনির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য কারখানাগুলো বন্ধ থাকে। ফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে শিল্পটি হুমকির সম্মুখীন হতে পারে একথা সত্য। তাছাড়া, ইউরোপের এবং উত্তর আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ চীন থেকে তাদের কারখানা স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সুতরাং, কভিড-১৯ এর নানা ধরনের নেতিবাচক দিক থাকলেও বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের পক্ষে এটি একটি অপার সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যদি আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা এই সংস্থাগুলোকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, চীন তাদের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিত তারা সেগুলো দিতে সক্ষম। একই সাথে, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোও এই রাষ্ট্রগুলোকে টার্গেট করেছে। এ কথা নির্দিধায় বলা যায়, এটি একটি ভালো কৌশল যা আমাদের অর্থনীতির পুনর্গঠনে সহায়তা করবে। পাশিাপশি এটিও ঠিক যে কভিড -১৯ এর প্রকোপ যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আসে তবে বাংলাদেশ তাদের পরবর্তী গন্তব্য হবে না। অতএব, আমাদের এই সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে একাধিকবার ভালোভাবে চিন্তা করা উচিত। কারণ অর্থনৈতিক লাভের আশায় এমন কোন সিদ্ধন্ত নেওয়া ঠিক হবে না, যা কভিড-১৯ এর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি হলে হিতে বিরপীত হবার সম্ভাবনাই বেশি।
সরকার আসলে উভয় সঙ্কটে পড়েছে কারণ পূর্ণাঙ্গ লকডাউন আরোপ করলে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। আরাব লকডাউন শিথিল করলে কভিড-১৯ এর প্রকোপ বাড়বে। খেটে খাওয়া মানুষের সাথে সাথে সরকার সেই সমস্ত মানুষদের নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত। গত দু'মাসের অচলাবস্তায় এই শ্রেণির মানুষের দুর্ভোগও চরমে উঠেছে। এই শ্রেণির মানুষ ত্রাণ ও সরকারি সহায়তার সন্ধানে যেমন রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পাততে পারছে না, আবার তাদের হাতে পর্যাপ্ত সঞ্চিত অর্থ নেই যা দিয়ে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করে সংসার পালাতে পারবে।
কিছু বাধ্যবাধকতা থাকা সত্বেও, সরকারের উচিত দেশের অর্থনীতিতে কভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমরা যদি এই ভাইরাসের সংক্রমণ অতি সত্বর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি এবং গোটা বিশ্বকে এটা বুঝাতে না পারি যে আমাদের দেশ কভিড-১৯ এর শঙ্কামুক্ত, তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আমাদের দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। কভিড-১৯ সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের মানুষের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। এর অর্থ হল কোনও আন্তর্জাতিক বিমান বাংলাদেশে আসবে না এবং আমাদের বিমানগুলোকে সেই দেশগুলোতে নামার ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। ফলে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে আমাদের দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। কভিড-১৯ এর সংক্রামক প্রকৃতির কথা বিবেচনা করে, বিশ্বের প্রতিটি দেশ অন্য দেশের সাথে তাদের যোগাযোগ পুনরায় চালু করার সময় খুব সতর্ক থাকবে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের যে সমস্ত নাগরিক ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া অবধি তারা এ দেশে ফিরে আসার কথা ভাববে না। তারা না এলে এই দেশগুলোর সাথে বিনিযয়োগ, বাণিজ্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ব্যাহত হতে পারে।
গত ৪ মাসে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছে যারা সেখানে অভিবাসী শ্রমিক হিসাবে কর্মরত ছিল। যদি কভিড-১৯ এর পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতি না হয়, তবে সেসব দেশ এই বিশাল সংখ্যার শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে নিবে না। যদি তারা ফিরে যেতে ব্যর্থ হয় তবে এটি কেবল তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেই প্রভাব ফেলবে না বরং রেমিট্যান্সের প্রবাহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে যেটি আমাদের অর্থনীতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মধ্যে একটি।
স্বস্তির বিষয় হলো আমাদের দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে একটি শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ফলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রির্পোটে বলা হচ্ছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক বিপর্যয়মূলক প্রভাব বাংলাদেশে খুব বেশি প্রকট হবে না। তবে এই ধরনের রির্পোটের উপর নির্ভর করে কোন ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। কভিড-১৯ কতদিন ব্যাপী স্থায়ী হবে সেটি এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টির সাথে সাথে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক দিকটিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা। আর এটি করতে হলে প্রয়োজন উপযুক্ত, বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তববাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যদি আমরা কভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিপক্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি তবে বিশ্বে আমাদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হব। আর যদি না পারি তবে এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আমাদের অনেক সময় লাগবে।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল