‘আমি থাকি অক্ষমের দারুণ ঈর্ষায়’ ধানকাটা ও অক্ষমতা

1665

Published on মে 3, 2020
  • Details Image

খাজা খায়ের সুজনঃ

এ বছরের সরকারি তথ্য অনুযায়ী চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর আবাদি জমির লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর। এই করোনাকালের পূর্ব পর্যন্ত সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কোন সমস্যা ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। খানিকটা ছন্দপতন ঘটায় বর্তমান বিশ্বের মহামারি তথা কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস।

বর্তমানে আমাদের অর্থনীতিতে দিন দিন কৃষি খাতের তুলনায় শিল্প খাতের গুরুত্ব বা অবদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি আমাদের সরকারের লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম একটি। কিন্তু কৃষি খাতের গুরুত্ব এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমাদের মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ১৪.১ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩.৭ শতাংশ। আর যেটি ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাতের অবদান ছিল ১৮.৪ শতাংশ।

অন্যদিকে ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৬.৮ শতাংশ। আর সেটি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর আকার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩.৭ শতাংশে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫.৫ শতাংশ।

এদিকে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বাড়লে অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে ধরে নেওয়া যায়। দুই দশক ধরে জিডিপিতে কৃষির অবদান কমছে, বাড়ছে শিল্প খাতের অবদান। এতে প্রতীয়মান হয়, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। যদিও আমরা ধীরে ধীরে শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দিকে অগ্রসরমাণ কিন্তু আমাদের কৃষির ১৩-১৪ শতাংশের গুরুত্ব অন্যরকম। কারণ আমাদের অর্থনীতি গ্রামীণ অর্থনীতি ।

বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি করোনা মহামারিতে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতির রাষ্ট্র প্রধানদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে এই করোনা। সারাবিশ্বে আজ কোথাও ঘোষিত আবার কোথাও অঘোষিত লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। থমকে আছে অর্থনীতির চাকা। বাংলাদেশ আজ প্রায় দেড় মাসের অঘোষিত লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

আরো পড়ুন: বাই কি চোর, নাকি গুটি কয়েকজনকে নিয়ে ব্যস্ত আমরা?

আমাদের এই মধ্যম আয়ের দেশটিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজে নিম্ন আয়ের, হতদরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের খাবার নিশ্চিত করা। এই দিনমজুরগুলো সবচেয়ে বেশি খাদ্যের অভাবে পড়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আশা জাগিয়েছেন যে, আমাদের পর্যাপ্ত খাবার মজুদ আছে। ঠিক এই মুহূর্তে ৫৬ হাজার বর্গমাইল এর সবুজ-শ্যামল লীলাভূমির প্রায় ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জুড়ে উৎপাদিত হয়েছে বোরো ধান। এই মুহূর্তে লকডাউনের মধ্যে এই ধান কেটে ঘরে তোলাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম সংকট হচ্ছে শ্রমিকের অভাব।

ধানকাটার শ্রমিক সংকট দেখা দেওয়ার সাথে সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটি মোকাবেলায় নির্দেশ দিলেন তার ভ্যানগ্যাড খ্যাত বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। এই নির্দেশের পরপরই ছাত্রলীগ ঝাঁপিয়ে পড়ে ধান কাটায়। এর সাথে সাথে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করলেন, ‘বই খাতা রেখে ঘরে, ছাত্রলীগ পরিবার কৃষকরে তরে।’ এর সাথে সাথে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সারা দেশের নেতা-কর্মী নিয়ে কাস্তে হাতে মাঠে নেমে পড়লেন ধান কাটতে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় সারা দেশের মিডিয়াতে। প্রায় দশ থেকে পনের দিন সংবাদপত্র ও টিভি প্রতিবেদনগুলো ছাত্রলীগময়। অনেক দিন পর মিডিয়াগুলো ছাত্রলীগকে নিয়ে ইতিবাচক ধারায় উপস্থাপন করেছে। আমরা দেখেছি সকল মিডিয়াতে যার মূল কথা ছিল গরীব কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে ছাত্রলীগ। আর এই ছাত্রলীগকে সবচেয়ে বড় উপহারটি দিয়েছেন ছাত্রলীগের অভিভাবক দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জমির ধান এখন পাকতে শুরু করেছে। ধানকাটা নিয়ে সমস্যা যখন সৃষ্টি হল তখন আমি ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দিয়েছি। তারা নিজ নিজ এলাকায় কৃষকের পাশে দাঁড়াচ্ছে। ধান কেটে দিচ্ছে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমার ছাত্রলীগের ছেলেরা করোনা দুর্যোগে এগিয়ে এসেছে। তারা কৃষকের ধান কেটে সহযোগিতা করছে। নিজেরা ফর্মুলা নিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়েছে এবং বিতরণ করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে নিজেরাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে বিতরণ করছে। বাড়ি বাড়ি খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে। এ জন্য ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ।’

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি নেতা-কর্মীর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ধন্যবাদটুকুই যথেষ্ট। ছাত্রলীগের গৌরব, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস অনেক বেশি সমৃদ্ধ। দেশের যেকোন দুর্যোগে, দুর্দিনে নেত্রীর পাশে তথা বাংলাদেশের অসহায়-পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, এটাই তাদের ইতিহাস। ছাত্রলীগ এ জাতিকে পথ দেখায়। যেমনটি পথ দেখিয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা অন্দোলনে, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই সংগঠনের প্রায় সতের হাজার নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছিল। এই সংগঠনটি এই জাতিকে যুগে যুগে পথ দেখাবে, কারণ এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন আমাদের জাতির জনক স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ১৯৮১ সালের পর এই সংগঠনটির দেখভাল করছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে বিভিন্ন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছাত্রলীগ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে, মচকেছে কিন্তু ভাঙ্গেনি। এই বাংলাদেশের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

এই প্রসঙ্গে আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি খুঁটির জোরে বেঁচে যায়। এই খুঁটিটি হলো তার জন্মসূত্রে পাওয়া সংগ্রামের নীতি।’ ছাত্রলীগইতো এই নীতির প্রচলক এই দেশে।

বর্তমানে ছাত্রলীগের ধানকাটা কর্মসূচিকে ভণ্ডুল করার জন্য এই দেশের কিছু অক্ষম ও নীতিভ্রষ্ট লোকজন, কিছু রাজনীতিক উঠে পড়ে লেগে গেছেন। কারণ, ঐ যে দেশরত্ন শেখ হাসিনা অত্যন্ত সুনাম করেছেন এই কাজের। কিছুলোককে দেখলাম ধানকাটার নামে ফটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নষ্ট করছেন কৃষকের ধান, নষ্ট করছেন ছাত্রলীগের সুনাম। অতি উৎসাহী হয়ে কেউ কেউ কাঁচা ধান কেটে ফেলছেন। কেউবা আবার পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে নেমে পড়েছেন কৃষকের ধান কাটার নামে ধান নষ্ট করতে। এরমধ্যে সবচেয়ে মজার ও ন্যাক্কারজনক কাজটি করে ফেলেছেন ছাত্রদল নামক সংগঠনটি। তারা কৃষকদের ধান কেটে দেয়ার নামে ফটোসেশন করে উল্টো কৃষকদের থেকে টাকা দাবি করেছেন। না দিলে মারধর করছেন। বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) এমন ঘটনা ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। ছাত্রদলের ব্যাপারে এমনি অনুমেয় ছিল। কারণ, এর চেয়ে ভালো কোন কাজ তারা করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষী দেয় না। এটিই তাদের ঐতিহাসিক চরিত্র বটে। তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট বলা যায়, চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী।

অচমকা যারা এই রকম ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন তাদেরকে বলি ছাত্রলীগ কিন্তু এই সময়ে অনেক অনেক জায়গায় কোভিড-১৯ বা করোনা আক্রান্ত লাশ দাপন করেছে। আপনারা সেটা অনুসরণ করেছেন নাকি করবেন? ছাত্রলীগ দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাতের অন্ধকারে মানুষের বাড়িতে খাবার পোঁছে দিচ্ছে। আপনারাও পারলে সেটাই করুন। আসলে অনেকে চাইলেও পারবেন না।

কারণ, সেটি যে তাদের ধাঁচে নেই। অধ্যাপক আহমদ শরীফ স্যার লিখেছেন, ‘সব পেশার ও নেশার একটা নীতি-নিয়ম ও রীতি-রেওয়াজ আছে। সবকিছুই পৃথিবীতে শিখতে হয়, জানতে হয় ও অনুশীলন করতে হয়। রাজনীতি ও আকৈশোর সচেতনভাবে মানসিক ও ব্যবহারিকভাবে অর্থাৎ ভাবে, চিন্তায়, কর্মে, অচরণে, অনুশীলনের মাধ্যমে শিখতে হয়।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘মা যেমন সন্তানকে ভালোবাসে বলেই তার জন্য প্রাণ দিতেও রাজি থাকে, তেমনি যারা দেশকে ভালোবাসে, মানুষকে তারাও দেশের স্বাধীনতার জন্যে দেশের মানুষের সেবার জন্যে মঙ্গলের জন্যে নিজের জীবনের সুখ, শান্তি, আনন্দ, আরাম ও ধন-সম্পদ বিসর্জন দিয়ে সর্বত্যাগী হয়ে এমনকি প্রয়োজনে প্রাণ দেয়ার ঝুঁকি নিয়ে দেশের এবং মানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গ করে।’

এই দেশের বিশাল একটি সুশীল সমাজ আছেন যারা সুযোগ পেলেই ছাত্রলীগকে একহাত দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। যারা তিলকে তাল করতে একটুও দ্বিধা করেন না। তারা ভুলেই যান এই বাংলাদেশ জন্মের জন্য যদি কোন ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা থেকে থাকে সেটি একমাত্র ছাত্রলীগ। এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একমাত্র সফল সংগঠনের নামও একমাত্র ছাত্রলীগ।

তাই এই মুহূর্তে সেই সকল সুশীলদের উদ্দেশে বলতে চাই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ম্রিয়মাণ ভালো অতি ভালোকে জিজ্ঞাসা করেছিল তাকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? অতি ভালো জবাব দিয়েছিল, আমি থাকি অক্ষমের দারুণ ঈর্ষায়। বলতেই হয় অতি ভালো আসলে নিরাকার। তার অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। ছাত্রলীগ অতি ভালো না, ছাত্রলীগকে পাওয়া যাবে অক্ষমের দারুণ ঈর্ষায়। ছাত্রলীগ কাস্তে হাতে কৃষকের ক্ষেতে ক্ষেতে।

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক (০২ মে ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত