3191
Published on মার্চ 23, 2020ড. এ এইচ এম কামালঃ
বিশ্বের অনেক দেশেই করোনা ভয়াবহভাবে তার থাবা বসিয়েছে। চোখ রাঙাচ্ছে ছোট-বড় সব দেশের প্রতি। এ বিশ্বায়নের যুগে এমন একটি ছোঁয়াচে ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ সহজ না হলেও তার ভয়াবহতা থেকে বাঁচা সম্ভব। সেজন্য চাই সচেতনতা। সরকার ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। মিটিং, মিছিল, সমাবেশ বন্ধ করা হয়েছে। নিষেধ করা হয়েছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে সব জমায়েত (শুধু মসজিদে নামাজ বাদে)।
সরকার চেষ্টা করে চলেছে করোনার বিস্তার ঠেকাতে। সেজন্য সব পর্যায়ের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য বিধিসহ সরকারের নির্দেশনাবলি পালন না করলে আমাদের মতো ঘনবসতি দেশে করোনা ভয়ংকর রূপ নেবে। কেন আপনি শুরুতেই সচেতন হবেন, তা বুঝতে ভাইরাসের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা নেয়া উচিত। এ ভাইরাসের পরিচিতি ও কীভাবে আক্রমণ করে, আক্রমণের আগে ও পরে কী করণীয়; সে বিষয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। অনেকই বিশদ জানেন। সরকারও যথাযথ এজেন্সির মাধ্যমে জনসাধারণকে তা প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে। এ লেখায় দেখাতে চেষ্ট করব- করোনা কীভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বড় ক্ষতি করে বসতে পারে।
worldometers.info/coronavirus/ সাইটের কিছু তথ্য দিয়ে করোনার বিষয়ে আলোচনায় আসি।
১. শুরুতেই নিচের তথ্যগুলো দেখে নিন।
তারিখ |
আক্রান্তের সংখ্যা |
গড়ে দৈনিক আক্রান্ত |
মৃত্যুর সংখ্যা |
দৈনিক গড়ে মৃত্যু |
২২.০১.২০২০ |
৫৮০ |
১৭ |
- |
- |
৩১.০১.২০২০ |
১১৯৫০ |
১২৬৩ |
২৫৯ |
২৭ |
১৫.০২.২০২০ |
৬৯১৯৭ |
৩৮১৬ |
১৬৬৯ |
৯৪ |
২৯.০২.২০২০ |
৮৬৬০৪ |
১২৪৩ |
২৯৭৭ |
৯৩ |
১০.০৩.২০২০ |
১১৮৯৪৮ |
৩২৩৪ |
৪২৯৬ |
১৩২ |
১৪.০৩.২০২০ |
১৫৬৬৫৩ |
৯৪২৬ |
৫৮৩৩ |
৩৮৪ |
১৭.০৩.২০২০ |
১৯৮২৩৮ |
১৩৮৬১ |
৭৯৭৮ |
৭১৫ |
১৯.০৩.২০২০ |
২৪৪৯৩২ |
২৩৩৪৭ |
১০০৩৫ |
১০২৮ |
২. জানুয়ারির ২২ তারিখ থেকে মার্চের ১৯ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সে পরিসংখ্যান থেকে ভাইরাসটির বিস্তারের সক্ষমতার বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। সংখ্যাটি ৫৮০ থেকে বেড়ে দুই মাসে প্রায় আড়াই লাখে পৌঁছেছে। কাজেই করোনার ছোঁয়াচে শক্তি কত, তা বোঝাতে এর চেয়ে আর কোনো তথ্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
৩. উপরের তথ্য দেখলে বুঝবেন, ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল, মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসছিল। এর কারণ হল চীন সরকার জনসাধারণের হোম কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে এবং চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করে দিয়েছিল।
৪. কিন্তু পরে আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তবে কি চীন আবার ফেল করে? না, তা না। তখন ইতালি, ইরানসহ কিছু দেশে তা বাজেভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিশ্বময় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করে। আমাদের জন্য এ পরিসংখ্যানটাই ভয়ংকর। মানে আক্রমণের শুরুতে উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। আমারা করোনা পরিস্থিতির শুরুতে রয়েছি। কাজেই আমাদের অবস্থাও খারাপ হবে, যদি আমরা এখনই সতর্ক না হই; নিজেরা হোম কোয়ারেন্টিনে না যাই।
৫. ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের হিসাব দেখুন, দৈনিক আক্রান্ত ৩ হাজার ৮১৬ জনের বিপরীতে ৯৪ জন মারা যায় (২.৪ শতাংশ)। ১৯ মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৩ হাজার ৩৪৭ জনের বিপরীতে ১ হাজার ২৮ জন মারা যায় (৪.৪ শতাংশ)। মৃত্যুহার বৃদ্ধির কারণ হল, ততদিনে ইউরোপের কিছু দেশের অবস্থা খারাপ হয়েছে এবং ইউরোপে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। তারা বেশি হারে মারা যাচ্ছেন।
৬. ১৯ মার্চের তথ্য দেখুন, দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছে ২৩ হাজার ৩৪৭ জন। মৃত্যু হাজারের ওপর। এর কারণ হল, করোনা নিয়মিত নতুন নতুন দেশে ছড়াচ্ছে আর সেসব দেশ হিমশিম খাচ্ছে।
৭. উপরের তথ্য বলছে, দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আবার প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি তা অনিয়ন্ত্রণযোগ্য? হয়তো সেটি হবে না। চীন সামাল দিয়ে দিয়েছে। সেখানে নতুন করে আক্রান্তের হার নগণ্য। এর মধ্যে ইরানের মতো দেশেও ভাইরাসের আক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আসছে। আসছে ইতালিতেও। সমস্যা দাঁড়াচ্ছে বিশ্বের অন্য দেশে; যেখানে কেবল ছড়াচ্ছে। তার মানে এটি অনেকটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো। যে দিকে যাচ্ছে, আলোড়ন তৈরি করে এগোচ্ছে। চলে গেলেই সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমাদের দেশে ভাইরাসটি কেবল ঢুকেছে। সাবধান থাকলে আমরাও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব এবং আমাদের উচিত হবে, শুরুতেই ব্যবস্থা নেয়া।
৮. চীনের উহানে মৃত্যু হার ৫.৮ শতাংশ। কিন্তু বাকি চীনে তা ০.৭ শতাংশ। তাহলে উহানে এত মারা গেল কেন? কারণ করোনা বিশ্বে প্রথম উহানেই মানুষকে আক্রমণ করে এবং তা মহামারী আকারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রথমেই ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া উহানে এত বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় যে, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো ডাক্তার, নার্স, ভলান্টিয়ার, ওষুধ, রসদ ও প্রযুক্তি যথেষ্ট পরিমাণ ছিল না। আরেকটি কারণ হল, উহানকে ব্লকডাউন করে দিয়ে চীনের অন্য অংশকে রক্ষা করা হয়েছে। তাই অন্য অংশগুলোতে মহামারী আকার ধারণ করেনি; সেখানে উহানের তুলনায় আনুপাতিক হারে রোগীরা বেশি সুযোগ পেয়েছে। ফলে সেখানে মানুষ বেঁচে গেছে।
৯. আরেকটি সতর্কীকরণ তথ্য দেই। শুরুতে চীনের মৃত্যুহার ছিল ১৯.৩ শতাংশ; যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ০.৭ শতাংশে। এ তথ্য থেকে সাবধান হওয়ার মতো শিক্ষণীয় বিষয় আছে। শুরুতে কম মানুষ আক্রান্ত হলেও মরেছে বেশি। শুরু বলতে ভাইরাস যখন এলার্মিং আকারে ছড়াতে শুরু করে দেয়, ঠিক সেই ধাপকে বোঝানো হচ্ছে। কাজেই আগামী ১৪ দিন আমাদের জন্য একটি মাইলফলক; যা সবাইকে খুব সাবধানে পার করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হবে।
১০. এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের মৃত্যুহার ৪.৭ শতাংশ আর নারীর হার ২.৮ শতাংশ। এটি সম্ভবত এ কারণে যে, নারী পুরুষের চেয়ে বেশি ঘরে থাকে এবং নারী নিজেদের ঘরে আটকে রাখতে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধে সহজে জয়ী হয়। ফলে তারা সহজেই নিজেদের ঘরে আটকাতে পারেন। সেই তুলনায় একজন পুরুষকে ঘরে আটকে রাখা কঠিন। তাছাড়া নারী সিগারেট বা নেশা জাতীয় দ্রব্য কম খান বা পান করেন। ফলে ফুসফুস ভালো থাকে। নারীর সারভাইভ করার পেছনে এ রকম বহুবিধ কারণ পাওয়া যাবে।
১১. পরিস্থিতি সামাল দেয়া কি শুধু সরকারের দায়িত্ব? এর উত্তরে বলতে হয়, মোটেই নয়। সরকারের পক্ষে একা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। যে কোনো দুর্যোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হয়। এটি একটি গ্লোবাল দুর্যোগ। সবাই মিলে কাজ করতে হবে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আমাদের মানতে হবে। সবাই মিলে যুদ্ধ করতে হবে। এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে। সঠিক ওষুধ ও টিকা বের হবে। ঠিক হওয়ার আগে আমাদের ক্ষতি যত কম হয়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য হোম কোয়ারেন্টিনে থাকুন।
১২. করোনা সমস্যা মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হল গুজব। মিথ্যা খবর ছড়ানো, বুঝতে চেষ্টা না করা, কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে নেতিবাচক বিষয় বাস্তবায়নের ধান্দা করা, ধর্মীয় ব্যাখ্যায় পরিস্থিতির গুরুত্বকে অবহেলা করা বা তেমনি কিছু বিষয় আছে যা করোনা মোকাবেলার পথে মূল অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। কাজেই সবাই মিলে সরকারকে সহায়তা করুন; এ বিষয়ে আন্তরিক হোন, নিয়মনীতি মেনে চলুন।
১৩. শেষে আশার কথা বলি। মানবজাতির ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি নয়। এ রোগে মৃত্যুহার বেশ কম। করোনার মূল সমস্যা হল এর ছোঁয়াচে গুণ। দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু পরিবার-পরিজন সব হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা কম (যদিও সব ওপরওয়ালার ইচ্ছা)। কোনো এক সময় কলেরা রোগে গ্রামের পর গ্রাম নিপাত হয়ে যেত। সেই দিন আর নেই। করোনার বংশধর সার্স ভাইরাসের মৃত্যুর হার ছিল ১০ শতাংশ। আরেক বংশধর মার্সের মৃত্যুহার হিল ৩৪ শতাংশ। করোনার এ দুটি গ্রুপ আমাদের দেশে আসেনি। কিন্তু যেখানে গিয়েছিল, তাদের কথা ভাবুন! অতএব ‘নভেল করোনা-১৯’কে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মোকাবেলা করুন। সাবধান থাকুন। ঘরে থাকুন। নিজের কাছের মানুষদেরও ঘরে থাকতে বলুন। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করুন। খুব শিগগিরই আবার হাসবে পৃথিবী; সে পর্যন্ত সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করুন।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশঃ দৈনিক যুগান্তর (২২ মার্চ ২০২০)