3329
Published on জানুয়ারি 16, 2019উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব সভায় নিজের অবস্থানকে নিয়তই বিকশিত করছে এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমৃদ্ধির অব্যাহত অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অতি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে উন্নতমানের পেশায় সম্পৃক্ত হওয়া, রাজনৈতিক আঙ্গিনায় সদর্পে বিচরণ করাই শুধু নয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয়ের নিরন্তর গতিপ্রবাহ আজ যে মাত্রায় সেখানে সম্ভাবনার দ্যুতি বিকিরণ স্পষ্টতই দৃশ্যমান। ২০১৯ সাল সে আলোকিত ধারায় আরও অনেক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এমন ধারণা ব্যক্ত করা সঙ্গত।
বিভিন্ন বিশ্ব জরিপে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে দেশটির এক সম্মানজনক অর্জন। এমন প্রতিবেদন একদিনে তৈরি হয়নি। নিরবচ্ছিন্ন কর্মপরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং যুগ ও সময়ের চাহিদাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার যে সফল অভিগমন, যা গত ১০ বছরের অব্যাহত এগিয়ে যাওয়ার এক সচিত্র পর্যবেক্ষণ, যা কিনা আন্তর্জাতিক জরিপের এক প্রামাণ্য দলিলও। ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের সমস্ত অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, সাধারণ মানুষের জীবনমানের পশ্চাৎবর্তী জঙ্গী ও মৌলবাদের অনাকাক্সিক্ষত উত্থান সব মিলিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অকৃত্রিম দেশাত্মবোধ, যুগ ও সময়ের সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে বিশ্বসভায়ও তার স্থান তুলে ধরা; সব মিলিয়ে এক দূরদর্শী নিষ্ঠাবান নেতৃত্বের অবিস্মরণীয় মহাসম্মিলনে সে দুঃসময়টাকে মোকাবেলা করে। প্রথম ৫ বছর ছিল মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশকে সমস্ত অশুভ ও অপশক্তি থেকে মুক্ত করে এক সুস্থ, স্বাভাবিক পথপরিক্রমায় সম্পৃক্ত করা। এই ৫ বছরে সফলতা সেভাবে দৃশ্যমান না হলেও দেশ অনেক সঙ্কটের আবর্ত থেকে যে বের হতে পারছে সেটা সবার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে। ইতোমধ্যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ২০১৪ সালের নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিতে হয়। পাঁচ বছর বিএনপি সংসদে বসার ছাড়পত্র পেলেও সেভাবে সংসদে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। অল্প সংখ্যক জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে সংসদকে প্রাণবন্ত করা যায় যদি জনগণের প্রতি সামান্য দায়বদ্ধতা থাকে। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য, সে বছর বার্ষিক জিডিপি দাঁড়ায় ৬%-এর ওপর। অর্থাৎ সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, জঙ্গীবাদের সুতীক্ষè আঁচড়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের যে ধারার শুভ সূচনা করেন তার ফল পেতেও বেশি সময় লাগেনি। সেই যে শুরু করলেন উন্নয়নের জয়যাত্রা সেখান থেকে তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রথমে ধীরগতিতে, পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়ার এমন প্রাপ্তি বিশ্ব সভায় নজরে আসতেও কিছু সময় তো লেগেছে। তবে দূরদর্শী শেখ হাসিনার এটা বুঝতে একদম দেরি হয়নি যে, দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে তা অসম্ভব। সুতরাং বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় দেশ এবং সাধারণ মানুষ। ফলে সার্বিক সমৃদ্ধি যখন দৃশ্যমান সেখানে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে তো বটেই এই উন্নয়ন রথে লিঙ্গবৈষম্যও কোন স্থান পেল না।
শেখ হাসিনা নিজেও তৈরি হলেন ক্ষমতাধর নারী নেতৃত্বের এমন এক অবস্থানে যেখানে দেশ-বিদেশ সর্বত্রই তিনি আলোচিত, আলোকিত এক ব্যক্তিত্ব। যা বিশ্ব পরিসরের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান। ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে উন্নয়নের বিশেষ রোল মডেল হিসেবে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান-একেবারে ঈর্ষণীয়। বিশ্ব অর্থনীতিক ফোরামের ২০১৭-১৮-এ পর পর দুই বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মর্যাদা ৪৭তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। বৃহত্তর ভারতও অনেক পেছনে। বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীর আসনে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৩০তম। মাত্র ১ বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালে তার অবস্থান চিহ্নিত হয় ২৬তম। চার ধাপ এগিয়ে গেলেন মাত্র এক বছরে। গত বছর সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়তম, মাছ উৎপাদনে একই স্থান হলেও জীববৈচিত্র্যে প্রাকৃতিক অপার সম্ভাবনায় অবারিত দানের মাছে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ স্থানে। ধান উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে চতুর্থ।
২০১৯ সালের শুভ সূচনায় বাংলাদেশের আরও অর্জন সবাইকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। গণতন্ত্রের সূচকে পাঁচটি বিশেষ মানদ-ে বাংলাদেশকে স্কোর অনুযায়ী চিহ্নিত করা হয় মিশ্র গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে। সারা বিশ্বের গণতন্ত্রের ওপর এমন জরিপ চালায় ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এবং শ্রীলঙ্কা এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ আছে তৃতীয় স্থানে। আর বিশ্বে ৮৮তম। গত বছরও বাংলাদেশ ছিল ৯২তম জায়গায়। মাত্র এক বছরে গণতন্ত্রের সূচকের পাঁচটি পর্যায়ে বাংলাদেশ ৪ ধাপ এগিয়ে গেল। দেশে গণতন্ত্র নেই বলে প্রতিপক্ষ ও অপশক্তিরা যে বিভ্রান্তি ছড়ায় বিশ্ব প্রতিবেদন সেখানে বাংলাদেশকে একটি নির্ধারিত মাত্রায় তুলে এনেছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক রিপোর্টে ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় প্রাপ্তি। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশ প্রথম দশ দেশের কাতারে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ বছরে বাংলাদেশ ফি বছর ১১% করে ফল উৎপাদন বাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে এই সময় বিশ্বের ফল উৎপাদনের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। আর মৌসুমি ফলে বিশ্বের শীর্ষ দশে বাংলাদেশও তালিকাভুক্ত। শুধু উৎপাদনই নয়, ফল খাওয়া জনগণের সংখ্যাও প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এরই অবধারিত গতিপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট উৎপাদক শ্রেণীও তাদের জীবনমান উন্নয়নে সফল ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের এটি আর এক ধাপ অগ্রগতি তো বটেই।
বিশ্ব সন্ত্রাস মোকাবেলায়ও বাংলাদেশের অগ্রগতি আকর্ষণীয়। এই সন্ত্রাসবাদের সূচকেও বাংলাদেশ চার ধাপ এগিয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়াভিক্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস এ্যান্ড পিস’-এর বিশ্ব সন্ত্রাস নিয়ে ‘গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স’ প্রতিবেদনে এমন জরিপ উঠে আসে। ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের আগের অবস্থান ২১তম হলেও ২০১৮ সালে তা ২৫তমে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিকমানের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর সন্ত্রাসবাদের ওপর তাদের জরিপ চালায়। সন্ত্রাসের বিভিন্ন সূচকে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ৪টি দেশে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ন্ত্রণ এসেছে এবং নিরাপত্তা বেষ্টনীও আগের চেয়ে জোরদার হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। শুধু তাই নয়, গত বছরের তুলনায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা অনেক কমে এসেছে। অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অব্যাহত অধোগতি দেশের জন্য বড় ধরনের শুভ সঙ্কেত। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বস্তি আর নিরাপত্তার সূচকগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হলে দেশ কখনও সুস্থিরভাবে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। বাংলাদেশ তেমন দুর্যোগ থেকে ক্রমান্বয়ে বের হয়ে আসতে পারছে। গণতান্ত্রিক সুব্যবস্থা এবং সুস্থ রাজনীতিতে সন্ত্রাসী অপকর্ম কোনভাবেই স্থায়ী ভিত্তি নিতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি সে ব্যবস্থারই একটি নতুন সম্ভাবনা। এই অপার সম্ভাবনাময় পদযাত্রায় বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া দেশ ও মানুষের এক অনবদ্য বিজয়। যে বিজয়রথ অবারিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্ব আর সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনায়। এমন ধারায় এগিয়ে গেলে নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। উন্নয়ন দশকের নিরন্তর অভিগামিতায় ক্ষুদ্র পরিসীমায় অধিক জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত এই দেশটির মানুষ আজ আর বোঝা নয়, একেবারে দক্ষ জনবল। যে জনশক্তি প্রতিমুহূর্ত অনুপ্রাণিত আর উৎসাহিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কর্মোদ্দীপনায়। কর্মসংস্থানের নতুন গিদন্ত উন্মোচন করে তরুণ ও সময়ের প্রজন্মকে শেখ হাসিনা যে সমৃদ্ধ জগত অবারিত করেছেন সেখান থেকেই বাংলাদেশ নবযাত্রায় নিজেকে শামিল করতে পিছপা হবে না। নতুন বছরে অবিস্মরণীয় বিজয় দিয়ে যে শুভযাত্রা বাংলাদেশ শুরু করেছে সেখান থেকে আরও উন্নত জীবনমানকে আয়ত্তে এনে বিশ্বসভায় দেশের অবস্থান শক্ত আর মজবুত হবে, এমন আশা করাই যায়। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গৃহীত অনেক সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম উন্নয়নের গতি নির্ধারণে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্যমাত্রায় দেশ শুধু পৌঁছাবেই না আরও নতুন কর্মযোগ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী অবদানও রাখবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আরও উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিতে প্রধানমন্ত্রী তার নতুন মন্ত্রিসভায় যাদের সামনে নিয়ে এসেছেন তাদের দায়দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেল। প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থানে তার সীমাহীন দায়বদ্ধতাকে প্রমাণ করাই শুধু নয় বরং আগের ভুলত্রুটি বিবেচনায় রেখে নবোদ্যমে দেশকে আরও আধুনিক আর বিশ্বজনীনতার অপার যোগসাজশে নতুন যাত্রাপথের গন্তব্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মতোই দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে হবে দেশ ও মানুষের মঙ্গলে। সমস্ত সঙ্কীর্ণতা, দ্বন্দ্ব, বিরোধ, অভ্যন্তরীণ মতদ্বৈবতাকে জয় করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই শেখ হাসিনা যেভাবে তার উন্নয়নের যাত্রাপথকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন সেখান থেকে কোনভাবেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না। ব্যক্তির চেয়ে দল বড় তার চেয়েও বেশি দেশ এবং অতি সাধারণ জনগোষ্ঠী যাদের বাদ দিলে উন্নয়নের অব্যাহত যাত্রা তার গতি হারাতে পারে। সব মিলিয়ে এক দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার যুগ সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে।
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