মুজিববর্ষ ও বাংলাদেশের লক্ষ্য

5173

Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2020
  • Details Image

মোঃ শফিকুল ইসলামঃ

লেখার শুরুতে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ২০২০ সালে এই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ এক বছর সময়কালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য দুটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উদযাপিত হবে অদ্বিতীয় ও অনন্যভাবে। যা অতীতে কখনও হয়নি এবং ভবিষ্যতেও কখনও হবে না আমার বিশ্বাস। মুজিববর্ষ উদ্যাপন করা আমাদের জাতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একটি পতাকা, একটি ভূখন্ড এবং একটি দেশ-বাংলাদেশ নামের দেশটি, আমরা যাঁর নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় পেয়েছি তাঁর জন্মশতবার্ষিকী যথাযথ মহিমায় উদ্যাপন করা অবশ্যই গৌরবের! মুজিববর্ষ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে উদ্যাপিত হবে। কিন্তু আমি মনে করি, মহান নেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং প্রত্যেক পরিবারকে দলমত নির্বিশেষে মুজিববর্ষ উদযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়।

মুজিববর্ষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের অনেক দেশের নেতাসহ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভুটানের রাজা জিগমে থেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বানকি মুন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদসহ অন্যান্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এখনও দাফতরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালীর নেতা বা বন্ধু ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর অবদান শুধু বাঙালী জাতির মধ্যে সীমিত নয়। আন্তজার্তিক পরিম-লে তাঁর অবদান অপরিসীম। তিনি নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন। মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেহেতু বিশ্বনেতারা অংশগ্রহণ করবেন, তাই বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করার জন্য বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রয়োজনীয় ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে। ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে। কলকাতা, দিল্লী, লন্ডন, টোকিওসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১২টি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ১২টি তথ্যচিত্র এবং একটি ওয়েব সিরিজে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা যেন ভবিষ্যতে যেকোন কাজে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঠিকভাবে ধারণ ও পালন করতে পারি, মুজিববর্ষ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে এটাই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, মুজিবর্ষে কোন ঘর অন্ধকার থাকবে না, সমাজ হবে দুর্নীতিমুক্ত। আমরা যারা শিক্ষক পেশায় জড়িত, তারা যেন সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের সঠিক ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে পারি। মুজিববর্ষ হলো বঙ্গবন্ধুকে এবং তাঁর চেতনা, কীর্তিকে স্মরণ করা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে বঙ্গবন্ধুকে যথাযথরূপে পরিচয় করিয়ে দেয়া। মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনা শুরু হয় ১০ জানুয়ারি ২০২০ এবং মনে হচ্ছে সারাদেশ ১৭ মার্চ ২০২০ দিনটির জন্য অপেক্ষা করছে।

মুজিববর্ষ উদ্যাপনের মাধ্যমে সকল পাড়া, মহল্লা, গ্রাম এবং শহরের আনাচে-কানাচে পরিচয় করিয়ে দেয়া হোক মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, অবদান, চেতনা এবং দর্শন। যে আদর্শ, চেতনা ও সংগ্রাম বাঙালী জাতিকে এনে দিয়েছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। আমার ইচ্ছা, মুজিববর্ষে সমাজ থেকে সকল অন্যায়, অত্যাচার দূর হবে এবং নিরাপদ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। মুজিববর্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের কোথাও থাকবে না ইভটিজিং, ধর্ষণ, মাদক, দুর্নীতি, নারী নিপীড়ন, বৈষম্য এবং র‌্যাগিং নামে পরিচিত মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে একটি স্বতন্ত্র কমিটি থাকা উচিত, যার মাধ্যমে তৃণমূলে পৌঁছে যাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শ। সাম্প্রদায়িকতা সমাজে ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেকেই মুখে মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে ভিন্নতা দেখতে পাই। আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারি কিনা এটা সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে হবে।

মুজিববর্ষ উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করার উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করি। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত জায়গা নেই সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি থাকা উচিত। জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম পরিকল্পনা, উন্নয়ন কার্যক্রম এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা নির্মাণের জন্য তাঁর সকল উদ্যোগকে জনগণের কাছে বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।

বিশ্ব জলবায়ু ও পরিবেশ হুমকির মুখে, তাই সুন্দর ও বাসযোগ্য পরিবেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ১৭ মার্চ একযোগে বাংলাদেশের সব নাগরিকের ১টি করে বৃক্ষ রোপণ করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার বিষয়ও উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী উচিত।

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাস বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা মুজিববর্ষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, যদি সবক্ষেত্রে এই তিনটি নীতি পালন করে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারি তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান ও ভালবাসা দেখানো হবে।

জাতির পিতার দুইটি স্বপ্ন ছিল, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ও দেশ। অন্যটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। প্রথমটি সম্পূর্ণভাবে অর্জিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়টি আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। সুতরাং মুজিববর্ষে আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব, এটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী সবার নিকট আমাদের প্রত্যাশা।

পরিশেষে জাতির পিতার আত্মার শান্তি কামনা, দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য এবং বাঙালী জাতি তথা বাংলাদেশের মঙ্গল ও সফলতা কামনা করছি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত