3438
Published on নভেম্বর 20, 2019ড. আতিউর রহমানঃ
বিশ্ব অর্থনীতির দিনবদল দ্রুতই ঘটছে। এরই মধ্যে একুশ শতককে এশীয় শতক বলে বিশ্ব মেনে নিয়েছে। সারা পৃথিবী যখন প্রবৃদ্ধির দৌড়ে মন্থর হয়ে পড়ছে তখন গতিময় এশিয়াই বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রে অবস্থান করছে। চীন, ভারত, জাপান এশিয়ার বড় অর্থনীতি। হালে তিনটি দেশেরই প্রবৃদ্ধির হার কমছে। তা সত্ত্বেও যে হারে তাদের প্রবৃদ্ধি ঘটছে, বিশেষ করে চীন ও ভারতে, তাতে অর্থনীতির আকার গুনেই বিশ্ববাজারের প্রধান অংশ তারাই দখল করে রেখেছে।
এই তিনটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ নিবিড়। আর বাংলাদেশ এই সময়ের এশিয়ার সবচেয়ে গতিময় দেশ। সেই বিচারে গতিময় এশিয়ার মধ্যমণি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যদি ঠিকমতো এশীয় সাপ্লাই চেইনের অংশীদারিত্ব বজায় রাখতে পারে তা হলে তার অর্থনীতির আকার উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। বিশেষ করে, চীন ও ভারতের সঙ্গে তার ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ যদি দ্রুত হারে বাড়াতে পারে তা হলে তা হবে বাংলাদেশ ও এশিয়ার জন্য ‘উইন-উইন’ ফলাফল। আর এজন্য চাই যাতায়াত অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ সম্পর্কিত ‘কানেক্টিভিটি’র নজর কাড়া উন্নতি।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণি এরই মধ্যে বুঝে ফেলেছেন যে, তারা এদ্দিনে ‘ভুল ঘোড়ায়’ চড়েছিলেন। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর রপ্তানি বাণিজ্য খুব বেশি করে নির্ভরশীল থাকার কারণে এশিয়ার দিকে তাদের নজর সেভাবে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি মনে হচ্ছে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত উদ্যোক্তাদের ঘুম ভেঙেছে। তারা আগামী কয়েক বছর বাণিজ্য সম্প্রসারণে যেমন খুবই আশাবাদী তেমনি এশিয়ায়, বিশেষ করে নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
সম্প্রতি এইচএসবিসি থেকে প্রকাশিত ‘নেভিগেটর রিপোর্ট’ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এই মনবদলের ইঙ্গিত দিয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী বলা যায়, এশিয়ার সঙ্গে বেশি বেশি ব্যবসা করতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এখন বেশ মুখিয়ে আছেন। ১৯৭টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের প্রতিনিধিদের প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, আগামী বছর তারা খুব ভালো ব্যবসা করবেন। তাদের অর্ধেকেই মনে করছেন, আগামী বছর তাদের ব্যবসায় অন্তত ১৫ শতাংশ হারে বাড়বে। এই হার বিশ্বভাবনার দ্বিগুণ। ব্যবসার সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও জীবনমান এবং ভূ-রাজনীতি বিষয়ে মতামত দিয়েছেন এসব ব্যবসায়ী প্রতিনিধি। গত বছর তাদের যে ধরনের ভাবনা ছিল, তার চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রশ্নে এ বছর তারা ৭৪ শতাংশ বেশি আশাবাদী।
এই জরিপের মতে, প্রতি দশজনের মধ্যে নয়জন ব্যবসায়ীই মনে করেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে লাভবান হবে। তারা সবাই বাংলাদেশের দ্রুত প্রসরমান ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের (বিশেষ করে গার্মেন্টস) প্রসারে খুবই আশাবাদী। টাকার বিনিময় হার, বন্দরে সময়ক্ষেপণসহ প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত বেশকিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আগামী বেশকিছু বছর ধরেই শিল্পপণ্যের বাণিজ্যিক সুবিধা ধরে রাখতে পারবে বলে এই জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন। আর আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারই হবে বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ বেশ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, গত বিশ্ব আর্থিক সংকট মোকাবিলার অংশ হিসেবে নয়া গন্তব্য ও নয়া পণ্য প্রসারের কৌশলের অংশ হিসেবেই এশীয় দেশগুলোতে বাণিজ্য প্রসারে বাংলাদেশ মনোযোগ দেয়। সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার বাড়তি প্রণোদনার সুযোগ সৃষ্টি করে। এর সুফল আমরা এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। নেভিগেটর জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৩ শতাংশই মনে করেন, এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আগামীতে আরও বাড়বে। উল্লেখ্য, চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজিক অংশীদার (৪৩%)। চীনের ইউনান প্রদেশ বাংলাদেশের সঙ্গে আরও বেশি হারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এর পরই জাপানের স্থান। উত্তরদাতাদের ৩৬ শতাংশ মনে করেন, আগামীতে জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়বে। জাপানি বিনিয়োগকারীরা দলে দলে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। জাইকা বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে দেদার সহযোগিতা করছে। তাই জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। এর পরের অবস্থান ভারতের। ৩২ শতাংশ উত্তরদাতাদের ধারণা ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বাড়বে।
চীন অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। মালয়েশিয়াকে হটিয়ে তিনগুণ বাণিজ্য বাড়িয়ে জাপান দ্বিতীয় প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারের অবস্থান গ্রহণ করেছে। আর ভারত তো বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিনিধি। সামাজিক মাধ্যমে যতই হইচই হোক না কেন, বাংলাদেশ তো আর তার পড়শি বদলাতে পারবে না। আর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ-ভারত রাজনৈতিক সম্পর্ক যেমন তুঙ্গে, তেমনি দুদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারও ঘটছে। বিশেষ করে, অবকাঠামো খাতে দুদেশই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতর ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে যেসব রেল যোগাযোগ ছিল সেসব ফের পুনঃসংযোগের উদ্যোগ নিচ্ছে। তা ছাড়া নতুন কিছু রেললাইনও তৈরি হচ্ছে। বাস যোগাযোগ অনেকটাই বেড়েছে। নৌপরিবহন সংযোগও বাড়ছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে চাইছে। বাংলাদেশ নিকট-প্রতিবেশীর এই প্রয়োজনীয় বন্দর সুবিধা দিতে রাজি আছে। ত্রিপুরার মৈত্রী সেতু চালু হলে ওই রাজ্য থেকে চট্টগ্রাম বন্দর যেতে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ পাড়ি দিতে হবে। এখন কলকাতা বন্দরে পণ্য পাঠাতে হলে ত্রিপুরাকে দেড় হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। অন্যদিকে দুদেশের ভেতর নৌপরিবহন যাতায়াত বাড়লে পণ্য পরিবহন খরচ ৩০ শতাংশ কমে যাবে।
সেজন্য অবশ্য দুদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অবকাঠামোকে আরও আধুনিক করার প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যে উভয় দেশ এখন কাজ করছে। ড্রেজিংসহ নদীবন্দর উন্নয়নেও উভয় দেশ কাজ করছে। স্থলবন্দরগুলোরও উন্নয়ন হচ্ছে। তবে সব বন্দরে সুযোগ-সুবিধা একই হারে বাড়ছে না। এখনো ‘কনটেইনারভিত্তিক’ আধুনিক সড়ক পরিবহন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। পণ্যের ট্রাকবদল, ওঠানামার ঝক্কি রয়েই গেছে। পেট্রাপোল-বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়েই বাণিজ্যের অর্ধেকটা সচল আছে। এখানেও বাংলাদেশের দিকে অবকাঠামো বেশ দুর্বল। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কনটেইনারভিত্তিক বাধাবিহীন ট্রাক চলাচল করার সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা। জ্বালানি বাণিজ্যে বড় সংযোগ ঘটেছে দুদেশের মাঝে। বাংলাদেশ সাড়ে এগারোশরও বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনছে ভারত থেকে। আরও বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। ত্রিপুরা থেকেও বিদ্যুৎ আসবে। এমনকি ভুটান ও নেপাল থেকেও বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ মিলবে বাংলাদেশের।
