7226
Published on ডিসেম্বর 19, 2018ড. আতিউর রহমানঃ
গতকাল সকাল প্রায় ৯টার মধ্যেই সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে উপস্থিত হয়েছিলাম। হোটেলে ঢুকতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। হোটেলের সামনেই সারিবদ্ধ দূতাবাসের গাড়ির সমারোহ। ভেতরে গিয়েও দেখলাম, হল কানায় কানায় ভর্তি। প্রচুর সংখ্যক কূটনীতিক উপস্থিত। তাদেরই পাশে বসলাম। একটি দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের এই ব্যাপক উপস্থিতিই প্রমাণ করে- এই দল এবং তার প্রধানের প্রতি তাদের আগ্রহ কতটা প্রবল। ঠিক সময়েই আওয়ামী লীগপ্রধান এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুকন্যা অত্যন্ত পরিমিত ও পরিশীলিত একটি ভাষণ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের দু'দিকে পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিক পাওয়ার পয়েন্টে তার ভাষণের চুম্বক কথাগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছিল। কূটনীতিকদের জন্য অনুবাদসহ হেডফোন সরবরাহ করা হয়েছিল। ড. হাছান মাহমুদের সঞ্চালনায় প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক। ইশতেহারটি পড়েই মনে হলো, তার কমিটি যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেছে। আর মাননীয় সভানেত্রীর সম্পাদনার সোনালি স্পর্শ বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। ২০০৮ সালে তার সঙ্গে 'দিনবদলের সনদ' নিয়ে আমরা কাজ করেছি। তাই এবারের ইশতেহারেও যে তিনি তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবতার নিরিখে অবদান রেখেছেন, তা অনুমান করতে আমার অন্তত অসুবিধা হয়নি। যে অঙ্গীকার, দেহভঙ্গি এবং সাবলীলতার সঙ্গে ইশতেহারটি তিনি পাঠ করলেন, তা হলভর্তি দর্শকদের যে দৃষ্টি কেড়েছে, তা তাদের স্বতঃস্টম্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আমার পাশের এক কূটনীতিককে দেখলাম, তিনি সমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চুম্বক কথাগুলো আগ্রহের সঙ্গে টুকে নিচ্ছেন। তার ভাষণ শেষে ওই কূটনীতিককে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন শুনলেন? সংক্ষিপ্ত উত্তরে বললেন, 'বেশ কমপ্রিহেন্সিভ'। আমারও তাই মনে হয়েছে। অতীত থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বর্তমানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আগামীর স্বপ্ন বুনেছেন এই ইশতেহারে। সুযোগ পেলেই তিনি আশার কথা, সম্ভাবনার কথা বলেছেন। শুরুই করেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন স্পর্শ করে। মানুষের পেটে ভাত দেওয়া, মা-বোনদের কাপড় নিশ্চিত করা, তরুণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার বঙ্গবন্ধুর যে উদ্ৃব্দতি এই ইশতেহারে স্থান পেয়েছে, তাকে 'অ্যাঙ্কর' করেই তার সুযোগ্যকন্যা সর্বক্ষণ আগামী দিনের বাংলাদেশের এক আশা-জাগানিয়া প্রতিচ্ছবি আঁকছিলেন তার ভাষণে। সেই আশার ঝলকানিতে পুরো মিলনায়তন হয়ে উঠেছিল এক উদীপ্ত স্বপ্নাঙ্গন। তিনি যেন রবীন্দ্রনাথের কথাগুলোরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছিলেন এবারের ইশতেহারটি পেশ করার সময়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'আশা করিবার ক্ষেত্র বড়ো হইলেই মানুষের শক্তিও বড়ো হইয়া ওঠে। শক্তিমান স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পায় এবং জোর করিয়া পা ফেলিয়া চলে।' বঙ্গবন্ধুকন্যা এবারের ইশতেহার উপস্থাপনের সময় স্বদেশের আশার ক্ষেত্রকে বড় করা এবং আমাদের শক্তির দ্রুত উল্লল্ফম্ফন দেশি ও বিদেশি দর্শকদের সামনে খুবই মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে।
এই ইশতেহারের পটভূমিতে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগ। আছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা ও ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক স্বৈরাচারী শক্তির সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মৌল চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করার দুঃখজনক বাস্তবতা। আছে সন্ত্রাস, লুটপাট, অর্থনৈতিক স্থবিরতার চিত্র। আছে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর সোনালি দিনের কথা। বিশেষ করে কৃষির উন্নয়ন, সামাজিক সংরক্ষণ, দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্বালানি খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল ওই সরকারের আমলে, তা অতি সংক্ষেপে উঠে এসেছে এবারের ইশতেহারে। একই সঙ্গে আছে ২০০১ সালের ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে ফের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পথ হারানোর দুঃসহ স্মৃতি এবং তার পরবর্তী সময়ে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ব্যাপক বিকাশের কালো অধ্যায়ের কথা। তার পরে নানা সংগ্রাম শেষে শেখ হাসিনার মুখ থেকেই উচ্চারিত হয় 'দিনবদলের সনদ'। এর পর কেটে গেছে ১০টি বছর। দশকজুড়েই অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে যে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে, তা খুবই দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছে এবারের ইশতেহার। বিগত দিনের সাফল্য ও অর্জনের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আগামী পাঁচ বছরের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবারের ইশতেহারে। তবে এবারের ইশতেহারের নতুন দিকটি হচ্ছে, ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অধীনে সমন্বিতভাবে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি এসডিজি (২০৩০) এবং উন্নত বাংলাদেশ (২০৪১) গড়ার অঙ্গীকারগুলো খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সংবিধানকে সর্বোচ্চ দলিল হিসেবে দেশ পরিচালনার অঙ্গীকার করেছে এবারের ইশতেহার। আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষার অংশ হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সার্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই এবারের ইশতেহারে এসেছে। রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১-এর আলোকে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্যগুলো অর্জনে একটি দক্ষ, জবাবদিহিমূলক ও সেবামুখী প্রশাসন গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা স্থান পেয়েছে এই ইশতেহারে। এর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও জনবান্ধব ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে এই অঙ্গীকারনামায়।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গীকারটি হচ্ছে 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ'। যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই লাইনটি উচ্চারণ করলেন, তখন যেন আর করতালি থামতেই চাচ্ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাষণের এই পর্যায়ে একটু থামলেন এবং মনে হলো, হলভর্তি মানুষের প্রাণের দাবিটি গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে অনুভব করলেন। তার স্মিতহাস্যে এই অনুভূতির 'এনডোর্সমেন্ট' দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন নিশ্চিত করার অঙ্গীকারের কথাই বলে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যে দুর্নীতিকে একদম পছন্দ করে না- এ ভাবনার স্বীকৃতি মেলে এবারের ইশতেহারে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও দক্ষ, আধুনিক ও প্রযুক্তিবান্ধব করার অঙ্গীকার করা হয়েছে এবারের ইশতেহারে। বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মাদক নির্মূল কার্যক্রম। বিশেষ করে 'হলি আর্টিসান'-এ আক্রমণের পর যে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা বিশ্ব-সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। উগ্রবাদী ও জঙ্গিবাদীদের হাতকে দেশ ও জনগণকে নিরাপদ রাখার তার অবিচল অঙ্গীকার ইশতেহারে উচ্চারিত হয়- 'আগামীতে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হবে।' তার এ উচ্চারণের সময়েও দর্শকরা ব্যাপক করতালির মাধ্যমে তার এই সাহসী নীতির অনুমোদন করেন। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার নানা প্রস্তাব এই ইশতেহারকে তার সুষম উন্নয়নের ধারণাকে আরও পোক্ত করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই একই সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পক্ষে।
খুব কাছে থেকে তার এই গণমুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জনের অভিপ্রায় লক্ষ্য করেছি। যেদিন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ১০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করল, সেদিন আমি তার অফিসেই একটি সভায় অংশগ্রহণ করছিলাম। হঠাৎ টেক্সট পেলাম এই অর্জন বিষয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে জানালাম। কী যে খুশিই না সেদিন তিনি হয়েছিলেন! ঠিক যেমনটি খুশি হয়েছিলেন এই রিজার্ভের বলেই তিনি নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই বৈশ্বিক মন্দা-পরবর্তী বাংলাদেশকে দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে যেভাবে উপর্যুপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাকে উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে আজ ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে উন্নীত করেছেন; সেই অর্জনের কথা যে তার ইশতেহারে বড় করে স্থান পাবে, তা আমরা জানতাম। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রবৃদ্ধির এই হারকে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন তিনি ইশতেহারে বুনেছেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক। এ জন্য তিনি ২০৪১ সাল নাগাদ বিনিয়োগ-জিডিপির হার ৪০ শতাংশে নিতে চান। ২০৩০ সাল নাগাদ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ হবে এবং এর পর তা কমতে থাকবে। তাই এই সময়ের মধ্যে তাদের সম্ভাবনাময় কাজে লাগানোর জন্য জ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে এবারের ইশতেহার। এই দলিল বলছে, ২০২১ সালে রফতানির পরিমাণ হবে ৫১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, ২০৩০ সালে ১৪২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৪১ সালে ৪৯৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধির জন্য চাই বাড়তি রাজস্ব আয়। সে জন্য চাই বাজেট সংস্কার; অর্থ পাচার রোধ; খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা। চাই বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্তিশালী তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এসবই স্থান পেয়েছে এবারের ইশতেহারে। প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য ইতিমধ্যে যে আটটি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করে অবকাঠামো খাতের কাঙ্ক্ষিত রূপান্তরের অঙ্গীকার করা হয়েছে এই ইশতেহারে।
