1433
Published on এপ্রিল 18, 2020দেশ জুড়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে গত ২৮ মার্চ থেকে হতদরিদ্র ও অসহায়দের প্রদান করা হচ্ছে খাদ্য সহায়তা। দেশের হাজার হাজার রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবার সম্মেলিত প্রচেষ্টায় চলছে এই সহায়তা কার্যক্রম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলেও ইতিবাচক ভাবে দেশজুড়ে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জনপ্রতিনিধিরা।
এমনই এক মানবিক জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন ৬০ বছর বয়সী নারী রেজিয়া। তিনি বলেন, 'ত্রাণ নিতে গিয়া ঠেলা ঠেলি কইরা আমরা কী আর শক্তিতে পারি। তাই ত্রাণ আনতে গিয়াও পাই নাই। কিন্তু বাসায় আইসা আমার হাতে চাউল দিয়া গেছে, খুব খুশি হইছি।' কে ত্রাণ দিয়েছে তা অবশ্য জানেন না তিনি। তাই মেয়র আতিক ত্রাণ দিয়েছেন শোনার পর তিনি বলেন, খুব ভালা কাম করছে। আমাগো খাওন আনতে আর বাইরে যাওয়া লাগব না।
মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই ছবির ভয়ে সাহায্য চাইতে পারছে না। সুতরাং নিশ্চুপভাবে ত্রাণ সহায়তা দেয়াটা এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আমি যাদের হাতে হাতে ত্রাণ দিয়ে এসেছি, শুধু তারাই জানে বিষয়টি। তাদের যতটুকু সাহায্য করতে পেরেছি এতেই আমি খুশি। কে ত্রাণ দিয়েছে, কার হাতে সেটা গেছে এটা প্রচারণা যত কম করা যায় ততই ভালো। তিনি জানান, ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়।
সরকারি সহায়তা পৌঁছানোর আগে লকডাউনে নিজ এলাকার মানুষকে সহায়তার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে ৫০ হাজার পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রস্তুত করেছেন বিদ্যুৎ , জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ঢাকা-৩ আসনের এই সংসদ সদস্য কেরানীগঞ্জের ১২টি ইউনিয়নের ৫০ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ ও দিনমজুরদের প্রতিদিনের খাওয়ারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, এই সংকটকালীন সময়ে কেউ তো আর শখ করে ঘরে বসে নাই। আমি এই এলাকার জনপ্রতিনিধি। মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। এখন আমার দায়িত্ব হলো এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো। আমরা সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়ালে তারা একটু ভরসা পাবেন যে, তারা এই লড়াইয়ে একা নন।
দিনাজপুরে নিজ এলাকায় ২০ হাজার মানুষের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছিয়েছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও দিনাজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, কতজন মানুষের কাছে পৌঁছাবো তা বলা কঠিন। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি, যতদিন আমাদের পক্ষে সম্ভব, ততদিন এই খাদ্য সহায়তা চলবে। প্রতিদিন নতুন করে কিছু সংখ্যক মানুষ এই সংকটে পড়ছে। তাদের কাছেও খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সমন্বিতভাবে উপজেলা আওয়ামী লীগ ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের এই সহায়তা কার্যক্রম ভাগ করে নিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এলাকায় সংকটে থাকা সকলের কাছে এই সহায়তা পৌঁছে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
তেমনিভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টায় মাদারীপুরের শিবচর এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ ও শিবচরের স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন এবং নিজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার মানুষকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ছয়বারের নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য বলেন, আমার এলাকায় একটি মানুষও যেনো না খেয়ে থাকে সেই জন্য গ্রাম পর্যায়ে 'খানা'র ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে এভাবে ৪-৫ হাজার মানুষের খাবার পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি আমরা। আমার এলাকার জন্য ১৭৩ মেট্রিকটন চাল মজুদ আছে। পৌরসভায় আরো ৩ মেট্রিক টন মজুদ আছে। সুতরাং এই এলাকার মানুষের খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। রোজার আগেই প্রত্যেকের ঘরে খাবার পৌঁছে যাবে।
