2699
Published on মার্চ 17, 2020 গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরু থেকে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অবহেলা, চাপা ঘৃণা, অন্যায়-অত্যাচার ও ঘোর বৈষম্য আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে। তাদের দুঃশাসন, শোষণ-বঞ্চনা আমাকে একরকম বিদ্রোহী করে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানের এক কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা সামরিক বাহিনীতে তাদের একচ্ছত্র অবস্থানের জন্য। আমার আরও মনে হয়েছিল, পাকিস্তানের পশ্চিমা কেন্দ্রে দেশের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার এটাই একমাত্র কারণ। এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, সামরিকতন্ত্র চর্চা করে। তাদের সামরিকতন্ত্র চর্চায় মূল শক্তি পাঞ্জাবি সেনাদের আধিপত্য। সেনাবাহিনীতে প্রায় সবাই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী এবং পাঞ্জাবের আধিপত্য সর্বোচ্চ ও সর্বত্র। বাঙালিদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এক প্রকার নাই বললেই চলে। আমি আরও বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম, আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে, বাঁচার মতো বাঁচতে হলে এবং সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে থাকতে গেলে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি সব সময়ই দৃঢ় সংকল্প ছিলাম যে, একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের রক্তঝরা পথেই একদিন বাঙালির জাতীয় মুক্তির চেতনা স্বাধীনতায় রূপ লাভ করবে।
আমি মনে মনে ভাবতাম, আমাদের স্বাধীন হতে হলে অধিক সংখ্যায় সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বাঙালি সেনাসদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যেতে হবে। উচ্চ পদগুলো দখল করতে হবে। দক্ষতা ও যোগ্যতায় আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি (বুয়েট)-এ চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকাকালেই (১৯৬২) সেনাবাহিনীতে যোগদান করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণকে আরও কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। আমার ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়। এ অবস্থায় কুমিল্লা সেনানিবাসে অর্ডিন্যান্স কোরের বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন শওকত আলী (পরবর্তীতে কর্নেল ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার) এবং মেডিকেল কোরের আরএমও (ডা.) ক্যাপ্টেন শামসুল আলমের (পরবর্তীতে কর্নেল) সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও পরিচয় হয়। তারা আমাকে নবীন অফিসার হিসেবে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। তারা বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চুপিসারে অনেক কথা বলতেন। মূলত তাদের কাছ থেকেই আমি অনুপ্রাণিত হই। তখন আমারও মনে হয়েছে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ইংরেজদের কাছ থেকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আনতে না পারলেও আমরা বাঙালিরা সেনাবাহিনীর মধ্যে সংগঠিত হয়ে চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই পারব। মতবিনিময়ের একপর্যায়ে আমি বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন শওকতের সঙ্গে কুমিল্লা শহরের বাইরে কয়েকটি বৈঠকেও আমি অংশ নিয়েছি। গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনে বৈঠকস্থল সম্পর্কে তখন তেমন কিছু জানতে চাইনি। অনেক কিছু এতদিনে মনেও নেই। সম্ভবত কান্দিরপাড় এলাকায় কারও বাসায় বৈঠকগুলো হতো। বাড়ির পাশে বেশ বড় পুকুর ছিল।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের তরুণ ফায়ার ব্রান্ড নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার কখনো দেখা না হলেও নানাভাবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের কথা মিটিংগুলোতে জেনে তাঁর ওপর আমি আস্থাবান হয়ে উঠি। ক্যাপ্টেন শওকত বলেছিলেন, এই আন্দোলনের পেছনে শেখ সাহেব আছেন। তাঁরই নির্দেশনায় আমরা কাজ করছি। কুমিল্লায় ১৯৬৬ সালের দিকে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সভাপতিত্বে বৈঠকে তিনিও বলছিলেন, ‘দেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার পেছনে আমাদের শেখ মুজিব নেতৃত্বে আছেন। এখন বিভিন্ন সেনানিবাসে আমাদের কার্যক্রম অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে দ্রুত সম্প্রসারণ করা দরকার।’ আমিও পুরোপুরি আস্থাবান ছিলাম যে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব। তাঁর মধ্যে যে সাহস প্রজ্ঞা বাঙালি জাতিসত্তার প্রকাশ ও নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল তাতে আমি তাঁর প্রতি দৃঢ় অনুরাগী হয়ে পড়েছিলাম। দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় আমি নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম। তিনি যে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা তা তখনই সবাই ভালো করে অনুধাবন করতে পেরেছিল। কুমিল্লা থাকাকালে আমি বেশ কিছু সেনাসদস্য ও জুনিয়র অফিসারকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করি। তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করি। তারা প্রয়োজনে সংকেত পেলে তাদের ওপর নির্দেশিত কর্মকান্ড শুরু করবে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল উপযুক্ত সময়ে একটি নির্দিষ্ট রাতের নির্দিষ্ট ক্ষণে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হব। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবকটি ক্যান্টনমেন্টে একসঙ্গে কমান্ডো স্টাইলে অতর্কিতে ধ্বংসাত্মক হামলা চালাব। পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিটগুলো থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের নিষ্ক্রিয় করে বন্দী করব।
ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ইউনিটগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য মজুদ থাকে। কোথাও মাইন লাগানো, সেতু ধ্বংস করা, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার মতো কঠিন কাজগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সৈনিকরাই করত। আমার পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনীর অন্য যারা আমাদের সদস্য হবেন তাদের বিস্ফোরকের ব্যবহার সম্বন্ধীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যাতে চরম মুহূর্তে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার তারা করতে পারে। দিন, তারিখ ও সময় ঠিক হলে বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর দায়িত্ব আমি যথাযথভাবে পালন করব এ ব্যাপারে আমার ওয়াদা ছিল।
আমার তখনো ইঞ্জিনিয়ারিং বেসিক কোর্স সম্পন্ন হয়নি। ও কোর্স হতো পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুরের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সম্ভবত ১৯৬৭ সালের প্রথম দিকেই এই কোর্স করার জন্য আমাকে রিসালপুরে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আমি নিয়োগ পাই পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর তীরে ঝিলাম সেনানিবাসে। ওই সময় আমার বিয়ে ঠিক হলে ছুটি নিয়ে দেশে আসি। এসেই বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি যে, ক্যাপ্টেন শওকত গ্রেফতার হয়েছেন। আমাকেও যে কোনো সময় গ্রেফতার করা হতে পারে। এ অবস্থায় বিবাহিত জীবনে আরেকজনের জীবন সম্পৃক্ত করে বিপদে ঠেলে দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। আমি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমার হবু স্ত্রীকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমি তাঁকে বিষয়টি পুরোপুরিভাবে অবহিত করি। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের ছাত্রী। আশ্চর্য! সব কথা শুনে তিনি এতটুকুও বিচলিত না হয়ে আমাকে সাহস জোগান। তিনি বলেন, যা হওয়ার হবে। তখন দেখা যাবে। আপনার সঙ্গেই আমার ভাগ্য আমি জড়িয়ে ফেলেছি। আপনারা তো দেশের জন্যই কাজ করছেন। এটা তো আমার জন্য গর্বের কথা। এরপর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি ঝিলামে ফিরে যাই। পরে আমি শুনেছি যে, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা জানতে পারে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার এ প্রক্রিয়ার (দেশ স্বাধীনতার কর্মকান্ডে) সঙ্গে যুক্ত এবং সে কোথায় আছে, নাম কী, ইত্যাদি জানার জন্য ক্যাপ্টেন শওকতের ওপর, ক্যাপ্টেন আলমের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। নির্যাতন, অত্যাচার সত্ত্বেও তারা কেউই আমার নাম বলেননি। ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে যান। ফলে শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় আমার নামটি আসামি হিসেবে আসেনি। মামলা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেলে আমি শঙ্কামুক্ত হই। পরবর্তীতে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রী-সন্তানসহ পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে মনে অনেক কষ্ট ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের সহযোগিতায় (আইসিআরসি) মাধ্যমে দেশে ফিরি। স্বাধীন দেশের গৌরবান্বিত সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে মনে-প্রাণে নিবেদিত থেকে শুধু দেশেরই সেবায় সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে পেশাদক্ষ অফিসার হিসেবে নিজেকে নির্মাণ করি। ক্যারিয়ারের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার গৌরব অর্জন করি। এ আমার অনেক বড় পাওয়া। আমি বিশেষ করে ক্যাপ্টেন (কর্নেল) শওকত আলী ও ক্যাপ্টেন (কর্নেল) শামসুল আলমের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তারা আমার জন্য অনেক নির্যাতন হয়েছেন, অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকার করেছেন। কর্নেল শওকত আলী তার বই সত্য মামলা আগরতলায় (প্রথমা প্রকাশন পৃষ্ঠা-১১৮) লিখেছেন, রাওয়ালপিন্ডিতে ৩ সপ্তাহের জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার বারবার মনে হয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাকে সব কথাই স্বীকার করতে হবে। কারণ আমার জানা এমন কোনো তথ্য ছিল না, যা জিজ্ঞাসাবাদকারীরা ইতিমধ্যে জানে না...। যাই হোক, আমি কিছুটা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করছি যে দৈহিকভাবে যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তব ঘটনার অস্বীকৃতির সংকল্প আমি অক্ষুণ্ন রেখেছি এবং কর্তৃপক্ষের কাছে এমন একটি ঘটনাও জানাইনি যা তারা জ্ঞাত ছিল না। এ কারণেই... মাহবুবসহ আরও অনেকে যাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল কিন্তু বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা কর্তৃপক্ষের অজানা ছিল, তাদের নাম আমি প্রকাশ করিনি। যদিও কুমিল্লার সভায় মাহবুব উপস্থিত ছিল আমি ছাড়া অন্য কেউ তার নাম জানত না। কারণ সভায় অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিইনি। তার নাম তাই কর্তৃপক্ষের অজানাই থেকে গেছে। আমার চেয়ে অধিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েও আরও অনেকে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে সঠিক তথ্য প্রকাশ করেননি।
আগরতলা মামলার স্মৃতি সংরক্ষণে আমি সেনাপ্রধান থাকার সময় ১৯৯৬ সালে ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা মামলা পরিচালনার জন্য গঠিত বিশেষ আদালত কক্ষটিকে জাদুঘর করার উদ্যোগ নিই। এর আগে আমি ক্যাপ্টেন (কর্নেল) শওকত আলী, ক্যাপ্টেন (কর্নেল) শামসুল আলমকে সেনাসদরে আমন্ত্রণ জানাই। আমি তাদের আগরতলা মামলার বিষয়বস্তু তথা স্বাধীনতার জন্য গোপন আন্দোলন এবং এতে বঙ্গবন্ধুসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যক্রম ঐতিহাসিকভাবে স্মরণ রাখার জন্য একটা কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সেনানিবাসে আদালত হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষটিকে জাদুঘর হিসেবে তৈরির উদ্যোগ নিই। বিজয়কেতন নামেই ওই জাদুঘরটি ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে আদালত চলাকালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য আসামিদের যেভাবে আসন বিন্যাস ও এজলাস ছিল সেভাবেই সাজানো হয়েছে। সেখানে আদালত চলাকালে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসগুলোও রাখা হয়েছে। আমার মনের সান্ত্বনা এই যে, স্বাধীনতার ২৫ বছর পর হলেও (১৯৯৬ সালে জাদুঘর নির্মাণ করার সময়) ঐতিহাসিক ঘটনাটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা ভূমিকা আমি রাখতে পেরেছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন