1740
Published on মার্চ 17, 2020জাফর ওয়াজেদঃ
বাঙালি জাতির জীবনে নতুন বাঁক নেওয়ার মাস মার্চ, ১৯৭১। বাঙালির নিজ ঘরে ফেরার প্রস্তুতিপর্ব। সহস্র বছরের সাধনা শেষে একটি জাতির নিজস্ব সত্তার দিকে মুখ ফেরানোর এক উজ্জ্বল সময়। সমগ্র বাংলাদেশ তখন শেখ মুজিবের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়ে আসছে। সে এক যুগান্তকারী ক্ষণ ও সময়। অন্যরকম এক উপলব্ধিতে দেদীপ্যমান পুরো জাতি। এ এক অসহযোগ আন্দোলন, গান্ধীর অহিংস আন্দোলনকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই আন্দোলন ছিল অন্যসব আন্দোলন থেকে ভিন্ন। এ আন্দোলনের আড়ালে বাঙালি যে একটি পরাধীন জাতি, সে উপলব্ধি তীব্র হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় বাঙালি তার নেতৃত্ব নির্ধারণ করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিল। ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন; হঠাৎ বাংলাদেশ’ গেয়ে শিল্পীরা নেমে এসেছিলেন রাজপথে। কবিরা সদ্য রচিত কবিতা নিয়ে পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে পাঠ করেছিলেন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে। চারু ও কারুশিল্পীরাও নেমে এসেছিলেন রাজপথে। উত্তাল রাজপথ জনপদ। সারা বাংলার সর্বস্তরের মানুষের পদভারে কম্পিত বাংলার মাঠ-ঘাট প্রান্তর। বাঙালির জীবনে সে ছিল এক উজ্জ্বল উত্তাল জাগরণের সময়। মার্চের প্রথম তিন সপ্তাহে এ অসহযোগ আন্দোলন বাঙালি জাতিকে নিয়ে গিয়েছিল এক অসীম উচ্চতায়। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঙালি সাহসের বরাভয় হয়ে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে উঠেছিল। ভেঙে দিতে চেয়েছে সব বাধা, প্রতিবন্ধকতা। কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে, ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও, ভাঙ্গো’। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, সারা বাংলা অস্বীকার করে সামরিক শাসক ও শাসনকে। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় চলতে থাকে দেশ। পুরো বাংলাজুড়ে বাঙালির শাসন। শেখ মুজিবের নির্দেশে অফিস, আদালত, যানবাহন, ব্যাংক, বীমা চলছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের গণহত্যা শুরুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের চেহারা ছিল পুরোপুরি অহিংস। পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণার পাহাড় জমে উঠলেও হিংসাত্মক আচরণ ছিল না বাঙালির। আঘাত না আসা পর্যন্ত পাল্টা আঘাত হানার পক্ষপাতী ছিল না বাঙালি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি স্বাধিকারের পক্ষে রায় দেয়। শেখ মুজিবের ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত তখন। সেই ৬ দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলা যে নয়া উপনিবেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, শেখ মুজিব তা দ্রুত উপলব্ধি করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি পাকিস্তানিদের উপনিবেশ থেকে পূর্ব বাংলা ও বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেল, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন নেমে আসে তরুণ শেখ মুজিবের জীবনে। ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। সাহস ও নির্ভীকতার সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। নিজের দল গড়েছেন। নির্বাচনে গিয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, আবার মন্ত্রিত্ব ত্যাগও করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কারাগার থেকেও নেতৃত্বসুলভ ভূমিকা রেখেছেন। ক্রমান্বয়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিটিকে সামনে নিয়ে আসেন। সারা দেশে গড়ে তোলেন জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন। এক পর্যায়ে এসে ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির কণ্ঠরোধ করতে নানা নিপীড়নের পন্থা বেছে নেয়। রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে। নজরুলের রচনাকে ইসলামীকরণ শুরু হয়। বাঙালির সংস্কৃতিচর্চায় আসে বাধা। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে পাকিস্তানিরা বাঙালির বিকাশের সব পথ রুদ্ধ করে দিতে চায়। পাশাপাশি শাসকগোষ্ঠী তাদের পক্ষে একটি দালালগোষ্ঠী তৈরি করে। যারা বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ইসলামীকরণ করে বিজাতীয় রূপ দিতে সচেষ্ট ছিল। শেখ মুজিবকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কারাগারে আটক রাখা হলে জনগণ ক্ষুব্ধ হতে থাকে। একসময় জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্রসমাজ সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জান্তার গুলি, টিয়ার গ্যাস, জেল, জুলুম উপেক্ষা করে সারা দেশে বাঙালি প্রতিরোধে নেমে পড়ে। গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে সামরিক জান্তা শাসকের। ক্ষমতা আরেক জান্তার হাতে চলে যায়। গণদাবির মুখে শাসকরা সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ততদিনে শেখ মুজিব জনগণের একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন। হয়ে ওঠেন ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, বাংলাদেশের গানে প্রাণে চিরঞ্জীব।’ ছাত্রসমাজ তখন আন্দোলনের মধ্যগগনে দাঁড়িয়ে জনগণকে স্বাধিকারের আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেন। নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। তার আগেই তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। আর নির্বাচিত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতায় পরিণত হন। বাংলার মানুষ শেখ মুজিবকে তাদের মুক্তির দূত হিসেবে মর্যাদা দিতে থাকেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর সামরিক জান্তা বাংলার নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে তিন দিন আগে তা স্থগিত ঘোষণা করে। আর ফেটে পড়ে সারা বাংলাদেশ। দরিদ্র, হতশ্রী, ভাগ্যবিড়ম্বিত জাতি এক কাতারে শামিল হয়ে দাবি আদায়ের সেøাগানে মিছিলে মুখরিত হয়ে পড়ে। দেশজুড়ে শুরু হয় ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন। জনগণ লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। ২ মার্চ রাতে শুধু ঢাকাতেই ২৩ জন বাঙালি নিহত ও তিন শতাধিক আহত হয়। দেশজুড়ে হরতাল চলছিল। পাশাপাশি হানাদাররা কারফিউ জারি করে। জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। ৩ মার্চ হরতাল চলাকালে সারা দেশে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শতাধিক বাঙালি শহীদ হন। আহত হন কয়েকশ বাঙালি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। বিচলিত কবি শামসুর রাহমান লিখলেন, ‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট।’ যেন এ মৃত্যুর শেষ নেই। শামসুর রাহমানও প্রশ্ন করে উত্তর পান না; ‘বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?’ এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছিল জাতি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায়। যে জনসভায় শেখ মুজিব পুরো জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ঘোষণা প্রদান করে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ততদিনে ছাত্রসমাজ স্বাধীনতার সেøাগান ধারণই শুধু নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাও তৈরি করে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সে পতাকা মুক্তির দীপ্রতারুণ্যে। শেখ মুজিবের আহ্বানে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় আগা খান সম্প্রদায়ও। বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা রাস্তায় নেমে আসেন ব্যানার প্লাকার্ডসহ। পাকিস্তানিদের নির্বিচারে গুলি করে। বাঙালি হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের খেতাব ও তমঘা বর্জন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম খাঁ, কবি আহসান হাবীব ও কথাশিল্পী সরদার জয়েনউদ্দিন, সংগীতজ্ঞ আবদুল আহাদ প্রমুখ। অসহযোগ আন্দোলনের আগেই একাত্তরের ফেব্রুয়ারির মাঝে সৈয়দ হাসান ইমামকে আহ্বায়ক এবং ওয়াহিদুল হক আর আতিকুল ইসলামকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ’ গঠিত হয়েছিল।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের পর মার্চজুড়েই গোটা বাংলার অসহযোগ আন্দোলনের যে জোয়ার বয়ে যায়, তা ইতিহাসে শুধু অনন্য ঘটনাই নয়, বাঙালি জাতির জন্য অবিস্মরণীয় অবশ্যই। বাঙালির ইতিহাস নতুন পথে ধাবিত তখন। অসহযোগের স্বেচ্ছাব্রতী রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি আর হুমকিতে ভীত নয় বলে বেতার ও টেলিভিশনে সেন্সর করা পাকিস্তানিদের সংবাদ পাঠকালে পাঠকরা কালো ব্যাজ পরতে শুরু করেন।
বেতার, টিভি, চলচ্চিত্র ও চারুশিল্পীরা বাংলা একাডেমিতে সমবেত হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেন। সেখানে সেøাগান ওঠে, ‘যন্ত্রীরা তবলা ছেড়ে ধরবে দামামা।’ সারা বাংলা নতুন নতুন সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। সবার চোখে-মুখে ‘বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই’ মনোভাব। কণ্ঠে আকাশ বাতাস কাঁপানো সেøাগান : ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা-মানি না মানি না’। এদিকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করায় বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ ক্ষুব্ধ হয়। তাঁরা বেতার ও টিভিতে শর্ত প্রদান করলেন, ‘আমরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব। তবে যাবতীয় অনুষ্ঠান অবশ্যই আন্দোলনের অনুকূল হতে হবে।’ কর্তৃপক্ষ এ শর্ত মানতে বাধ্য হয়েছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনকে সফল করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিপূরক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল তখন। বাঙালি অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করতে পেরেছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সক্রিয়তায়। সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হাতে নিয়েছিল নানা কর্মসূচি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮ জন শিক্ষক ৩ মার্চ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন যে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য শোষক শ্রেণি ও কায়েমি স্বার্থবাদী মহল দায়ী। বাংলার ৩৩ জন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সংগীত পরিচালক এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, পূর্ব বাংলার ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলচ্চিত্র সমাজ জনতার সংগ্রামের সঙ্গে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা ৫ (পাঁচ) মার্চ সকালে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আন্দোলনে নিহত শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন। পরে প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। কালো কাপড়ের ব্যানার ও প্লাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বাঙালি হত্যা বন্ধ কর, সামরিক শাসন বাতিল কর, গোলটেবিল না রাজপথÑ রাজপথ রাজপথ, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা কায়েম কর, নতুন নাম নতুন দেশÑ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, কৃষক রাজ শ্রমিক রাজ কায়েম কর।’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবের ভূমিকার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলে, তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
সারা দেশ নানা পেশার মানুষের মিছিলে মিছিলে সয়লাব। সবার কণ্ঠে একই ধ্বনি, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন কর, জয় বাংলা।’ ৬ মার্চ বাংলা একাডেমিতে বেতার, টিভি ও চলচ্চিত্রশিল্পীদের এক সভায় স্বাধিকার আন্দোলনের মূল বিষয়কে গানের সুরে জনতার মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারা পূর্ব বাংলায় পাইকারি গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। এই দিনে পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রেস ক্লাব থেকে মিছিল বের করে। বায়তুল মোকাররমে সমাবেশে পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি কে জি মোস্তফা পূর্ব বাংলার গণআন্দোলনকে সঠিকভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য বিশ্বের সব সাংবাদিকের প্রতি আহ্বান জানান। এমনকি কোনো প্রকার বিধিনিষেধ না মানার ঘোষণা দেন। তারা পূর্ব বাংলার গণআন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকদের প্রতিও আহ্বান জানান।
৭ মার্চ বেতারে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারে সামরিক জান্তারা বাধা প্রদান করায় সব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বেতার কেন্দ্র বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের ক্ষোভের মুখে পরদিন সকালে ভাষণ প্রচার করা হয়। দেশের শিল্পী সমাজ তখন স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ৮ মার্চ শিল্পীরা ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গণআন্দোলনের সঙ্গে প্রতিবারের মতো এবারও বাংলার সমগ্র শিল্পী সমাজ একাত্ম রয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিল্পীরা বেতার ও টিভি অনুষ্ঠান বর্জন করে চলেছেন। কিন্তু এ মুক্তি সংগ্রামের চেতনাকে সদাজাগ্রত রাখার অনুপ্রেরণা জোগানোর প্রয়োজনে নানামুখী সংগীত, নাটক প্রভৃতি প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। তাই শিল্পীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১০ মার্চ থেকে রেডিও, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন এই শর্তে যে, যাবতীয় অনুষ্ঠান অবশ্যই আন্দোলনের অনুকূলে হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আন্দোলনের পরিপন্থী অথবা দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসঙ্গতিপূর্ণ অনুষ্ঠান তারা প্রচার করবেন না। যতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে, ততদিন ‘প্রদেশের’ সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগীত একাডেমিগুলো বন্ধ থাকবে, যদি আবার সামগ্রিক হরতাল ঘোষিত হয়, তাহলে শিল্পীদের অসহযোগ আন্দোলন পুনরায় চলতে থাকবে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ১০ মার্চ বাংলার মুক্তি আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার সর্বস্তরের লোকদের কাছ থেকে গণমুখী সংগীত রচনা করার আহ্বান জানান। স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যাপক গণহত্যার প্রতিবাদে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মুর্তাজা বশীর তথ্য ও জাতীয়বিষয়ক দফতরের উদ্যোগে আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
চারু ও কারুশিল্প মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শিল্পী সৈয়দ শফিকুল হোসেনের সভাপতিত্বে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় শিল্পীরা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। আন্দোলনমুখী পোস্টার ফেস্টুনসহ মিছিলের আয়োজন করা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। টেলিভিশন নাট্যশিল্পীদের ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেÑ গণআন্দোলনের পরিপন্থী কোনো অনুষ্ঠান টেলিভিশনে প্রচার করা হবে না। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবিরা অনুষ্ঠানে উদ্দীপনামূলক কবিতা পাঠ করেন। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ, সাহিত্য সংস্কৃতি সংগীতসহ আরও সংগঠন বাহাদুর শাহ পার্ক ও পল্টন ময়দানে ২২ মার্চ ছড়া পাঠের আসর, গণসংগীত ও নাটক পরিবেশন করে।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এই দিন টেলিভিশন বিদ্রোহ করে। রাত ১১টা থেকে ডিআইটিতে অবস্থিত টেলিভিশন কেন্দ্র হতে দেশপ্রেম ও উদ্দীপনামূলক গান পরিবেশন করা হতে থাকে। বাঙালি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য রাত ১২টায় পাকিস্তান দিবসে পাকিস্তানের পতাকা না দেখানো। ফাহমিদা খাতুন গাইতে থাকেন ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’। গানটি ক্রমান্বয়ে গাইতে গাইতে রাত ১২টা পার হয়ে যায়। ১২টা ২ মিনিটে অধিবেশন সমাপ্ত করা হয় পাকিস্তান দিবসকে উপেক্ষা করেই। এতে সামরিক কর্তারা ক্ষুব্ধ হন। টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রহরারত সেনাবাহিনী কর্তৃক কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে টিভি কেন্দ্রের সব কর্মচারী অব্যাহতভাবে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকায় ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ থাকে।
‘শেখ মুজিবের পথ ধর, বাংলাদেশ কায়েম কর’ সেøাগান নিয়ে সেদিন রাজপথে সব পেশার মানুষ নেমে এসেছিলেন। শিল্পী সমাজ তাদের দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার অভীপ্সায় কণ্ঠ খুলে গেয়েছিল উদ্দীপনার গান। আর সেই গানের সুর তাল লয়ে উদ্দীপিত বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বিপ্লবের রক্তলাল ঝান্ডা উড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন বাংলার শিল্পী সমাজ। তাদের সেই অবদান বাঙালির ইতিহাসে জ্বল জ্বল করবে চিরকাল।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন (১৭ মার্চ ২০২০)