কানেক্টিভিটির সবচেয়ে বড় সুবিধা পেয়ে থাকেন উভয় দেশের মানুষ। পর্যটন, ব্যবসায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বছরে ভারতে যাতায়াত করেন প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি। মানুষে মানুষে এই সংযোগ উভয় দেশের মানুষের মাঝে চেনাজানা ও সহমর্মিতার ভিত্তি তৈরি করছে। তবে ভিসাব্যবস্থার আরও উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শিক্ষা সফরে বা অন্য কোনো সফরে যেতে হলে বাংলাদেশের পর্যটকদের আলাদা করে অনুমতি নিয়ে ডাওকি বন্দর পার হতে হয়। এর কোনো প্রয়োজন নেই। এক ভিসাতেই সব বন্দর পারাপারের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
আমাদের রয়েছে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিতই ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা সফরে ভারতে যায়। তামাবিল-ডাওকি বন্দরের ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে এবং ভিসা জটিলতা দূর করা গেলে নিশ্চয় এই পথে শিক্ষা পর্যটকদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়বে। একইভাবে আমাদের মধ্য ও উচ্চ আয়ের যেসব পর্যটক সিলেটের নানা পর্যটনকেন্দ্রে যাচ্ছেন তারাও এক-দুদিনের জন্য শিলং ও আশপাশে ঘুরে আসতে পারবেন। শিলংয়ে পরিবেশসম্মত পর্যটনের নানা সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ বাংলাদেশের পর্যটকরা নিশ্চয় গ্রহণ করবেন। গোহাটি-ঢাকা বিমান চলাচল শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রীর অভাবেই তা বন্ধ হয়েছে। সিলেট থেকে ব্যবসায়ীরাই বেশি বেশি আসাম ও মেঘালয়ে যান। ফ্লাইটটা যদি গোহাটি-সিলেট-ঢাকা করা যেত তা হলে হয়তো যাত্রীর অভাব হতো না। তা ছাড়া আমাদের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারকে যদি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর্যটকদের কাছে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারতাম তা হলে হয়তো ঢাকা থেকে সহজেই তারা সেখানে যেতে চাইতেন।
আমাদের উভয় দেশের পর্যটন সংস্থাগুলোকে সেজন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের ও ভারতের পর্যটনগুলোর সঙ্গে সংযোগ করে দিতে হবে। তাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে তরুণ পর্যটকরা এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তাদের যাতায়াত পরিকল্পনা করে থাকে। নেভিগেটর জরিপে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আগামী বছরগুলোতে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশি করে বিনিয়োগ করবেন। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণের কাজেও তারা যুক্ত হতে চান। উত্তরদাতাদের অর্ধেকেরও বেশি মনে করেন, আগামীতে টেকসই ব্যবসার দিকেই ঝুঁকতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ আরও বেশি করে আমাদের নিতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক কৃষি, ফুলের চাষ ও যৌথ উদ্যোগের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিছুদিন আগে আমি শিলংয়ে গিয়েছিলাম একটি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য। তখন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সিং ও ওই রাজ্যের মুখ্যসচিব সাকিল আহম্মদের সঙ্গে কথা হয়। উভয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংযোগ বাড়াতে খুবই আগ্রহী। এর কদিন পরই উভয়ে ডাওকি-তামাবিল হয়ে সড়কপথে ঢাকায় আসেন। দুজনের সঙ্গেই ঢাকায় ফের দেখা হলো। তারা দুজনেই দুদেশের মানুষের মধ্যে সংযোগ বাড়ানোর নানা উদ্যোগের কথা বললেন। তারা ময়মনসিংহ হয়ে তুরাগ গেছেন। পথে পথে দেখে গেছেন কোথায় কোথায় আরও সংযোগ স্থাপন করা যায়। এভাবেই মানুষে-মানুষে সংযোগ বাড়ে। তরুণ মুখ্যমন্ত্রী দারুণ আস্থার সঙ্গে আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তির কথা বললেন। তার পূর্বপুরুষরা ময়মনসিংহের মানুষ। তাই প্রাণের টানেই তিনি ওই অঞ্চল দিয়েই সড়কপথে দেশে ফিরে গেছেন।
ঢাকায় থাকার সময় হোটেল ওয়েস্টিনে দুদেশের কৃষি ও কৃষি-প্রসেসিং শিল্পের সহযোগিতা সম্ভাবনা নিয়ে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা হলো। আমাদের দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাতরকণ শিল্পের উদ্যোক্তারাও ওই সংলাপে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারিংস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম প্রথমেই একটি চমৎকার উপস্থাপনা দিলেন। ওই উপস্থাপনায় তিনি জানালেন, মেঘালয় মূলত একটি প্রাকৃতিক কৃষি উৎপাদক রাজ্য। তার ৯০ শতাংশ কৃষিপণ্যই প্রাকৃতিক। রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না এ রাজ্যের কৃষকরা।
আলু, ধান, ভুট্টা, বাদাম, আনারস, পেঁপে, মসলা, ঔষধি গাছ উৎপাদন করে মেঘালয়বাসীরা। তিনি আরও বললেন, উভয় দেশে যে চিনির চাহিদা তা মেটানোর জন্য আমরা সীমান্তের দুদিকেই সুগার বিট উৎপাদন করতে পারি। আমাদের চরে এবং মেঘালয়ের বিপুল বিরানভূমিতে এর চাষ হতে পারে। আমরা রুশ ও এশীয় বাজারে এই সুগার বিটনির্ভর চিনি রপ্তানি করতে পারি। এর উৎপাদন খরচ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারি। সীমান্তের এপারে আমরা মিল চালু করলে উভয় দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে দুদেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি করতে পারব।
একইভাবে বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে মেঘালয়ে টমেটো, ওল, আদা, তেজপাতা, নানা জাতীয় হার্বস, মিষ্টিআলু, ওটস, বাদাম ও আম উৎপাদিত হয়। এসব পণ্য প্রসেস করে বিপুল পরিমাণে আমরা যৌথভাবে রপ্তানি করতে পারব। আমাদের রাবারশিল্পও মেঘালয়ের উৎপাদিত রাবার ব্যবসা করতে পারে। তা ছাড়া ঋতুভেদে উভয় দেশের ফল, সবজি বাণিজ্যও বড় আকারে হতে পারে। সীমান্ত এলাকায় প্রচুর কাঁঠাল উৎপাদিত হচ্ছে। এসবের ৭৫ শতাংশ পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ পণ্যটি প্রসেস করে বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার আমরা খুলে দিতে পারি। ওই সংলাপেই মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা জানালেন, বাংলাদেশ ও মেঘালয়ের মধ্যে চমৎকার বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি এজন্য বাড়তি কদম তুলতেও প্রস্তুত রয়েছেন। সেজন্য অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে কৃষকদের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে। তাদের এলাকায় যেসব পণ্য উদ্বৃত্ত আছে সেগুলো বাংলাদেশে রপ্তানি করতে তারা রাজি আছেন।
এ দেশে কৃষি-প্রসেসিং শিল্প গড়ে উঠলে তার উৎপাদিত পণ্য মেঘালয়েও বিক্রির সুযোগ রয়েছে। হলুদ, বাদাম, রাবারÑ সহজেই তারা রপ্তানি করতে পারবেন। সেজন্য উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংযোগ বাড়ানোর ওপর তিনি জোর দেন। আসন্ন ‘সিয়াল’ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের যুক্ত হওয়ার জন্য তিনি উদাত্ত আহ্বান জানালেন। মানুষে মানুষে সংযোগ বাড়লেই ব্যবসা-বাণিজ্যও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সেজন্য তিনি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে কোন পণ্যের চাহিদা কত হতে পারে তা প্রক্ষেপণ করে উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের এগোতে বললেন। এমন অনেক কৃষিপণ্য আছে যা ঋতুভেদে উভয় দেশেই বিক্রি হতে পারে। সেজন্য বাজার পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবাদিপশু ও পোলট্রির ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রচুর সুযোগ রয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন। সবশেষে তিনি বললেন, আমরা যাই করি না কেন, কৃষকের কথা যেন মনে রাখি। তাদের স্বার্থের কথা যেন ভুলে না যাই। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখেই আমাদের আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারে উদ্যোগী হতে হবে। মনে রাখা চাই, বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল মিলে এক দুর্দান্ত গতিময় প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণের জন্য উপযুক্ত সংযোগ বাড়াতে উভয় দেশের উদ্যোক্তা, সরকার ও ভোক্তাদের একযোগে এগোতে হবে।
লেখকঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সৌজন্যঃ দৈনিক আমাদের সময়