'আমার গ্রাম-আমার শহর' আরেকটি স্বপ্নতাড়িত প্রস্তাব। কোটিখানিক প্রবাসী এখন বিদেশে শহরে থাকেন। দেশে এসে গ্রামে তারা উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ খোঁজেন। তা ছাড়া গ্রামের মানুষেরও আয়-রোজগার প্রচুর বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে তাদের উন্নত জীবনযাপনের চাহিদা। তাই অবাক হইনি যখন দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেন- গ্রামে উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, সুচিকিৎসা, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষিযন্ত্র, সেবাকেন্দ্র, তরুণদের কৃষি উদ্যোক্তা করার সুযোগ সৃষ্টি করবেন; অকৃষি খাতের প্রসার ঘটাবেন এবং কৃষিপণ্যের বাজার নিশ্চিত করতে 'ভেলুচেইন' উন্নততর করবেন। 'তারুণ্যের শক্তি- বাংলাদেশের সমৃদ্ধি' নিঃসন্দেহে ইশতেহারের এক অভিনব সংযোজন। এই যুবশক্তিকে সংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও উৎপাদনমুখী করা গেলে দেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে উন্নতই হবে না; সমাজও সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদকমুক্ত হবে।
সম্প্রতি ব্র্যাকের এক জরিপে জানা গেছে, তরুণদের পহেলা নম্বর চাওয়া হচ্ছে কর্মসংস্থান। তরুণীদের পহেলা নম্বর চাওয়া নিরাপদ পরিবহন। তাদেরও দ্বিতীয় দাবি কর্মসংস্থান। তাই তরুণদের জন্য শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টি, তাদের জন্য সুচিন্তিত যুবনীতি, যুব গবেষণা কেন্দ্র, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ন্যাশনাল সার্ভিসের সম্প্রসারণ এবং বিশেষ করে তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিনা জামানতে ঋণের সম্প্রসারণ, উদ্ভাবনমূলক কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি সহজলভ্য, ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টির অঙ্গীকার করা হয়েছে এই ইশতেহারে। নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আলাদা ব্যাংকিং ও ঋণের সুবিধা, 'জয়িতা' ফাউন্ডেশনের সম্প্রসারণ, নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূর, কর্মক্ষেত্রে 'ডে কেয়ার সেন্টার' গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেছে এবারের ইশতেহার। সামাজিকভাবে অবহেলিত প্রান্তজনের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল সুদৃঢ় করা, ২০৩০ সালে দরিদ্র জনসংখ্যা ২ দশমিক ২ কোটিতে নামিয়ে আনা; ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে কৃষি, পুষ্টি, প্রাণিসম্পদ খাতে লক্ষ্যভেদী প্রস্তাব রাখা হয়েছে এই ইশতেহারে।
ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করে জ্বালানি নিরাপত্তার অঙ্গীকার করেছে এই ইশতেহার। রফতানি বহুমুখীকরণ, কৃষি প্র্রক্রিয়াজাতকরণ, ঔষধ শিল্পের বিকাশ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও পদ্মাপাড়ে সিঙ্গাপুরের আদলে শিল্পনগরী গড়ার অঙ্গীকার করেছে এই ইশতেহার। শিল্প খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, নৃগোষ্ঠী ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মানবসম্পদে পরিণত করা, প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা, বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে অনেক প্রাসঙ্গিক প্রস্তাব স্থান পেয়েছে এই ইশতেহারে। সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগ উন্নত করারও একগুচ্ছ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব স্থান করে নিয়েছে এই ইশতেহারে। আবার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় আগামী পাঁচ বছরে ফাইভ-জি চালু করা, ই-পাসপোর্ট ও ভিসা, শিক্ষা কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ও পণ্যের রফতানি ৭ বিলিয়নে উন্নীত করা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণসহ অনেক লক্ষ্যভেদী প্রস্তাব যুক্ত হয়েছে এবারে ইশতেহারে। সমুদ্র বিজয়ের অংশ হিসেবে ব্লু-ইকোনমির উন্নয়নে নয়াদিগন্ত উন্মোচন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা; শিশু, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ কল্যাণ; দলিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের অঙ্গীকার প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা কতটা মানবিক রাষ্ট্রনায়ক। মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তাদের ভরণপোষণ ও বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে এই ইশতেহারে। সবশেষে ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ অর্জনের স্বপ্ন ও কর্মকৌশল যোগ করা হয়েছে এই ইশতেহারে।
বঙ্গবন্ধুকন্যার মতো দূরদর্শী নেত্রীর কাছ থেকে সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এক আশা-জাগানিয়া নির্বাচনী ইশতেহার আশা করেছিলেন দেশবাসী। তিনি তাদের বিমুখ করেননি। তাই 'সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ' শিরোনামের এই ইশতেহার তরুণদের আগ্রহী করে তুলবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান উদযাপনের সময় যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবগাহনের সুযোগ অব্যাহত থাকে, তাদের সে প্রত্যাশা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আর তাদের জন্য সে সুযোগ আসছে বিজয়ের এই মাসের ৩০ তারিখে। ওই দিনই তরুণ ভোটারসহ সবাইকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আসন্ন এই দুই মাইলফলক আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকারে উজ্জ্বল প্রাণবন্ত এক আবহে সম্পন্ন করব; নাকি সন্ত্রাস, ধর্মান্ধতা ও পাকিস্তানপন্থি এক অপরাজনীতির অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার দুঃসহ বেদনার পরিবেশ বেছে নেব।
লেখকঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল