2398
Published on মার্চ 17, 2020রফিকুল ইসলামঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্য নেতাদের চেয়ে পৃথক এ জন্যই যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুই আমাদের দিয়ে গেছেন বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্র ও ভাষারাষ্ট্র। আমরা বছরের পর বছর বিদেশি ও বহিরাগতদের দ্বারা শাসিত, বঞ্চিত, শোষিত, লাঞ্ছিত, পদানত, নিষ্পেষিত হয়েছি। আমাদের প্রিয়তম বাংলা ভাষা, আমাদের জাতিসত্তা পিষ্ট হয়েছিল বহিরাগত শাসকদের হাতে। তাদের শাসন-শোষণে হীনম্মন্যতায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা বাঙালি, হারিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের নিজস্ব জাতিসত্তা। আমাদের হীনম্মন্যতা, জাতিসত্তার সংকট, ভাষার দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে রক্ষা করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির শিকড় গভীরে প্রোথিত করেছেন তিনি। আমরা সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে কথা বলি, নিজের পরিচয় দিতে পারি। আমাদের পরিচয় সংকট থেকে রক্ষা করেছেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালির দেবদূত। এ জন্যই কোটি কোটি বাঙালির ভেতর তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৩ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমি থেকেছি রমনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ওই সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেসব ঘটনা ঘটেছে সেসব দেখেছি, জেনেছি, কখনো অংশ নিয়েছি। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্য থেকে যাঁরা বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ইতিহাসের নায়ক বনে গেছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁকে প্রায়ই ফজলুল হক হল এলাকায় দেখতাম। ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলটি ছিল পুকুরপারে। সেটা ছিল ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রস্থল। আমি ফজলুল হক হলের উল্টো দিকে রেল কলোনিতে থাকতাম, তবে ফজলুল হক হলের মাঠে খেলতাম, পুকুরে গোসল করতাম, ঘাটে বসে আড্ডা দিতাম। এ সুবাদে অনেক ছাত্রনেতাকেই ফজলুল হক হলে ও মিলনায়তনে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতে দেখেছি, যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে সেকালের ছাত্রনেতাদেরও প্রায়ই দেখা যেত। যেমন—তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, জিল্লুর রহমান প্রমুখ।
১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল মূলত ফজলুল হক হল থেকেই। বাংলা ভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কলাভবনের আমতলায় সভার পর শোভাযাত্রা করে ছাত্ররা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও ফজলুল হক হলের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস বা প্রেস ক্লাবের পাশে শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে কিংবা সচিবালয়ে দাবিদাওয়া পেশ করতে যেত। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ সাহেবকে দেখেছি ফজলুল হক হল মিলনায়তন, কলাভবন প্রাঙ্গণে বক্তব্য দিতে। আরো দেখেছি সচিবালয়ের সামনের গেটে অন্য ছাত্রনেতাদের নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করতে। পুলিশের লাঠিপেটা হজম করেও তাঁরা তাঁদের অবস্থান থেকে সরে আসতেন না। ১১ মার্চ ১৯৪৮ বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর সচিবালয়ের প্রবেশপথে পুলিশের প্রচণ্ড লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপে আহত হয়েছিলেন বহু ছাত্র। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন শওকত আলী। শেখ সাহেব তাঁকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আবার সচিবালয়ে ফিরে যান এবং সেখান থেকে সচিবালয় অবরোধকারী অন্য ছাত্রনেতার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। এসব দৃশ্য আমি ১৯৪৮ সালে সচিবালয়ের উল্টো দিকে রেল কলোনির ভেতর থেকে দেখেছি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ভূমিকা দেখেছি।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সহায়তা করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রনেতাকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যান্য ছাত্রনেতা জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে রেহাই পেলেও শেখ সাহেব জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের রুটি-রুজির দাবিতে অনুষ্ঠিত সভায় জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য দেন। কলাভবনের সামনে কর্মচারীদের সভায় শেখ সাহেবকে বক্তব্য দিতে দেখেছি।
প্রথম যৌবনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, এরপর পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, ধাপে ধাপে বাঙালির মুক্তির নানা আন্দোলন করেছেন বঙ্গবন্ধু। ধীরে ধীরে বাঙালিকে প্রস্তুত করেছেন, জাগিয়ে তুলেছেন স্বাধীনতার জন্য। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের অনিবার্য ফল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে আলোড়িত ঘটনা। আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি কিছু নেই। অসংখ্য প্রাণ, ত্যাগ-সংগ্রাম এবং কান্নার বিনিময়ে পাওয়া সার্বভৌমত্ব, নিজস্বতা। ২৩টি বছর আমাদের থাকতে হয়েছিল একটি বর্বর জাতির সঙ্গে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতটা বর্বরতা, পৈশাচিকতা চালাতে পারে, তা কেবল যারা প্রত্যক্ষ করেছে, তারাই বলতে পারবে। গল্প শুনে, ইতিহাস প?ড়ে হয়তো কল্পনা করা যাবে, কিন্তু উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বর্বরদের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে শুধু উদ্ধার করেননি, মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালিকে দিয়েছেন ভাষা ও জাতিসত্তার শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশ। সারা জীবন তিনি ন্যায়ের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এ উচ্চতায় আর কোনো বাঙালি পৌঁছাতে পারেনি, পারবেও না।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল কিছু অমানুষ। জাতির পিতাকে শুধু হত্যা নয়, নির্মূল করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বংশধর এবং বিকৃত করতে চেয়েছিল তাঁর মহামূল্যবান অবদান। ইতিহাসের সত্য কখনো চাপা থাকে না। দিন যত যাবে, বঙ্গবন্ধু তত উজ্জ্বল হবেন। যত দিন পৃথিবী থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, তত দিন স্বমহিমায় উজ্জ্বল থাকবেন বঙ্গবন্ধু।
লেখক : জাতীয় অধ্যাপক ও সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন বাস্তবায়ন কমিটি
প্রকাশঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