চলমান সংকটে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করতে ৫০ হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন নরসিংদী-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু। এরই মধ্যে প্রায় ১২ হাজার মানুষের কাছে এই সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে বাকিদের কাছেও পৌঁছে যাবে।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকায় লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন উজ্জ্বল বণিক। তিনি জানান, কিছু দিন আগে আমার মা মারা গেছে। বাবাও জীবিত নেই। হাতে কাম কাজ নাই। খুবই কষ্টের মধ্যে ছিলাম। পরে এমপি সাব আর শামীম ভাই আমার খাবার পাঠায়া দিছে। আমি এখন পরিবার নিয়ে ১৫-২০ দিন চলতে পারবো। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের এমপি ও সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. একাব্বর হোসেন বলেন, আমরা সমন্বিত ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার পরিবারের কাছে খাদ্য সহায়তা দিতে পেরেছি। সে জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংগঠনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সমন্বিত ভাবেই আমার এলাকার মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হবে।
চট্টগ্রাম নগরীর পলিটেকনিক্যাল এলাকায় এক যাত্রী নিয়ে রিকশায় প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন এক বয়স্ক লোক। দৃশ্যটি দেখেই এক যুবক রিকশার গতিরোধ করে কাছে এসে বলেন, 'চাচা নিন, এখানে চাল, ডাল, তেল, সাবান সবই আছে। শেখ হাসিনা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।' পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাদ্য পৌঁছে দেয়া যুবকের নাম আবু মোহাম্মদ আরিফ। ছাত্রলীগের সহ সভাপতি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এই খাদ্যগুলো দিয়ে এভাবে বিতরণের জন্য তাঁর ছোটভাই ডাঃ বিদ্যুৎ বড়ুয়াকে বলেছেন এবং খাদ্য দেয়ার সময় ছবিও তুলতে নিষেধ করেছেন। গোপনে এভাবে খাবার দেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর বেশ কিছু স্থানে।
এদিকে ব্যক্তি উদ্যোগে বেসরকারি সংগঠন এবং প্রশাসনের সমন্বয়ের মাধ্যমে ফরিদপুর-৪ আসনে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন পরিবারকে সহায়তা করছেন সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী)। দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ পরিবারের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। এই জনপ্রতিনিধি নিজে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ প্রদানসহ ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি করছেন। সেই সঙ্গে এই সংকট মূহুর্তে নিজ এলাকার মানুষকে সচেতন করতে সরাসরি মাঠে নেমে কাজ করছেন তিনি।
নড়াইলে সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং আরেক সংসদ সদস্য বিএম কবিরুল হক নিজস্ব অর্থায়নে স্থানীয়ভাবে খাদ্য সহায়তা প্রদান করছেন। নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য ব্যক্তিগত অর্থায়নে প্রায় ৩ হাজারের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন খাদ্য সহায়তা। দ্বিতীয় দফায় খাদ্য সহায়তা প্রদানে কাজ করছেন তিনি। অন্যদিকে মাশরাফি তার নিজস্ব তহবিল থেকে ১২০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করেন। তিনি জানান, সামনে আরো সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি চলছে।
ঢাকায় গোপনে খাদ্য সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় কমিশনার এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের উদ্যোগে শুক্রবারও খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে ২০০ পরিবারকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনর ২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক নিজ উদ্যোগে ঘরে ঘরে গিয়ে এই সহায়তা দিয়ে আসছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম বাছেক 'কোভিট ১৯' ঠেকাতে এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ‘কুইক ডাক্তার’। যেখানে জরুরি সেবায় কল দিয়ে যে কোন সময় ডাক্তারের সহায়তা পাওয়া যাবে।
এছাড়াও কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে ৩০০ পরিবারকে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সহায়তা প্রদানসহ কুমিল্লা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, যশোরসহ সারাদেশ জুড়ে চলছে সরকারি প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরণের সহায়তা কার্যক্রম। গুটি কয়েক জনপ্রতিনিধি বাদে অধিকাংশরাই নিজেদের ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ নিজ এলাকার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, যা হয়ত এখনো জানা নেই অনেকের।